করোনাভাইরাস: ঢাকা মেডিকেল-মিটফোর্ডে যে প্রস্তুতি দেখা গেল

বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক হয়ে দেখা দেওয়া নভেল করোনাভাইরাস বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়লে সেই পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দিতে হবে, তার প্রাথমিক প্রস্তুতি নেওয়ার কথা জানিয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও মিটফোর্ড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

কামাল হোসেন তালুকদারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 March 2020, 05:25 PM
Updated : 14 March 2020, 03:47 AM

দেশের সবচেয়ে বড় সরকারি হাসপাতাল ঢাকা মেডিকেলে শুক্রবার গিয়ে প্রস্তুতির নমুনাও দেখা গেছে। আর পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও প্রাথমিক প্রস্তুতি গ্রহণের কথা জানিয়েছেন।

সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের টিকেট কাউন্টারে গিয়ে দুইজন কর্মচারীকে দায়িত্বরত পাওয়া যায়।

করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী এসেছে কি না জানতে চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই একজন বলে উঠেন, “না, না করোনাভাইরাসের কোনো রোগী আসে নাই। আসলে সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়ে দেব কুর্মিটোলায়।”

জরুরি বিভাগের চিকিৎসককে দেখা যায় মাস্ক পরা। অ্যাপ্রোনের সঙ্গে হাতে গ্লাভস ও মাথায় টুপি পরে ছিলেন তিনি।

করোনাভাইরাস আক্রান্ত কেউ এসেছে কি না- জানতে চাইলে এই চিকিৎসক বলেন, “এখনো কোনো রোগী আসেনি। তবে ওই সব রোগী আসার সঙ্গে সঙ্গে তাকে কুর্মিটোলাসহ নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে পাঠিয়ে দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে।”

করোনাভাইরাস আক্রান্তের উপসর্গের মধ্যে জ্বর, হাঁচি-কাশি, গলাব্যথা, শ্বাসকষ্ট রয়েছে।

ঠাণ্ডা-জ্বরসহ এই ধরনের উপসর্গ নিয়ে যারা আসছেন তাদের কী করা হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ওই সব রোগী মেডিসিন ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।”

ঢাকা মেডিকেল হসপিটাল-২ অর্থাৎ নতুন ভবনে মেডিসিনের রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়।

ওই ভবনের ৭০১ নম্বর কক্ষে ঢুকে জ্বর-ঠাণ্ডার রোগীদের দেখতে পাওয়া যায়।

ওই ওয়ার্ডে কর্মরত একজন নার্স বলেন, এখানে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কোনো রোগী আসেনি।

করোনাভাইরাসের বিস্তার খুব বেশি হলে, রোগীর সংখ্যা সরকার নির্ধারিত চারটি হাসপাতাল ছাপিয়ে গেলে সেই পরিস্থিতি মোকাবেলায় ওই ভবনের নিচতলায় ‘একিউট মেডিসিন ওয়ার্ডটি’ প্রস্তুত রাখা হয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

জরুরি প্রয়োজনে করোনাভাইরাস আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়ার ১১টি শয্যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে ঢাকা মেডিকেলের মেডিসিনের একটি ওয়ার্ডে

ওয়ার্ডের দুই কক্ষে পাঁচটি ও ছয়টি করে মোট ১১টি বিছানা রয়েছে। কোনো রোগী না থাকলেও সেখানে একজন সেবিকা রয়েছেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এগারটি বিছানার মধ্যে একটি বিছানা সম্পূর্ণ আলাদা করে অক্সিজেনসহ যাবতীয় সাপোর্ট রাখা হয়েছে।

“হঠাৎ করে কোনো কারণে কোনোভাবে যদি অন্তত একজন রোগী আসে তাহলে তাকে যাতে আলাদা করে রেখে চিকিৎসা দেওয়া যায় সেজন্য এ ব্যবস্থা।”

জানুয়ারি থেকেই এ দুই কক্ষ প্রস্তুত রাখা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এখনও পর্যন্ত কাউকে এখানে আনা হয়নি।”

এর বাইরে ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগের ‘গ্রাউন্ড ফ্লোর’ আইসোলেশন ওয়ার্ড ঘোষণার প্রায় প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে বলে হাসপাতালের সহকারী পরিচালক আলাউদ্দিন আল আজাদ জানিয়েছেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। মেডিসিন বেইজড সকল চিকিৎসক-নার্স ও স্টাফদের পার্সনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট দেওয়া হয়েছে।”

আলাউদ্দিন আল আজাদ বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাভাইরাসকে মহামারী ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত মাত্র তিনজন রোগী পাওয়া গেছে। পাঁচটি হাসপাতালে আইসোলেশন ওয়ার্ড তৈরি করে রাখা হয়েছে।

“রোগীর সংখ্যা বাড়লে এবং ওই সব আইসোলেশন ওয়ার্ডে রোগী সংকুলান না হলে চাপ পড়বে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপর। সে বিষয়টি মাথায় রেখে প্রস্তুতি এবং চিকিৎসক, সেবিকাদের ওইভাবে প্রস্তুত রাখা হয়েছে।”

তবে এই হাসপাতালে করোনাভাইরাস আক্রান্তদের নেওয়া হলে তা অন্যান্য রোগীদের জন্য বড় ঝুঁকি হয়ে দেখা দেবে বলে মনে করছেন একজন চিকিৎসক।

ঢাকা মেডিকেলে সব ধরনের রোগীরা আসায় এবং ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত রোগী থাকায় এই হাসপাতালে করোনাভাইরাস আক্রান্তরা এলে রোগটি অনেকের মধ্যে সংক্রমণের ঝুঁকি থাকবে বলে মনে করছেন একজন চিকিৎসক

নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঢাকা মেডিকেল একটি জেনারেল হাসপাতাল, এখানে সব ধরনের সমস্যা নিয়ে রোগীরা আসে। সারা দেশ থেকে দরিদ্র রোগী যাদের সমস্যা প্রকট হয় তারা এখানে আসে। এখন করোনাভাইরাস যে ধরনের সংক্রামক রোগ তাতে এই রোগে আক্রান্তদের এখানে রাখা হলে রোগটি অন্যদের মধ্যে ছড়ানোর প্রবল ঝুঁকি থাকবে।”   

এছাড়া এখনও হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য কর্মীদের পারসোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্টের ঘাটতি রয়েছে বলে জানান তিনি।

হাসপাতালের সহকারী পরিচালক আলাউদ্দিন আল আজাদ জানান, কে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত, কে আক্রান্ত না তা প্রাথমিকভাবে বোঝার উপায় নেই। তাই শনিবার থেকে বহির্বিভাগে ঠাণ্ডা-জ্বর, কাশির রোগীদের আলাদাভাবে চিকিৎসা দেওয়া হবে।

দুইজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, দুইজন শিশু বিশেষজ্ঞ ও একজন নাক-কান- গলার মোট পাঁচজন চিকিৎসক এই রোগীদের চিকিৎসা দেবেন।

তাদের জন্য আলাদা টিকেট কাউন্টার থাকবে জানিয়ে তিনি বলেন,“ এতে করোনাভাইরাসের ফার্স্ট স্ক্রিনিংটা হয়ে যাবে। করোনাভাইরাসের রোগের চিকিৎসা দেওয়ার সময় চিকিৎসক, সেবিকাসহ অন্যরা যে ধরনের পোশাক পরে থাকেন এখানেও ওই ধরনের পোশাক পরে ডিউটি দেওয়া হবে।”

ঢাকা মেডিকেলে সম্প্রতি নিউমোনিয়ার লক্ষণ নিয়ে আসা রোগীর সংখ্যা বেড়েছে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মেডিসিনের ৬০১ নম্বর ওয়ার্ডের রেজিস্ট্রার ইমরান মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ ধরনের রোগীদের এখানে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আবার সন্দেহ হলে কাউকে কাউকে কুর্মিটোলায় পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

“এদের কারও কারও করোনাভাইরাসের পরীক্ষা করা হলে ভালো হত। কেউ আক্রান্ত থাকলে তার থেকে রোগটি ছড়ানোর ঝুঁকি কমিয়ে আনা যেত। তবে ঢাকা মেডিকেলে তো এখনও পরীক্ষার সুযোগ নেই।” 

২৬০০ শয্যার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগী ভর্তি থাকে পাঁচ হাজারের মতো। তাদের সেবায় নার্স আছেন দুই হাজার একশ, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ২০০ এবং দৈনিক মজুরিতে কাজ করেন ২৪৭ জন।

চিকিৎসক কতজন আছেন জানতে চাইলে সহকারী পরিচালক আলাউদ্দিন বলেন, “ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসকের কোনো অভাব নেই, অভাব শুধু চতুর্থ-তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর।

“ঢাকা মেডিকেল কলেজের অনেক সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক হাসপাতালে রোগীদের সেবা দেন। এছাড়া অনারারি চিকিৎসকরা সেবা দেন।”

তাই পরিস্থিতি জটিলতার দিকে গেলেও সব কিছু সামাল দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হবে বলে আশাবাদী তিনি।

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও করোনাভাইরাস আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোরশেদ রশিদ জানিয়েছেন।

করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের জন্য কেবিন বরাদ্দ রাখার কথা জানিয়েছে পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ

দুপুরে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এই ধরনের রোগীদের সামাল দেওয়ার জন্য প্রশাসনিক ভবনের ১১তলায় পাঁচটি কেবিন রাখা হয়েছে। এছাড়া জরুরি বিভাগে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, উচ্চ তাপমাত্রা বা করোনাভাইরাসের উপসর্গ মনে হলে আইসোলেটেড করে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে ফোন দেওয়ার জন্য।
নার্সদের ১০ জনের একেকটি দল গঠন করে তাদের এই বিষয়ে সচেতনতামূলক ‘ব্রিফ’ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী এই হাসপাতালে আসতে শুরু করলে কোন কোন ডাক্তার ও নার্স তাদের তত্ত্বাবধান করবে, সে বিষয়েও প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে বলে জানান পরিচালক।

নয়শ শয্যার এই হাসপাতালে চিকিৎসকদের পাশাপাশি চার শতাধিক নার্স এবং চার শতাধিক চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী রয়েছে। শুক্রবার হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন ৯৫২ জন রোগী।