কোভিড-১৯: সুস্থ রোগীর সংখ্যায় উল্লম্ফন, ব্যাখ্যায় অস্পষ্টতা

নতুন করোনাভাইরাস আক্রান্তদের মধ্যে শনিবার পর্যন্ত ১৭৭ জনের সুস্থ হয়ে ওঠার তথ্য দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর; কিন্তু একদিন বাদেই সুস্থ হয়ে ওঠা রোগীর সংখ্যা ১ হাজারের বেশি বলে জানানো হল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকেই।

জয়ন্ত সাহা নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 May 2020, 02:09 PM
Updated : 3 May 2020, 05:40 PM

এক দিনে সুস্থ হওয়ার সংখ্যার এই উল্লম্ফনের যে কারণ রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত বুলেটিনে দেখানো হয়, তার সঙ্গে মিলছে না অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তার ব্যাখ্যা।

এই অস্পষ্টতা কাটাতে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটির এক পরামর্শকের সঙ্গে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম কথা বললেও তা স্পষ্ট হওয়া যায়নি।

গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম কোভিড-১৯ রোগী ধরা পড়ার আগে থেকে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট নিয়মিত সংবাদ সম্মেলন করে সর্বশেষ পরিস্থিতি জানিয়ে আসছিল।

বাংলাদেশে প্রাদুর্ভাবের পর এক পর্যায়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে এই সংবাদ ব্রিফিংয়ের দায়িত্ব নিয়ে নেয়; এরপর ৭ এপ্রিল জানানো হয়, এই ভার্চুয়াল ব্রিফিংয়ে কোনো সাংবাদিকের প্রশ্ন নেওয়া হবে না, তথ্যগুলো শুধু বুলেটিন আকারে জানানো হবে।

এরপর থেকে সেভাবেই চলে আসছে এবং বেশিরভাগ দিন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ডা. নাসিমা সুলতানাই এই বুলেটিন জানাতে আসছেন।

তিনি শনিবারের বুলেটিনে বলেছিলেন, ওই দিন সকাল ৮টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে থাকা আরও ৩ জন কোভিড-১৯ রোগী সুস্থ হয়ে উঠেছেন। তাদের নিয়ে এ পর্যন্ত মোট ১৭৭ জন সুস্থ হয়ে উঠলেন।

রোববারের বুলেটিনে ডা. নাসিমা বলেন, কোভিড-১৯ আক্রান্তদের মধ্যে এ পর্যন্ত মোট ১ হাজার ৬৩ জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন।

তিনি জানান, এর মধ্যে ঢাকা মহানগরীর হাসপাতালগুলো থেকে এ পর্যন্ত ৬২৪ জন ছাড়া পেয়েছেন। মহানগরীর বাইরে ঢাকা বিভাগের অন্যান্য হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন ২৭২ জন।

একদিনে সর্বোচ্চ ৬৬৫ জন রোগী শনাক্তের দিনই সুস্থতায় উল্লম্ফনের খবর দেন তিনি।

সুস্থ রোগীর সংখ্যা হঠাৎ এত বেড়ে যাওয়ার ব্যাখ্যায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা বুলেটিনে বলেন, হাসপাতালে ভর্তি রোগীর ছাড়ের ক্ষেত্রে ‘নীতিমালা পরিবর্তন করায়’ সংখ্যার উল্লম্ফন হয়েছে।

“সুস্থতার বিষয়ে- ক্লিনিক্যাল ম্যানেজমেন্ট কমিটি আছে, তারা নতুন একটি গাইডলাইন করেছে। আমরা রোগীদের কীভাবে সুস্থ বলতে পারব, তারা কীভাবে হাসপাতাল ত্যাগ করতে পারবে, কোন ক্রাইটেরিয়াতে, এই ক্রাইটেয়িরাতে সুস্থ হয়েছেন ১ হাজার ৬৩ জন।”

কোভিড-১৯ রোগীদের নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করে ফল পরপর দুই বার করোনাভাইরাস ‘নেগেটিভ’ পাওয়ার পর হাসপাতাল থেকে ছাড়তে দেখা যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে।

নীতিমালা নিয়ে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটির অন্যতম পরামর্শক ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আগের নিয়ম অনুযায়ী, করোনাভাইরাস ‘পজিটিভ’ ব্যক্তির নমুনা ১৪ দিন পর একবার পরীক্ষা করা হত। এর এক সপ্তাহ পর, অর্থাৎ ২১ দিন পর দ্বিতীয় বার নমুনা পরীক্ষা করা হত। তাতেও ফল নেগেটিভ এলে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টা অথবা দুই-তিন দিনের মধ্যে আরেকবার পরীক্ষা করে ‘নেগেটিভ’ ফল পেলে রোগীকে সুস্থ ঘোষণা করে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হত। বলা হত বাড়িতেও দুই সপ্তাহ কোয়ারেন্টিনে থাকতে।

ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে করোনাভাইরাস আক্রান্ত এক পরিবারের পাঁচ নারী সেরে উঠেছেন।

“নতুন নিয়ম অনুযায়ী, রোগী যদি ‘ক্লিনিক্যালি সুস্থ’ হয়ে ওঠেন অর্থাৎ পরপর তিন দিন যদি তার আর জ্বর না থাকে, কাশি বা শ্বাসকষ্ট না হয়, তাহলে তাকে হাসপাতালে না রেখে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। সেখানেই তিনি দুই সপ্তাহের আইসোলেশনে থাকবেন,” বলেন অধ্যাপক নজরুল।

আগের নিয়মে আক্রান্ত হওয়ার দুই ও তিন সপ্তাহ পর যে দুটি পরীক্ষা করা হত, তা এখন বাড়িতেই করা হবে বলে জানান তিনি।

বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নেওয়া রোগীরা সুস্থ হয়ে উঠলে তাদের তথ্য ব্যবস্থাপনা কীভাবে হবে, সে বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক নজরুল কোনো মন্তব্য করেননি।

আবার দুই-তিন দিন জ্বর না এলে রোগীকে বাড়ি পাঠিয়ে তাকে সুস্থ ধরা হচ্ছে কি না, সেই প্রশ্নেরও উত্তর মিলছে না।

বিষয়টি স্পষ্ট হতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোভিড-১৯ সংক্রান্ত মিডিয়া সেলের প্রধান, অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমান খানের কাছে জানতে চাইলে তিনি আবার দেন ভিন্ন ব্যাখ্যা।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এতদিন কেবল ঢাকার হাসপাতালের তথ্য দেওয়া হত, আজ থেকে সারা দেশের তথ্য সংযোজিত হওয়ায় সুস্থ রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে।

“এখন থেকে সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীরা সুস্থ হয়ে উঠলে, তাদের তথ্য দেওয়া হবে। আমাকে এমনটাই জানিয়েছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা।”

হাবিবুর রহমানের কাছ থেকে ভিন্ন বক্তব্য আসায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানাকে প্রশ্ন করতে তাকে ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। ‘অপপ্রচার’ ঠেকিয়ে দেশে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ ও বিস্তার রোধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নানা কার্যক্রম বা পদক্ষেপগুলো নিয়মিত জানাতে হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে ‘মিডিয়া সেল’ গঠন করেছে সরকার।

তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কার্যক্রম নিয়ে রয়েছে নানা সমালোচনা। একদিন আগেই তাদের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে নাগরিক টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ডা. আব্দুন নূর তুষার বলেছিলেন, এই কারণেই তাদের তথ্য মানুষ বিশ্বাস করতে চাইছে না।

 

সেমিনারে আলোচনায় অংশ নিয়ে নাগরিক টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ডা. আব্দুন নূর তুষার বলেন, “সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতি আমাদের নির্ভরশীলতা তৈরি হচ্ছে

চীন সম্প্রতি করোনাভাইরাসে উহানে মৃত্যুর সংখ্যা সংশোধন করার পর তা নিয়েও নানা দেশ সমালোচনা করেছিল।

এদিকে নতুন নীতিমালাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুশতাক হোসেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অনেক রোগীর লক্ষণ-উপসর্গ মৃদু থাকে। তাদের ৩-৪ দিন পরে বাসায় পাঠিয়ে দিলে ভালো। ইউরোপের অনেক দেশেও এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

“উপসর্গ মৃদু থাকলে তাদের অল্প সময়ের মধ্যে বাড়িতে পাঠিয়ে বাড়িতে থাকাকালীন চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে বলা হয়। তবে কোনো রোগী এখন যদি নিজের শারীরিক অবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন হন, তবে তিনি হাসপাতালে থেকে যেতে পারেন। যাদের বাড়িতে আইসোলেশনে থাকার বন্দোবস্ত নেই, তাদের হাসপাতালে রাখতে হবে।”