করোনাভাইরাস পরীক্ষায় উৎসাহী নয় বাংলাদেশের মানুষ?

আতঙ্ক ছড়ানো নভেল করোনাভাইরাস মহামারীতে রোগ পরীক্ষার অপ্রতুল ব্যবস্থা নিয়ে অনেকের উদ্বেগের মধ্যে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা দাবি করছেন, দেশে কোভিড-১৯ পরীক্ষার কেন্দ্র বাড়ানো হলেও রোগীর সাড়া মিলছে না।

জয়ন্ত সাহা নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 April 2020, 03:58 PM
Updated : 1 April 2020, 04:01 PM

চীনে প্রথম নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের দুই মাসের বেশি সময় পর গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম রোগী ধরা পড়ে; এরপর কোভিড-১৯ রোগের লক্ষণ নিয়ে অনেকে পরীক্ষা করতে চাইলেও পারছিলেন না বলে অসন্তোষ প্রকাশ করেন।

চীনের পর দক্ষিণ কোরিয়ায় এই রোগ ব্যাপক মাত্রায় ছড়ালেও তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে এই কারণে যে তারা ব্যাপক সংখ্যক রোগীকে পরীক্ষা করে কোভিড-১৯ আক্রান্তদের চিহ্নিত করে আলাদা করতে পেরেছিল, যা গবেষকরা বলছেন।

সন্দেহভাজন সব রোগীকে পরীক্ষার উপর জোর দিয়ে আসছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও; সংস্থার মহাপরিচালক তেদ্রোস আধানম গ্যাব্রিয়েসাস গত ১৬ মার্চও দেশগুলোর উদ্দেশে বলছিলেন, সন্দেহভাজন প্রতিটি রোগীকে পরীক্ষা করুন, যত বেশি সম্ভব, তত নমুনা পরীক্ষা করে আক্রান্তদের আলাদা করে ফেলুন।

কিন্তু বাংলাদেশে করোনাভাইরাস পরীক্ষার ক্ষেত্রে শুরু থেকেই ছিল ধীরগতি; প্রথমে শুধু রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে (আইইডিসিআর) এই পরীক্ষা চলছিল। অসন্তোষের মুখে পরীক্ষা কেন্দ্র বাড়িয়ে কয়েকদিন আগে ১০টি করা হয়েছে।

কিন্তু স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক দাবি করেছেন, পরীক্ষা কেন্দ্র সম্প্রসারণ করা হলেও সম্ভাব্য রোগীদের কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।

তিনি বুধবার কোভিড-১৯ পরিস্থিতি নিয়ে অনলাইন ব্রিফিংয়ে বলেন, “শুধু টেস্টিং ফ্যাসিলিটি থাকলেই তো চলবে না… জনগণকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গিয়ে পরীক্ষা করাতে হবে। জনগণ এগিয়ে আসুক, টেস্ট করুক।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক (ফাইল ছবি)

“আমি চাচ্ছি না, কোনো জনগণ টেস্টের বাইরে থাকুক। যারা সন্দেহজনক অবস্থায় আছেন তারা টেস্ট করুন, নিজেরা ভালো থাকুন এবং পরিবারকে সুরক্ষিত রাখুন। বেশি বেশি করে টেস্ট করুন, নিজেকে সুরক্ষা করুন এবং সমাজকে নিরাপদে রাখুন।”

সন্দেহভাজন রোগীদের তিনি আইইডিসিআরের হটলাইন নাম্বারে যোগাযোগ করে নমুনা সংগ্রহের আবেদন করতে বলেছেন।

ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, আইপিএইচ ও শিশু হাসপাতালে কোভিড-১৯ শনাক্তের পরীক্ষা চালু হয়েছে।

ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামের ফৌজদারহাটে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিকাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইইডিসিআরের ফিল্ড ল্যাবরেটরি ও ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও শুরু হয়েছে নমুনা পরীক্ষা।

আগামী দু-এক দিনের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও পরীক্ষা শুরু হবে।

ঢাকার বাইরে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে টেস্টিং ল্যাব স্থাপন করা হচ্ছে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, “পর্যায়ক্রমে প্রতিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে টেস্টিংয়ের ব্যবস্থা চালু করা হবে।”

তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমস শাখার পরিচালক হাবিবুর রহমানও বুধবার বলেন, “ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলো বলছে পর্যাপ্ত স্যাম্পল আসেনি। তার মানে রোগীদের মধ্যে আগ্রহ নেই পরীক্ষার।”

তিনি জানান, এ পর্যন্ত আইইডিসিআরের হটলাইন নাম্বারে ৮ লাখ ২ হাজার ৩৩টি কোভিড-১৯ সংক্রান্ত কল এসেছে।

আইইডিসিআর জানিয়েছে, তারা এ পর্যন্ত ১ হাজার ৭৫৯ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৫৪ জনের মধ্যে নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণ শনাক্ত করেছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোভিড-১৯ সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ঢাকার আইইডিসিআর, আইপিএইচ, শিশু হাসপাতাল, আইসিডিডিআর বি, আর্মড ফোর্সেস ইনস্টিটিউট অব প্যাথোলজিত ও চট্টগ্রামের বিআইটিএডিতে গত ২৪ ঘণ্টায় ১৫৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। 

নমুনা পরীক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকেও অনেক পিছিয়ে আছে।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, এই পর্যন্ত বাংলাদেশে যত রোগী ধরা পড়েছে, তার বেশিরভাগই বিদেশ ফেরত, আর তাদের মাধ্যমেই সংক্রমণ ঘটেছে অন্যদের।

শুরুতে আইইডিসিআর কেবল বিদেশ ফেরত ও তাদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের নমুনাই পরীক্ষা করছিল। পরে অবশ্য নমুনা পরীক্ষার আওতা বাড়ায়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে তথ্য বলছে, চীনে নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর ৬ লাখ ৬৫ হাজারের মতো বাংলাদেশি দেশে ফিরেছেন। তাদের সবাইকে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে বলা হলেও তা মানাতে হিমশিম খাচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন।

সরকারি কর্তাব্যক্তিরা রোগ পরীক্ষায় মানুষের আগ্রহ দেখতে না পাওয়ার কথা জানালেও তাতে দ্বিমত পোষণ করেন ফৌজদারহাটের বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিকাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেসের পরিচালক এম এ হাসান চৌধুরী।

ফৌজদারহাটের বিআইটিআইডিতেও হচ্ছে করোনাভাইরাসের পরীক্ষা

তিনি বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আজকেও চারজন পরীক্ষা করাতে এসেছেন। সব মিলিয়ে এখানে ৪২ জন রোগীর নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। তাদের মধ্যে আমরা আইসোলেশন ইউনিটে রেখেছি তিনজনকে। আউটডোরে রয়েছেন আরও ২৯ জন রোগী।”

কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইইডিসিআরের ফিল্ড ল্যাবরেটরির টিঅ্যান্ডটি নাম্বারে ফোন করলেও তারা সাড়া দেননি। এ বিষয়ে জানতে ঢাকার আইইডিসিআরের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা ও প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম আলমগীরকে ফোন করা হলেও তাদেরও সাড়া মেলেনি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. রফিকুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শাহবাগের পুরনো বেতার ভবনে বুধবার থেকে পিসিআর টেস্ট শুরু করেছেন তারা।

বিএসএমইউতে প্রথম দিনে চারজনের নমুনা পরীক্ষার পর ফলাফল আইইডিসিআরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ চিত্তরঞ্জন দেবনাথ জানিয়েছেন, তাদের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে কোভিড-১৯ পরীক্ষার ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে।

কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন ও আইদেশি নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও তৈরি আছে। 

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসিরউদ্দিন বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তাদের ভাইরোলজি বিভাগে নমুনা পরীক্ষা শুরু করতে যাচ্ছেন তারা।

পরীক্ষার জন্য কিটের কোনো সমস্যা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, “অত্যন্ত ব্যয়বহুল এই পরীক্ষা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে করা হবে। ডেঙ্গুর সময় যেভাবে বিনামূল্যে করেছিলাম এখনও সেভাবে হবে।”

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পিসিআর টেস্টের জন্য ইতোমধ্যে ৯২ হাজার টেস্ট কিট সংগ্রহ করেছে। বিভিন্ন পিসিআর সেন্টারে ২০ হাজার কিট বিতরণ করা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাতে এখনও ৭২ হাজার টেস্ট কিট রয়েছে।