মাস্ক-স্যানিটাইজার নিয়ে ‘অহেতুক’ হুড়োহুড়ি

বাংলাদেশে নভেল করোনাভাইরাসের প্রথম রোগী ধরা পড়ার পর মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও হেক্সাসলের মতো সামগ্রী কিনতে ক্রেতারা বাজারে হুমড়ি খেয়ে পড়লেও তা অহেতুক বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

ফয়সাল আতিক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 March 2020, 07:45 PM
Updated : 9 March 2020, 07:45 PM

তারা বলছেন, আক্রান্ত না হলে মাস্ক ব্যবহারের যেমন প্রয়োজন নেই; তেমনি হাত পরিষ্কার রাখতে সাবানই যথেষ্ট।

রোববার আইইডিসিআর বাংলাদেশে প্রথম রোগী শনাক্তের কথা জানানোর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রাজধানীর বাজার থেকে প্রায় উধাও হয়ে যায় হ্যান্ড স্যানিটাইজার। ফুটপাতে স্বল্প পরিমাণে মাস্ক কিনতে পাওয়া গেলেও এর দাম হাঁকা হচ্ছিল আগের কয়েকগুণ বেশি।

দোকানিরা বলছেন, আকস্মিকভাবে ক্রেতাদের এমন হুমড়ি খেয়ে পড়ার ফলে বাজারে এসব সামগ্রির শূন্যতা দেখা দেয়।

কাঁঠাল বাগান এলাকার বাসিন্দা অ্যাননা নিউমিলিস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সোমবার দিনভর তিনি ওই এলাকার অনেকগুলো ওষুধের দোকান ঘুরে হেক্সাসল খুঁজে পাননি। সন্ধ্যায় গ্রিনলাইফ ফার্মা নামের একটি দোকানে গিয়ে তা পান।

১৩০ খুচরা মূল্যের হেক্সাসল আড়াইশ টাকায় কিনেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, কেনার মূল্য বেশি পড়েছে বলে অজুহাত ছিল দোকানির।

অন্যদিকে ২০ থেকে ২৫ টাকা দামের মাস্কের দাম বেড়ে বিক্রি হয় একশ থেকে দেড়শ টাকায়।

বাংলাদেশে করোনাভাইরা শনাক্তের পর ঢাকায় ছোট বড় অনেকের মুখেই এখন মাস্ক। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

সোমবার দুপুর ১২টার দিকে মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বরের কাছে সদ্য কেনা এন৯৫ মাস্ক মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় আকলিমা নামের এক নারীকে।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কুরিয়ার সার্ভিস গলির ১০টি ফার্মেসি ঘুরে ছোট একটি দোকানে কয়েকটি মাস্ক পান তিনি। দাম রাখে ৯০ টাকা করে। তবে হেক্সাসল কিংবা স্যানিটাইজার তিনি পানি।

দোকানি মনিরুজ্জামান বলেন, “সরবরাহকারীদের কাছে মাস্ক পাওয়া যাচ্ছে না। দামও অনেক বেড়ে গেছে। আগে যেই মাস্ক ২৫ টাকা থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি করতাম, সেটা এখন কিনতে হচ্ছে ৭০ টাকায়।

“আজকে আমরা ৯০ টাকায় বিক্রি করলেও ফুটপাথেই নাকি আরও নিম্নমানের মাস্ক একশ দেড়শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।”

এদিন মিরপুর ছাড়াও গুলিস্তান, প্রেস ক্লাব, মহাখালী এলাকায় চীনের এন৯৫ মাস্কের আদলে দেশে তৈরি কিছু মাস্ক বিক্রি হয়েছে দেড়শ টাকায়।

সকালে মিরপুরের ৬০ ফিট সড়কে কয়েকটি দোকানে গিয়ে জীবাণুমুক্তকরার কাজে ব্যবহৃত হেক্সাসল কিংবা হ্যান্ড স্যানিটাইজারের পাওয়া যায়নি।

একাত্তর ফার্মেসির নুরুল ইসলাম বলেন, গত দুই সপ্তাহ ধরে এই এলাকায় হ্যান্ড স্যানিটাইজারের কোনো সরবরাহ নেই। ৩/৪টি হেক্সাসল ছিল, যা গতরাতেই মুহূর্তের মধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে।

“আমরা অর্ডার দিয়ে রেখেছি। সম্ভব হলে কোম্পানি এই দিকে পাঠাবে,” বলেন তিনি।

মিরপুর ১০ নম্বর এলাকায় আয়েশা ফার্মেসি, মির ফার্মা, ফার্মা প্যালেস নামের ফার্মাসিগুলোতেও একই চিত্র দেখা গেছে।

আয়েশা ফার্মেসির বিক্রয়কর্মী ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, সাধারণত দিনে দুই থেকে তিন পিস হেক্সাসল বিক্রি হত। গতকালই শত শত মানুষ হেক্সাসল কিনতে এসেছে। মুহূর্তের মধ্যে সব শেষ হয়ে গেছে।

“এত মানুষের এই চাহিদা পূরণ করা মোটেও সম্ভব হয়। কোম্পানি এগুলোর আর সপ্লাই দিতে পারতেছে না। আমরা কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করেছি, তারা আশ্বাস দিতে পারছে না।”

ফার্মা প্যালেসের ব্যবস্থাপক শাহাদাত বলেন, মাস্ক, হেক্সাসল কিংবা হ্যান্ড স্যানিটাইজার কোনো পণ্যেরই জোগান নেই। সর্বত্র একটা নাই নাই অবস্থা।

“হেক্সাসল বলেন আর স্যানিটাইজার বলেন, এগুলো মাসে ৫০ পিস বিক্রি হত না। এখন দৈনিক ৫০০ পিস আনলেও বিক্রি করে শেষ করা যাবে না।”

স্কুলে থেকে বের হবার পর পরই হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে সন্তানের হাত ধুয়ে দিচ্ছেন এক ব্যক্তি। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

হাই কোর্ট ইতোমধ্যে এই ধরনের পণ্যের দাম বৃদ্ধি ও মজুদ ঠেকাতে তৎপর থাকতে বলেছে সরকারকে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর এরপর এসব পণ্যের দাম বেঁধে দিয়ে অতিরিক্ত দাম নিলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে।

মাস্ক ও স্যানিটাইজার নিয়ে হুড়োহুড়ি চললেও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভিন্ন কথা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাক্তার আবুল কালাম আজাদ সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, হাত পরিস্কার ও জীবণুমুক্ত রাখার ক্ষেত্রে সাবান সবচেয়ে উত্তম পন্থা। অযথা স্যানিটাইজার কিনে টাকা খরচ করার দরকার নেই।

মাস্কের ব্যবহার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “এই যে আমরা এখানে বসে এতগুলো লোক সংবাদ সম্মেলন করছি, আমরা কিন্তু মাস্ক পরিনি।

“কাদের মাস্ক ব্যবহার করার প্রয়োজন হবে আমরা সেকথা বলে দেবো। যাদের দরকার হবে তারা যেন পায় আমরা সেই ব্যবস্থাও করব। এখন অকারণে প্রত্যেক মানুষের মাস্ক ব্যবহার করার দরকার নেই। যাদের দরকরার নেই, তারা অযথা মাস্ক ব্যবহার করবেন না।”

এক্ষেত্রে শিষ্টাচার মেনে হাঁচি-কাশি দেওয়া, হ্যান্ডশেক পরিহার করা, আপতত গণসমাবেশ পরিহার করার আহ্বান জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও মাস্ক ও স্যানিটাইজার কেনার হুড়োহুড়ি অহেতুক বলে তা না করার আহ্বান জানিয়েছেন।

নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব নিয়ে সোমবার আইইডিসিআরের সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

এদিকে বাংলাদেশে মাস্কের মজুদের খবর নিতে গিয়ে জানা যায়, এই বাজার অনেকটাই চীননির্ভর।

পুরান ঢাকার মিটফোর্ডের কন্টিনেন্টাল সার্জিক্যাল হাউজের পরিচালক শরীফ উদ্দিন আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কিন্তু কিছুদিন আগে চীনারাই বাংলাদেশ থেকে মাস্ক আমদানি করে নিয়ে গেছে। আমদানিকারদের কাছে খুব বেশি মজুদ নেই। এখন চাহিদা মেটানোর জন্য দেশীয় উৎপাদনের উপরেই নির্ভর করতে হবে।”

বাংলাদেশে ৩/৪টি প্রতিষ্ঠান মাস্ক উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত হলেও তারাও এইক্ষেত্রে বিদেশি কাচমাল নির্ভরশীল বলে জানান তিনি।

দেশের সবচেয়ে বড় মাস্ক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান প্রাণ আরএফএল গ্রুপের মার্কেটিং বিভাগের পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিশ্বব্যাপী মাস্কের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে তাদের গেটওয়েল ব্র্যান্ডের মাস্ক উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে।

“আগে যেখানে দৈনিক ১৫ হাজার পিস তৈরি হত, সেখানে এখন শিফট বাড়িয়ে দৈনিক ৫০ হাজার পিস করা হয়েছে। কারখানা থেকে এখন ৫০ পিসের প্যাকেট আড়াইশ টাকা দরে বাজারে যাচ্ছে।”

বাজারে হেক্সাসলের বড় একটি জোগান দিয়ে যাচ্ছে এসিআই ফার্মা।

এসিআই কনজ্যুমার ব্র্যান্ডের মার্কেটিং বিভাগের পরিচালক সৈয়দ আলমগীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সাধারণ মানুষের মধ্যে প্যানিক তৈরি হওয়ার কারণে বাজারে হেক্সাসলসহ এধরনের পণ্যগুলোর সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এক্ষেত্রে প্যানিকড হওয়া যাবে না। যার যতটুকু প্রয়োজন রয়ে সয়ে ততটুকু কিনতে হবে।”

“সবাইকে মনে রাখতে হবে যে চাহিদার কথা বিবেচনা করে পণ্যের জোগান বাড়ানো হচ্ছে। ফলে বাজারে পর্যাপ্ত পণ্য পাওয়া যাবে,” আশ্বস্ত করেন তিনি।