বরাদ্দ কাজে লাগানো নিয়ে সংশয়ী বিশেষজ্ঞরা চান স্বাস্থ্যের সংস্কার

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও বিদ্যমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় তা কতটা ফলপ্রসূ হবে তা নিয়ে সন্দিহান বিশেষজ্ঞরা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 June 2020, 07:18 PM
Updated : 11 June 2020, 08:59 PM

যত দ্রুত সম্ভব স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সংস্কারে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

উন্নয়ন গবেষক আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে বাজেটে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনার প্রত্যাশা থাকলেও তার প্রতিফলন ঘটেনি।

স্বাস্থ্য খাতে ‘দুর্নীতি’র যে খবর রয়েছে সেখানে এই অর্থ ঠিকমতো ব্যয় করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন তিনি।

তার সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন বিআইডিএসের গবেষক জায়েদ বখত এবং সানেমের সেলিম রহমান।

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২০-২১ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল। ছবি: পিআইডি

বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতের দুর্দশা দীর্ঘদিনের ‘পুঞ্জিভূত অবহেলার’ ফসল  আখ্যায়িত করে এর সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেছেন, “স্বাস্থ্যের জন্য যে ব্যাপক সংস্কার দরকার, তার সূচনা এই বাজেটে হওয়া দরকার। সেজন্য পরিকল্পনা করার সময় আমাদের এখনো আছে।

“আমি বলব, জনস্বাস্থ্যকে কেন্দ্র রেখে এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চাহিদা অনুযায়ী আমাদের পরিকল্পনা করতে হবে।”

করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মধ্যে উত্থাপিত বাজেটে পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার ফর্দে স্বাস্থ্য খাতের জন্য সব মিলিয়ে ৪১ হাজার ২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

বরাদ্দের এই অংক জিডিপির ১ দশমিক ৩ শতাংশ এবং মোট বাজেট বরাদ্দের ৭ দশমিক ২ শতাংশ। এর মধ্যে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় যে কোনো জরুরি চাহিদা মেটানোর জন্য ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দও রেখেছেন অর্থমন্ত্রী।

২০১৯-২০২০ অর্থবছরে স্বাস্থ্যখাতের জন্য বরাদ্দের পরিমাণ ছিল জিডিপির মাত্র ০ দশমিক ৮৯ শতাংশ এবং পুরো বাজেটের আকারের ৫ দশমিক ৮ শতাংশ।

আহসান এইচ মনসুর

বাজেটের প্রতিক্রিয়ায় পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর বলেন, “কোভিড-১৯ এর এই সময়ে সবাই প্রত্যাশা করেছিল স্বাস্থ্য খাতে কিছু সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা থাকবে অর্থমন্ত্রীর বাজেটে। কিন্তু সেটা নেই। বরাদ্দ কিছু বেড়েছে। ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দও রাখা হয়েছে। কিন্তু দেশের আতঙ্কিত মানুষকে আশা দেখানোর মতো কোনো স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদে কোনো পরিকল্পনার কথা জানাননি অর্থমন্ত্রী।”

বরাদ্দ অর্থের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতে মনোযোগী হওয়ার তাগাদা দিয়ে তিনি বলেন, “স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির কথা আমরা সবাই জানি। শুধু টাকা বরাদ্দ দিলেই হবে না, এই টাকার যেন যথাযথ ব্যবহার হয়, অপচয় না হয়, দুর্নীতি না হয়- সেটাই এখন সবচেয়ে বড় বিষয়।”

জায়েদ বখত

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে যেসব কাঠামোগত সমস্যা আছে সেগুলো টাকা দিয়ে সমাধান করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক জায়েদ বখত।

তিনি বলেন, “দক্ষ জনবলের অভাব থেকে শুরু করে অনেক সমস্যা আছে, যেটা স্বল্পমেয়াদে টাকা বেশি খরচ করে সমাধান করে ফেলা যাবে না।”

অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত বলেন, “এই বাজেটে আমি খুব বেশি আশা করি না। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে স্বাস্থ্য খাতের সমস্যাগুলোকে সমাধান করতে হবে। আমাদের এই মুহূর্তে যা আছে সেটাকে খুব ভালো মতো ব্যবহার করা এবং বাস্তবায়ন করা খুব জরুরি।”

স্বাস্থ্য খাতে টাকা বাড়ানোর চেয়ে লকডাউন ঠিকমতো বাস্তবায়ন করা, অক্সিজেনের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করাই এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি।

“এগুলো ঠিক মত করতে না পারলে আমরা সব দিকে ব্যর্থ হয়ে যাব।”

অধ্যাপক সেলিম রায়হান

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, “আমরা যে বড় ধরনের স্বাস্থ্যগত সংকট দেখছি এবং সেই সংকট মোকাবেলায় আমাদের যে অস্থিরতা, অদক্ষতা, সক্ষমতার অভাব দেখছি এটা কিন্তু একদিনে হয়নি, এটা দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ফলাফল। আমাদের স্বাস্থ্য খাত, বিশেষ করে সরকারি স্বাস্থ্যখাতকে দীর্ঘদিন অবহেলা করা হয়েছে এবং আমরা বেসরকারি স্বাস্থ্যখাতেও দেখছি দায়বদ্ধতার একটা বড় ধরনের অভাব। এই যে দীর্ঘ দিনের পুঞ্জীভূত ফলাফল সেটারই প্রতিফলন আমরা দেখছি এই স্বাস্থ্য সংকটে এবং সরকারি স্বাস্থ্যসেবার বেহাল দশায়।

“এই যে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হল, সেটিকে আমি অবশ্যই সাধুবাদ জানাই। কিন্তু, এখানে পাশাপাশি এটাও নিশ্চিত করতে হবে যে, স্বাস্থ্যখাতের ব্যবস্থাপনার যে বেহাল দশা সেটির উন্নয়ন করা হচ্ছে। ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন না ঘটলে, এই বর্ধিত বরাদ্দ সত্যিকার অর্থেই কতটুকু কার্যকরী হবে সেটি নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।”

পরামর্শ

স্বাস্থ্য খাতে সংস্কারে বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন।

কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির পিএইচডি ডিগ্রিধারী এই গবেষক বলেন, “স্বাস্থ্যকে যদি পিরামিড আকারে চিন্তা করি তাহলে একদম তৃণমূল পর্যায়ে আমাদের সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, সেটা কিন্তু এখনও যথেষ্ট নয়। এখানে খুব কম বরাদ্দ রাখা হয়েছে।”

ডা. মুশতাক হোসেন

বর্তমান বছর থেকে জনসংখ্যার কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার আওতায় নিয়ে আসার প্রয়োজন ছিল মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সে তুলনায় তেমন কিছুই করা হয়নি।“

করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সরকারের অন্যতম পরামর্শক হিসাবে কাজ করছেন ডাকসুর সাবেক জিএস মুশতাক।

গ্রামাঞ্চলের মত শহরাঞ্চলে জনস্বাস্থ্য কাঠামো তৈরির পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “শহরাঞ্চলে কমিউনিটিভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবাটা অবশ্যই শুরু করা দরকার। তাহলে মহামারী প্রতিরোধ করা, মহামারী নিয়ন্ত্রণ করা, জনস্বাস্থ্যের জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলা করা আমাদের পক্ষে খুবই কঠিন হয়ে যাবে।”

গবেষণার জন্য আইইডিসিআর ও বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলকে সম্প্রসারণ করার সুপারিশ করে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, “শীর্ষ পদে মহাপরিচালকের মত পদ তৈরি করে এসব প্রতিষ্ঠানকে সম্প্রসারণ করা দরকার।”

প্রতিবেশী দেশ ভারতের উদাহরণ কাজে লাগানো যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

স্বাস্থ্যসেবাকে সংস্কারের পরামর্শ দিয়ে ডা. মুশতাক বলেন, “তৃণমূল পর্যায়ে, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে হাসপাতাল, জেনারেল হাসপাতালের সম্প্রসারণ করতে হবে এবং লোকবল দিতে হবে। তাহলে জরুরি সেবার ক্ষেত্রে চতুর্থ পর্যায়ের সুপার স্পেশাল হাসপাতালের চাপ পড়বে না। আগে থেকে অনেকগুলো রোগের সমাধান হয়ে যাবে।”