এই সব প্রশ্নের কেন্দ্রে রয়েছে একটি বিষয়- রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ইমিউন সিস্টেম। কোভিড-১৯ এর কোনো প্রতিষেধক বা প্রতিরোধক এখনও তৈরি করা যায়নি। ফলে সেরে ওঠার প্রশ্নে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু মুশকিল হল, নতুন করোনাভাইরাস সম্পর্কে মানুষ এখনও সামান্যই জানে।
শরীর কীভাবে ভাইরাস প্রতিরোধী হয়ে ওঠে?
বাইরে থেকে কোনো রোগজীবাণু মানুষের শরীরে ঢুকে গেলে ইমিউন সিসটেম বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সক্রিয় হয়ে ওঠে।
ইমিউন সিসটেমের হয়ে প্রতিরোধকারী কোষ লিমফোসাইট (টি-সেল) শরীরে প্রবেশ করা অচেনা বস্তুকে দমন করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সংক্রামক কোষের অ্যান্টিজেনের সাথে সংযুক্ত হওয়ার চেষ্টা করে টি-সেল। সংক্রামক কোষে সফলভাবে সেঁটে যেতে পারলে টি-সেল থেকে এক ধরনের রাসায়নিক নিঃসৃত হয়, যা সেই জীবাণুকে ধ্বংস করে।
ইমিউন সিসটেম কাজ করে দুই ভাগে। এর একটি ইনেট ইমিউন সিসটেম; যা শরীরের ভেতরে রোগ-জীবাণু ঠেকানোর জন্য একেবারে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া। মানুষের ত্বক, এমনকি চোখের পানিও এই ইমিউন সিসটেমের অংশ। বিশেষ রাসায়নিকের নিঃসরণ ঘটিয়ে এবং শ্বেত রক্ত কণিকার মাধ্যমে রোগ-জীবাণু ধ্বংস করার চেষ্টা চলে এ পর্যায়ে।
তবে কোনো বিশেষ ভাইরাস বা করোনাভাইরাসকে আলাদা করে চিনে রাখতে পারে না ইনেট ইমিউন সিসটেম। নতুন কোনো সংক্রামক বা ভাইরাসকে চিনে রাখার কাজটি ঘটে অ্যাডাপটিভ ইমিউন সিসমেটে।
টি-সেল সফলভাবে অ্যান্টিজেনকে আটকাতে পারলে ওই প্যাথোজেনের ঠিকুজি জেনে যায় শরীর। ওই ভাইরাসের জন্য তৈরি হয় নির্দিষ্ট অ্যান্টিবডি। এরপর সেই অ্যান্টিবডি ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে।
গবেষণা বলছে, করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হতে ১০ দিনের মত সময় লাগে। রোগী যত বেশি অসুস্থ, তার শরীরের ইমিউন সিসটেম তত বেশি তৎপর হয়ে ওঠে।
যদি অ্যাডাপটিভ ইমিউন সিসটেম যথেষ্ট শক্তিশালী হয়, তাহলে সেই সংক্রমণের স্মৃতি অ্যান্টিবডিতে থেকে যেতে পারে, যা ভবিষ্যতেও হয়ত সুরক্ষা দেবে।
তবে উপসর্গ বা অসুস্থতা মৃদু হলে অ্যাডাপটিভ ইমিউন সিসটেম একইভাবে কাজ করে কি না, সে বিষয়ে এখনও নিশ্চিত হতে পারেননি বিজ্ঞানীরা।
ইমিউন সিসটেমের স্মৃতি অনেকটা মানুষের মস্তিষ্কের মতই; কিছু কিছু জীবাণুকে সে স্পষ্ট চিনে রাখে, আবার কিছু কিছু ভুলে যায়।
হামের ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হলে সাধারণত তা সারা জীবন কার্যকর থাকে। হাম, মাম্পস আর রুবেলার (এমএমআর) টিকার মাধ্যমে একবার সেসব ভাইরাসকে শরীর চিনে ফেললে সেসব রোগ সাধারণত আর হয় না।
তবে অনেক ভাইরাস একই ব্যক্তির শরীরে বার বার অসুস্থতা তৈরি করতে পারে। এক শীতের মৌসুমেই শিশুরা একাধিকবার শ্বাসতন্ত্রের রোগ আরএসভি বা রেসপিরেটরি সিংকটিয়াল ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে।
সার্স-সিওভি-২ বা নতুন করোনাভাইরাস নামে পরিচিতি পাওয়া ভাইরাসটি বিশ্বজুড়ে সক্রিয় রয়েছে গত চার মাস ধরে। ভাইরাসটি নতুন হওয়ায় সুস্থ ব্যক্তির শরীরে অ্যান্টিবডি কতদিন কার্যকর থাকবে তা বলার মত সময় এখনও আসেনি। তবে করোনাভাইরাসের অন্য ছয়টি ধরন নিয়ে গবেষণা থেকে এ বিষয়ে ধারণা পেতে চাইছেন গবেষকরা।
এর মধ্যে চার ধরনের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে মানুষের শরীরে সাধারণ সর্দি-কাশির মত উপসর্গ দেখা দেয়। একবার সেরে ওঠার পর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই মানুষ আবারো আক্রান্ত হতে পারে।
বিভিন্ন গবেষণা থেকে বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই চার ধরনের করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা ইমিউন সিসটেম দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর থাকে না।
অন্য দুটি করোনাভাইরাসের একটি সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রম (সার্স), অন্যটি মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রম (মার্স)। এই দুই ভাইরাসের সংক্রমণের কয়েক বছর পরও শরীরে অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে।
ইউনিভার্সিটি অফ ইস্ট অ্যাংলিয়ার অধ্যাপক পল হান্টার বলেন, “কতদিনের জন্য শরীরের ইমিউন সিসটেম কার্যকর থাকবে সেটা মূল প্রশ্ন নয়। এটা মোটামুটি নিশ্চিত যে সারা জীবন তা থাকবে না।
সার্সের অ্যান্টিবডির গবেষণায় দেখা গেছে, এর কার্যকারিতা এক থেকে দুই বছর পর্যন্ত থাকতে পারে। তবে এটাও নিশ্চিত কোনো তথ্য নয় বলে জানান হান্টার।
বিজ্ঞানরীরা এমনও বলছেন যে, একবার সুস্থ হয়ে ওঠার পর পুনরায় সংক্রমণ ততটা গুরুতর নাও হতে পারে।
খুব অল্প সময়ের মধ্যে একজন ব্যক্তির শরীরে দ্বিতীয়বার সংক্রমণ ধরা পড়ার কিছু খবর ইতোমধ্যে এসেছে।
কেউ কেউ বলছেন, ওই ব্যক্তিরা আসলেই দুই দফা আক্রান্ত হয়েছেন। কেউ আবার বলছেন, ওই ব্যক্তিদের শরীরে আসলে ভাইরাস সুপ্ত অবস্থায় থেকে গিয়েছিল। তখন উপসর্গ না থাকায় তিনি সুস্থ হয়ে গেছেন বলে মনে হয়েছে। পরে সেই ভাইরাস আবার সক্রিয় হওয়ায় অসুস্থতা ফিরে এসেছে।
তবে বিজ্ঞানীদের একটি বড় অংশ একমত যে, সমস্যাটা আসলে টেস্টে। পরীক্ষার ফলের ভুলে ওই ব্যক্তিদের সুস্থ বলা হলেও আসলে তারা তখনও সুস্থ হননি।
ইমিউনিটি পরীক্ষার জন্য মানুষের ওপর এ ভাইরাস দ্বিতীয়বার প্রয়োগ করা হয়নি। তবে এক জোড়া বানরের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে দেখেছেন বিজ্ঞানীরা। দেখা গেছে তিন সপ্তাহের ব্যবধানে বানর দুটি দ্বিতীয় দফায় ভাইরাস আক্রান্ত হয়েছে। তবে দ্বিতীয় দফায় তাদের শরীরে কোনো উপসর্গ ছিল না।
অ্যান্টিবডি তৈরি হলেই কি ঝুঁকিমুক্ত?
না, এরকম নিশ্চয়তা এখনই দেওয়া যাচ্ছে না। আর সে কারণেই যে সব দেশ ‘ইমিউনিটি’ তৈরি হওয়ার যুক্তি দিয়ে লকডাউন তুলছে, তাদের সতর্ক করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
ক্লিনিক ও হাসপাতালে কাজ করা স্বাস্থ্যকর্মীরা রোগীর সংস্পর্শে আসেন বলে তারা সব সময়ই আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন। তাদের জন্য এই `ইমিউনিটি সনদ’ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
শরীরের সব অ্যান্টিবডিই যে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়তে পারবে তা নয়। ‘নিউট্রালাইজিং’ অ্যান্টিবডিই সাধারণত ভাইরাসের গায়ে সেঁটে তাকে আটকে ফেলতে পারে। চীনে সেরা ওঠা ১৭৫ জন রোগীকে পরীক্ষা করে তাদের ৩০ শতাংশের শরীরে বেশ দুর্বল নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি পাওয়া যায়।
আবার শরীরে অ্যান্টিবডি থাকায় একজন ব্যক্তি হয়ত নিজে সংক্রমিত হচ্ছেন না, কিন্তু তার মাধ্যমে ঠিকই ভাইরাস অন্যের মধ্যে ছড়াতে পারে।
গবেষকরা বলছেন, যদি শরীরে এ ভাইরাসের বিরুদ্ধে দীর্ঘ মেয়াদী ইমিউনিটি সিসটেম তৈরি না হয়, তাহলে টিকা আবিষ্কারের কাজটিও কঠিন হয়ে যাবে।
অ্যান্টিবডির কার্যকর উপস্থিতি বা অনুপস্থিতির উপর নির্ভর করবে টিকা কীভাবে মানুষের শরীরে প্রয়োগ করা যাবে; সারা জীবনে একবার দিলেই হবে, না কি ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকার মত প্রতি বছর দিতে হবে।
এসব প্রশ্নের উত্তর এখনও জানা নেই; তবে বিজ্ঞানীদের গবেষণা এখনও চলছে।