কোভিড-১৯: আশা দেখানো ‘প্লাজমা থেরাপি’ বাংলাদেশেও প্রয়োগের পরিকল্পনা

টিকা নেই এখনও, নেই নির্দিষ্ট ওষুধও; এই পরিস্থিতিতে কোভিড-১৯ আক্রান্তদের ‘প্লাজমা থেরাপি’ দিয়ে সারিয়ে তোলার যে চেষ্টা অন্য দেশগুলো শুরু করেছে, তা প্রয়োগের পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশও।

ওবায়দুর মাসুম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 April 2020, 02:47 PM
Updated : 22 April 2020, 02:53 PM

দেশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উদ্যোগে একদল চিকিৎসক এই পদ্ধতির ব্যবহার নিয়ে ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করেছেন। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে করোনাভাইরাসের রোগীদের মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে ‘প্লাজমা থেরাপি’ প্রয়োগ করা হবে বলে অধিদপ্তর জানিয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমুহ) ডা. আমিনুল হাসান বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট্কমকে বলেন, পরীক্ষায় সফল হলে তারা রোগীদের উপর এই পদ্ধতি প্রয়োগ করবেন।

“আমরা একটি কারিগরি কমিটি করে দিয়েছি। তারা প্রটোকল তৈরি করছে। প্রটোকল তৈরি হলে আমরা কিছু টেস্ট করে দেখব প্লাজমা থেরাপি কতটা কাজ করে। পরীক্ষাটা শুরু করব মে মাসের প্রথম সপ্তাহে। এখানে ভালো ফল পেলে দ্রুতই আমরা রোগীদের মধ্যে প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগ করব।”

নতুন করোনাভাইরাস বৈশ্বিক মহামারী আকার ধারণ করায় লাখ লাখ রোগী সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে উন্নত দেশগুলোও। এই অবস্থায় নতুন এই রোগে আক্রান্তদের সারিয়ে তুলতে সেরে ওঠা ব্যক্তিদের রক্তের প্লাজমা অসুস্থদের দেওয়ার চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ নানা দেশ।

রক্তের তরল, হালকা হলুদাভ অংশকে প্লাজমা বা রক্তরস বলে। তিন ধরনের কণিকা ছাড়া রক্তের বাকি অংশই রক্তরস। মেরুদণ্ডী প্রাণীর শরীরের রক্তের প্রায় ৫৫ শতাংশই রক্তরস।

চিকিৎসকরা বলছেন, কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা এ ভাইরাস মোকাবেলা করে টিকে থাকতে অ্যান্টিবডি তৈরি করে। এই অ্যান্টিবডি করোনাভাইরাসকে আক্রমণ করে। সময়ের সাথে সাথে আক্রান্ত ব্যক্তির প্লাজমায় প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। ওই অ্যান্টিবডিই অসুস্থদের সারিয়ে তোলার জন্য ব্যবহার হবে।

করোনাভাইরাসের রোগীদের চিকিৎসায় প্লাজমা থেরাপির প্রয়োগ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে। ছবি: রয়টার্স

গত ৩ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন-এফডিএ কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় পরীক্ষামূলকভাবে প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগের সুপারিশ করে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের হেমাটোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এম এ খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, বাংলাদেশে বিষয়টি নিয়ে কাজ করা যায় কি না, সে চিন্তা থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে একটি প্রতিবেদন পাঠান তিনি।

১২ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখায় একটি বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয় বিষয়টি নিয়ে কাজ করার।

গত ১৯ এপ্রিল একটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অধ্যাপক ডা. এম এ খানকে সভাপতি করে ৪ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি করে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির,ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মাজহারুল হক তপন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সী।

কমিটিকে ৫ দিনের মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে সিরাম প্রয়োগের জন্য প্রটোকল তৈরি করতে বলা হয়।

অধ্যাপক ডা. এম এ খান বলেন, এই পরীক্ষার জন্য প্লাজমায় অ্যান্টিবডির উপস্থিতি পরীক্ষা করতে হবে। প্লাজমায় অ্যান্টিবডির পরিমাণ যদি ভালো থাকে তাহলে কাজটা ভালো হবে।

“এই পরীক্ষাটা কোথায় কোথায় আছে, কী পরিমাণ রিঅ্যাজেন্ট, রোগী জোগাড়, রক্ত পরিসঞ্চালন করার বিষয়টিও দেখতে হবে। এসব বিষয় সামনে রেখে আমরা এগুবো।”

“যদি কিছু মানুষের উপকারে আসে সেটাই হবে প্রাপ্তি। কারণ এই রোগের কোনো ভ্যাকসিন নাই। কোনো চিকিৎসা নাই। এখন পর্যন্ত প্লাজমা থেরাপির কথাই বিভিন্ন দেশে বলা হচ্ছে। এটাতে অন্তত রোগীর কোনো ক্ষতি হবে না,” বলেন তিনি।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের রোগী দিন দিনই বাড়ছে। বুধবার নাগাদ আক্রান্তের সংখ্যা ৩ হাজার ৭০০ ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছে ১২০ জন। সেরে উঠেছেন ৯২ জন। রোগী বাড়ায় চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে চিকিৎসকদের।

অধ্যাপক ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মানুষের রক্তে অ্যান্টিবডি থাকে। যে ব্যক্তি অসুস্থ অবস্থা থেকে সুস্থ হয়েছে, তা অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ার ফলেই হয়েছে। এই অ্যান্টিবডি রক্তে থেকে যায়।

“আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে রক্তে সিরাম বা প্লাজমা থাকে। এখন আমরা যদি প্লাজমা নির্দিষ্ট পরিমাণে দিতে পারি, তাহলে আক্রান্ত ব্যক্তি ভালো থাকবেন। কারও রক্তে যদি ভাইরাস থাকে তাহলে সেটা প্রতিরোধ করতে পারবে। এরকম কিছু স্টাডি ইতিমধ্যে এসেছে। সেগুলো থেকে বলা যায় যে ভালো ফলাফল আসতে পারে।”

সেরে ওঠা রোগীর প্লাজমায় থাকা অ্যান্টিবডিই দেখাচ্ছে আশা। ছবি: রয়টার্স

প্রটোকল তৈরির বিষয় জানতে চাইলে বিশেষজ্ঞ কমিটির এই সদস্য বলেন, “অন্যান্য দেশে এই চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার হচ্ছে। বাংলাদেশে এই পদ্ধতির প্রয়োগ শুরু করতে কিছুটা সময় লাগবে।

“এক্ষেত্রে কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ হওয়ার পরও তার অন্য কোনো রোগ আছে কি না, তা আগে পরীক্ষা করে নিতে হবে। কোনো রোগ না থাকলে তার প্লাজমা নেওয়া যাবে।”

এখন পর্যন্ত প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করছেন জানিয়ে অধ্যাপক সাইফ উল্লাহ বলেন, “আমাকে বলা হয়েছে, একটা প্রটোকল তৈরি করতে। আমরা একটা প্রটোকল তৈরি করব, এটা কীভাবে দিতে হবে, কীভাবে দেওয়া যায়। এটা নিয়ে কাজ হচ্ছে। আগামী সপ্তাহে আমরা এটা সাবমিট করব।”

কাদের প্লাজমা নেওয়া যাবে, কোন পরিস্থিতিতে রোগীদের তা দেওয়া যাবে, তা দেওয়া িহবে কীভাবে, তার বিস্তারিত থাকবে প্রটোকলে।

অধ্যাপক ডা. এম খানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাইপার-ইমিউন বা কোনভেলিসেন্ট প্লাজমা হলো সদ্য কোভিড-১৯ আক্রান্ত-পরবর্তী সুস্থ ব্যক্তির রক্তের প্লাজমা। এই প্লাজমায় প্রচুর নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি রয়েছে। এই অ্যান্টিবডি দ্রুত কোভিড-১৯ ভাইরাসকে অকার্যকর করে দিতে পারে। এজন্য কোভিড-১৯  থেকে সুস্থ হওয়া ব্যক্তির রক্তের প্লাজমা অংশ সংগ্রহ করে ফ্রিজিং করে রাখতে হবে। কোভিড-১৯ আক্রান্তদের মধ্যে যাদের অবস্থা খারাপের দিকে তাদের শরীরে এই প্লাজমা প্রয়োগ করা হবে।

“কোভিড-১৯ হওয়ার পর জ্বর, কাশি ও গলাব্যথা শুরু হয়। ভাইরাসের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং ফুসফুস আক্রমণ করে। এই প্রদাহকালীন নানা ধরনের সাইটোকাইন এবং ক্যামোকাইন বেশি পরিমাণে নিঃসৃত হয়ে ফুসফুস জ্বালা করে। যন্ত্রণা তাৎক্ষণিকভাবে লাঘব করতে পারে প্লাজমা।”