করোনাভাইরাস: কোনটি গুজব, কোনটি ঠিক

প্রাণঘাতী নতুন করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্কের প্রভাব পড়েছে মানুষের জীবনযাত্রার পাশাপাশি অর্থনীতি-বাণিজ্য ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগে। আতঙ্কের সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে গুজব। সংক্রামক এই রোগ কী থেকে ছড়ায়, কীভাবে এর নিরাময় সম্ভব- সেসব বিষয়ে এমন সব তথ্য মানুষের মুখে মুখে আর সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ঘুরছে, যা সঠিক বলে প্রমাণিত হয়নি।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Feb 2020, 04:16 PM
Updated : 6 March 2020, 05:23 PM

নভেল করোনাভাইরাস বা ২০১৯-এনসিওভি নিয়ে মানুষের অমূলক ধারণাগুলো ভাঙতে প্রশ্নোত্তরের আকারে সঠিক তথ্যগুলো জানানো হয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ওয়েবসাইটে।

চীন থেকে আসা চিঠিপত্র ও প্যাকেট নেওয়া কি নিরাপদ?

এর মধ্যে কোনো ঝুঁকি নেই। চীন থেকে আসা খাম, চিঠিপত্র বা মোড়কে আসা সামগ্রী ধরলে নতুন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আগের অভিজ্ঞতায় বিজ্ঞানীরা দেখেন, খাম, চিঠি বা মোড়কের মত বস্তুর ওপর করোনাভাইরাস খুব বেশি সময় বাঁচতে পারে না।

পোষা প্রাণী থেকে করোনাভাইরাস ছড়াতে পারে?

বাড়িতে কুকুর-বিড়াল পোষেন অনেকেই। এ ধরনের প্রাণীর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার কোনো প্রমাণ গবেষকরা এখনও পাননি। তবে পোষাপ্রাণীর সংস্পর্শে আসার পর অবশ্যই সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধুয়ে নিতে হবে। তাতে পোষা প্রাণী থেকে মানুষের শরীরে ই-কোলাই ও সালমোনেলা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ রোধ করা সহজ হবে। 

নিউমোনিয়ার টিকা নিলে করোনাভাইরাস থেকে বাঁচা যাবে?

না। নিউমোনিয়ার জন্য ব্যবহৃত নিউমোককাল ভ্যাকসিন বা হেমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জার বি (এইচআইবি) টাইপের টিকা করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষা দেয় না। তবে শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন অসুখ থেকে সুরক্ষায় জন্য টিকা নেওয়া জরুরি।

নভেল করোনাভাইরাস একটি নতুন এবং আলাদা ধরনের ভাইরাস এবং এর জন্য নতুন করেই প্রতিষেধক তৈরি করতে হবে।

লবণ পানি বা স্যালাইনে নিয়মিত নাক ধুলে নতুন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়ানো যাবে?

না, করোনাভাইরাসে এর কার্যকারিতার কোনো প্রমাণ বিশেষজ্ঞরা পাননি।

স্যালাইন বা লবণ পানিতে বার বার  নাক ধুয়ে কারও কারও সর্দি থেকে দ্রুত মুক্তি মেলার খবর তারা শুনেছেন। কিন্তু এ পদ্ধতি শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা দেবে- এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। 

মাউথওয়াশ দিয়ে কুলকুচি করলে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকানো যাবে?

কিছু ব্র্যান্ডের মাউথওয়াশ মুখের লালায় থাকা রোগজীবাণু দূর করতে পারে। তবে তা কার্যকর থাকে খুব সামান্য সময়ের জন্য। আর মাউথওয়াশে কুলকুচি করে ২০১৯-এনসিওভির সংক্রমণ রোধ করা যাবে না। অন্তত তেমন কোনো প্রমাণ এখনও গবেষকরা পাননি।

রসুন খেলে করোনাভাইরাস সেরে যাবে?

রোগ-বালাই থেকে সুরক্ষা দেওয়ার কিছু গুণ রসুনের মধ্যে আছে। তবে রসুন খেয়ে নতুন এই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কেউ ভালো হয়ে গেছেন- এমন প্রমাণ এখনও বিজ্ঞানীরা পাননি।  

গায়ে তিলের তেল মাখলে সুরক্ষা মিলবে?

একেবারেই না। তিলের তেল নতুন করোনাভাইরাসকে প্রতিরোধ করতে পারে না।

ব্লিচ, ক্লোরিন থেকে বানানো সংক্রমণ নিবারক, ৭৫ শতাংশ ইথানল, প্যারাসেটিক এসিড ও ক্লোরোফর্মের মত কিছু রাসায়নিক কোনো কিছুর গায়ে লেগে থাকা নভেল করোনাভাইরাস ধ্বংস করতে পারে।   

তবে এসব রাসায়নিক গায়ে মেখে থাকলে কিংবা নাকের নিচে লাগালে নতুন করোনাভাইরাসের পরাস্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই, বরং তাতে ক্ষতিও হতে পারে।

নতুন করোনাভাইরাস কী কেবল বয়স্কদের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ?

যে কোনো বয়সী মানুষ নতুন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। তবে বয়স্ক ব্যক্তি ও যাদের অ্যাজমা, ডায়বেটিস, হৃদযন্ত্রের রোগ রয়েছে, তাদের ঝুঁকি বেশি।

ডব্লিউএইচও বলছে, নিরাপদ থাকার জন্য সব বয়সী মানুষকেই বারবার হাত ধুতে হবে এবং শ্বাসতন্ত্রকে নিরোগ রাখতে হবে।

নতুন করোনাভাইরাসে অ্যান্টিবায়োটিক সুফল দেবে?

না। অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করে ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে। ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে এর কোনো ভূমিকা নেই।

নভেল করোনাভাইরাসও এক ধরনের ভাইরাস এবং এর চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক কোনো কাজে দেবে না।

তবে ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণও ঘটতে পারে। এ ধরনের রোগীকে হাসপাতালে অনেক সময় অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। 

করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় কোনো বিশেষ ওষুধ কি আছে?

নতুন করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোনো ওষুধ চিকিৎসকদের জানা নেই।

আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে যেসব উপসর্গ দেখা দেয়, সাধারণভাবে সেগুলো সারানোর জন্যই চিকিৎসা দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। অবস্থা গুরুতর হলে নেওয়া হচ্ছে বিশেষ ব্যবস্থা।

কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে এখন গবেষণা চলছে। তবে সেগুলো তবে রোগীর ওপর ব্যবহারের আগে অনেক ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হবে, সেই পদ্ধতি কতটা কার্যকর, কতটা নিরাপদ- সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে।

শীত বা তুষারপাতে নতুন করোনাভাইরাস মরে যায়?

সাধারণ আবহওয়ায় মানুষের শরীরের তাপমাত্রা সাড়ে ৩৬ ডি্গ্রি থেকে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়ামের মধ্যে ওঠানামা করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ঠাণ্ডা আবহাওয়া নতুন করোনভাইরাস বা অন্য কোনো রোগ-জীবাণুকে মেরে ফেলতে সক্ষম তা বিশ্বাস করার মত কোনো কারণই নেই।

 

উষ্ণজলে স্নান করলে করোনাভাইরাস থেকে সেরে ওঠা যায়?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, অতিরিক্ত গরম পানিতে গোসল করাটা কারো কারো জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। গরম পানিতে গোসল করলেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষ সেরে উঠবেন এমন মনে করার কারণ নেই। তার চেয়ে হাত ধোয়ার ওপেরই গুরুত্ব দিচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। হাতে থাকা ভাইরাস পানিতে সাফ হলে নাক-মুখ বা শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমণের ঝুঁকি কমে যাবে।

 

চীনা পণ্য ব্যবহারে ঝুঁকি আছে?

কোনো বস্তুর গায়ে এই ভাইরাস পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। সুতরাং কোনো পণ্য বা মোড়কজাত পণ্যের গায়ে ভাইরাস লেগে থাকলে তা মানুষকে আক্রান্ত করবে কি না তা নির্ভর করবে স্থান ও তাপমাত্রার ওপর। সময় ও দূরত্ব যত বাড়বে ঝুঁকি তত কমবে। তবে সন্দেহ থাকলে জীবাণুমুক্ত করে তারপর সেই পণ্য ধরাই নিরাপদ হবে। পরে অবশ্যই হাত ধুয়ে নিতে হবে।       

 

মশার কামড়ে নতুন কোরোনাভাইরাস ছড়ায়?

মশার কামড়ে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে এমন কোনো তথ্য-উপাত্ত ডব্লিউএইচও কোথাও পায়নি। নতুন করোনাভা্ইরাস শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমণ ঘটায়, যা সাধারণত হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ছড়াতে পারে। সেজন্য ঠাণ্ডা-কাশিতে ভুগছেন এমন কারো সংস্পর্শ এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।

 

ড্রায়ারে হাত শুকালে নতুন করোনাভাইরাস মরে যায়?

একেবারেই না। ডব্লিউএইচও বলছে, হাত শুকানোর যন্ত্র নভেল করোনাভাইরাস দমনে কার্যকর নয়। এরচেয়ে সাবান-পানি বা অ্যালকোহলযুক্ত স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধুয়ে পরে টিস্যু অথবা হ্যান্ড ড্রায়ার দিয়ে হাত শুকিয়ে নিলে তা সংক্রমণ ঠেকাতে বেশি কার্যযকর হবে।

আলট্রাভায়োলেট রশ্মি ব্যবহারে নতুন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানো যাবে?

ডব্লিউএইচও হুঁশিয়ার করে বলেছে, কোনো ধরনের অতিবেগুনী রশ্মি যেন মানুষের ত্বকের ওপর ব্যবহার করা না হয়; এ ধরনের রশ্মি চামড়ার ক্ষতি করতে পারে।

 

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কি না বুঝতে থার্মাল স্ক্যানার কতটা কার্যকর?

শরীরে স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে বেশি তাপমাত্রা থাকলে তা সহজেই ধরা পড়ে থার্মাল স্ক্যানারে।

তবে জ্বর না হলে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কাউকে থার্মাল স্ক্যানারে নির্ণয় করা যায় না। আর নতুন করোনাভাইরাস শরীরে ঢোকার পর দুই থেকে ১০ দিন লাগে জ্বর বা অন্য উপসর্গ দেখা দিতে।