সুরক্ষার অভাবের সঙ্গে রোগীদের তথ্য গোপন, ঝুঁকিতে স্বাস্থ্যকর্মীরা

অপ্রতুল সুরক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে থাকা দেশের চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা তথ্য গোপন করে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের সংস্পর্শে এসে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন।

ওবায়দুর মাসুম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 April 2020, 07:36 PM
Updated : 19 April 2020, 07:38 PM

বাংলাদেশে নতুন করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর এখন পর্যন্ত মারা গেছেন একজন চিকিৎসক। আক্রান্ত হয়েছেন শতাধিক এবং সংখ্যাটি দিন দিন বাড়ছে।

এ অবস্থায় স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে না পারলে এই মহামারী মোকাবেলা করা আরও কঠিন হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন–বিএমএর হিসাবে রোববার পর্যন্ত ১০৪ জন চিকিৎসক এবং নার্সসহ ১২০ জন স্বাস্থ্যকর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।

কোভিড-১৯ আক্রান্ত স্বাস্থ্যকর্মীরা কাদের সংস্পর্শে এসেছিলেন-এমন প্রশ্নে আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তা এখনও বোঝা যাচ্ছে না।

“আমরা ট্রেসিং করছি। তথ্য নিচ্ছি, একেকটা কেইস আসলে একেক রকম। কারও বোঝা যাচ্ছে, কারও বোঝা যাচ্ছে না। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে ঢাকা থেকে যাওয়া লোকদের মাধ্যমেই তারা সংক্রমিত হয়েছেন।”

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আক্রান্ত হয়েছেন কয়েকজন স্বাস্থ্যকর্মী।

এই হাসপাতালের একজন চিকিৎসক জানান, এক রোগী একটি বেসরকারি হাসপাতালে কোভিড-১৯ এর নমুনা পরীক্ষা করতে দিয়ে তা গোপন করেই ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হয়েছে। পরে কোভিড-১৯ রোগী সন্দেহ হলে ওই রোগীকে আরেক হাসপাতালে পাঠানো হলে পথেই মারা যান তিনি।

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক ওই চিকিৎসক বলেন, “পরে তারা জানতে পারলাম ওই রোগী করোনাভাইরাস পজেটিভ ছিল।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা (ফাইল ছবি)

“ওই বিষয়টি হাইড করার ফলে আমাদের পুরো ইউনিটটা কন্টামিনেটেড হয়ে গেল। রোগীরা তাদের হিস্ট্রি গোপন করছেন। জ্বর-গলাব্যথা, কাশি থাকলেও এসে বলছে, হার্টে সমস্যা। ভর্তির পর পরীক্ষা করে আমরা বুঝতে পারি, তার আসলে অন্য সমস্যা। কিন্তু এরই মধ্যে ক্ষতি না হওয়ার তা হয়ে গেল।”

এই ঘটনা ঘটেছে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালেও। সেখানেও মিথ্যা তথ্য দেওয়া এক রোগীর অস্ত্রোচারের পর এখন ২৩ জন চিকিৎসকসহ ৪২ জন স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত।

হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী মো. রশিদ উন নবী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মূলত ওই রোগীর মিথ্যা তথ্যের কারণেই ডাক্তাররা বেশি আক্রান্ত হয়েছেন। এখন সেটা একজনের কাছ থেকে অন্যজনে ছড়াচ্ছে।

“আর আমরাই বা কী করব, একজন রোগীর ইমার্জেন্সি অপারেশনের দরকার হলে তো অপারেশন করতে হবে, না হলে রাস্তায় মারা যাবে।”

স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা ব্যবস্থার ঘাটতিও তাদের আক্রান্ত করছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ নার্সেস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান জুয়েল।

তিনি বলেন, “এখন পর্যন্ত জেলা-উপজেলা পর্যায়ের অনেক নার্স সুরক্ষা উপকরণ পাননি। এ অবস্থায় তারা আক্রান্ত হচ্ছেন।

“আমরা নার্সরা আক্রান্ত হলে স্বাভাবিকভাবেই আরও অনেকে আক্রান্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। আপনি ভেন্টিলেটর দিবেন, কিন্তু সেটা চালাবে কে? এজন্য নার্সদের প্রয়োজনীয় সুরক্ষা নিশ্চিত করার দাবি জানাই।”

চিকিৎসকদের দেওয়া সুরক্ষা উপকরণের মান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন ঢাকা বাইরের একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন চিকিৎসক।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যে গাউন দিযেছে সেটা নন উভেন টিস্যু কাপড়ের। ওয়ানটাইম ইউজ এই গাউন লিকুইডকে প্রটেক্ট করতে পারে না।

“যথাযথ নিরাপত্তার জন্য তিন স্তরের মাস্ক দরকার। কিন্তু যেটা দিচ্ছে, সেটা দেখেই বোঝা যায় খারাপ মানের। এ ধরনের পরিস্থিতিতে কমপক্ষে লেভেল থ্রি স্ট্যান্ডার্ডের পিপিই দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু এখন দেওয়া হচ্ছে লেভেল টু- স্ট্যান্ডার্ডের।”

“সমস্যা হচ্ছে, এগুলো পরে আমাদের মধ্যে একটা ভ্রান্ত নিরাপত্তাবোধ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু আসলে তা আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না,” বলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই চিকিৎসক।

আওয়ামী লীগ সমর্থক চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসা পরিষদের সভাপতি ডা. ইকবাল আর্সলান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বলেন, শুরুতে পিপিইর মান খারাপ ছিল, প্রথমে যে মাস্ক দিয়েছিল, সেটা আসল এন৯৫ মাস্ক ছিল না। এ কারণে অনেকে আক্রান্ত হতে পারে বলে তার ধারণা।

যাদের সরবরাহ করার দায়িত্ব ছিল, তারা ‘কিছুটা দুর্নীতির আশ্রয়’ নিয়েছিল বলেও দাবি করেন সরকার সমর্থক চিকিৎসকদের এই নেতা।

তিনি বলেন, “যাদের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার ছিল, তারা তা সময়মতো নিতে পারেননি। এটাও আমি একটা বড় কারণ বলে মনে করি।”

ডা. আর্সলান বলেন, কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে সুরক্ষার ব্যবস্থা ভালো ছিল বলে সেখানে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মী কারও আক্রান্ত হওয়ার খবর তিনি পাননি।

“করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে কিন্তু এখনও কাউকে আক্রান্ত হতে দেখিনি। কিন্তু অন্যান্য হাসপাতালগুলোয় রোগীরা যেভাবে মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছে, তাতে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিদেশ থেকে এসেও বলেননি। এটা আমাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে।”

সঙ্কটের মধ্যেও চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসকরা

তার আশঙ্কা, স্বাস্থ্যকর্মীদের আক্রান্ত হওয়া ঠেকাতে না পারলে সঙ্কট আরও বাড়বে।

“অনেকে কোয়ারেন্টিনে চলে গেছেন। এভাবে সবাই আক্রান্ত হলে ডাক্তার খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ কারণে এদের সুরক্ষাটা খুবই জরুরি। তবে এখনও সময় পার হয়ে যায়নি। ঠিক করার সময় আছে।”

বিএমএর মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল চিকিৎসার ক্ষেত্রে সংক্রামক ব্যাধি আইন প্রয়োগের পরামর্শ দিচ্ছেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখানে (আইনে) বলা হয়েছে, মহামারী চলার সময় সব চিকিৎসক একসঙ্গে চিকিৎসা সেবা দিবেন না। স্বাস্থ্যকর্মীদের তিনটি ধাপে ভাগ হয়ে দায়িত্ব পালন করতে হবে। তারা সাতদিন করে দায়িত্ব পালন করবেন।

“প্রথম দলটি সাতদিন কাজ করার পর হোটেল চলে যাবেন। বাড়িতে গেলে তার পরিবার আক্রান্ত হবে, এভাবে কমিউনিটি আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। ১৪ দিন হোটেলে থাকবে। এর ফাঁকে বাকি দুই দল পর্যায়ক্রমে দায়িত্ব পালন করবে।”

এখন সাধারণ রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসা অনলাইনে বা টেলিফোনে দেওয়ার পরামর্শ দেন

এই পরিস্থিতি দেশের বেকার চিকিৎসকদের কাজে লাগানোর সুপারিশও করেন বিএমএ মহাসচিব।

স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তার বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, সরকার এক্ষেত্রে ‘সর্বোচ্চ ব্যবস্থা’ নিয়েছে।

“শুরুতে পিপিইর সঙ্কট থাকায় প্রয়োজন অনুযায়ী সরবরাহ করা যায়নি। তবে এখন কোনো সঙ্কট নেই। মার্চে আমরা দেওয়া শুরু করি। সে সময় সারাবিশ্বেই মাস্কসহ পিপিইর সঙ্কট ছিল। তবে এখন আর সঙ্কট নেই। এখন ঘাটতি নাই।”

এই সঙ্কট মোকাবেলায় আরও চিকিৎসক নেওয়ার বিষয়টিও ভাবছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, “আমরা চিন্তা করছি যারা অবসরে চলে গেছেন বা যারা চাকুরিতে নাই, তাদেরকে কিভাবে কাজে লাগানো যায়। নিয়মনীতির মধ্যে থেকে এটাও দেখা হবে। বিষয়টি নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ হয়েছে।”

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশে চিকিৎসকসহ প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন ৭৮ হাজার ৩০০ জন। এরমধ্যে চিকিৎসক পদে রয়েছেন ২৭ হাজার ৪০৯ জন।

বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিল, বিডিএমসির হিসাবে দেশে রেজিস্টার্ড নার্সের সংখ্যা ৫৬ হাজার ৭৩৪ জন।

বাংলাদেশের ১ হাজার ৫৮১ জন মানুষের জন্য ১ জন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক। প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য চিকিৎসক ৬ দশমিক ৩৩ জন। প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতায় চিকিৎসকের সংখ্যা ১ দশমিক ২৮ জন।

প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য মেডিকেল টেকনোলজিস্ট আছেন মাত্র শূন্য দশমিক ৩২ জন।