বুধবার রাজধানীতে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ভবনের সভাকক্ষে ‘ট্রান্স ফ্যাট ও হৃদরোগ ঝুঁকি এবং গণমাধ্যমের করণীয়’ শীর্ষক কর্মশালায় বলা হয়, বাংলাদেশে প্রতিবছর ২ লাখ ৭৭ হাজার মানুষ হৃদরোগের কারণে মারা যায়।
বিশ্বে এই সংখ্যা এক কোটি ৭৯ লাখ, যার মধ্যে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষ শিল্পোৎপাদিত ট্রান্স ফ্যাট গ্রহণের কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথের সহযোগী বিজ্ঞানী আবু আহমেদ শামীম বলেন, “ট্রান্স ফ্যাট এক ধরনের অসম্পৃক্ত চর্বি, যা ডালডা কিংবা বনস্পতি ঘি নামে আমাদের দেশে পরিচিত। এতে ২৫-৪৫ শতাংশ পর্যন্ত ট্রান্স ফ্যাট থাকে।”
উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “খাদ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো খাবার সংরক্ষণের সুবিধার্থে এবং বিভিন্ন ভাজা পোড়া ও বেকারি খাদ্য পণ্যের স্বাদ, ঘ্রাণ ও স্থায়িত্ব বাড়ানোর জন্য আংশিক হাইড্রোজেনেটেড তেল ব্যবহার করে থাকে। এছাড়া ভাজা পোড়া খাদ্যে একই ভোজ্য তেল উচ্চ তাপমাত্রায় বারবার ব্যবহারের কারণেও খাদ্যে স্বল্পমাত্রায় ট্রান্স ফ্যাট সৃষ্টি হয়।”
ঢাকার স্থানীয় বাজার থেকে দৈবচয়নের ভিত্তিতে সংগ্রহ করা ১২ ধরনের বেকারি বিস্কুট নিয়ে পরিচালিত এক গবেষণায় নমুনা বিস্কুটগুলোতে ৫ শতাংশ থেকে ৩৯ শতাংশ পর্যন্ত ট্রান্স ফ্যাটের উপস্থিতি পাওয়া যায় বলে কর্মশালায় বলা হয়।
এই পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশকৃত মাত্রার চেয়ে (মোট ফ্যাটের ২% এর কম) অনেক বেশি বলে জানান আবু আহমেদ শামীম।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ট্রান্স ফ্যাট প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর ডা. শেখ মো. মাহবুবুস সোবহান বলেন, ট্রান্স ফ্যাটযুক্ত খাবারের কারণে স্ট্রোক এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
“উচ্চমাত্রায় ট্রান্স ফ্যাট গ্রহণের কারণে সার্বিকভাবে মৃত্যুঝুঁকি ৩৪ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ২১ শতাংশ এবং হৃদরোগজনিত মৃত্যুঝুঁকি ২৮ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।”
মুহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০২৩ সালের মধ্যে টিএফএ’র ব্যবহার নির্মূল অর্থাৎ ২ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
“এটি একইসাথে ২০৩০ সালের মধ্যে অসংক্রামক রোগজনিত অকাল মৃত্যু এক-তৃতীয়াংশে কমিয়ে আনার মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।”
কর্মশালায় বলা হয়, বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে ডেনমার্ক ২০০৩ সালে আইন করে খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্স ফ্যাটের সর্বোচ্চ সীমা মোট ফ্যাটের ২ শতাংশ নির্ধারণ করে।
অস্ট্রিয়া, নরওয়ে, দক্ষিণ আফ্রিকা, থাইল্যান্ড, ইরান, ভারতসহ মোট ২৮টি দেশে খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্স ফ্যাটের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ কার্যকর করায় এসব দেশে ইতোমধ্যে শিল্পোৎপাদিত খাদ্যে ট্রান্স ফ্যাটের পরিমাণ ব্যাপক হারে হ্রাস পেয়েছে।
এছাড়া আরও ২৪টি দেশ ট্রান্স ফ্যাট নিয়ন্ত্রণ বাধ্যতামূলক করেছে, যা আগামী দুই বছরের মধ্যে কার্যকর হবে বলেও বক্তারা জানান।
থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা ট্রান্স ফ্যাটের প্রধান উৎস অসম্পৃক্ত চর্বির উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে।
ভারতে ২০১১ সাল থেকে তেল ও ডালডা জাতীয় পণ্যে ট্রান্স ফ্যাটের মাত্রা সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করা হয় এবং ২০১৫ সালে এটি ৫ শতাংশে কমিয়ে আনা হয়।
২০১৮ সালে ভারতের ফুড সেফটি অ্যান্ড স্টান্ডার্ডস অথরিটি ২০২২ সালের মধ্যে ট্রান্স ফ্যাটের সর্বোচ্চ মাত্রা ২ শতাংশে কমিয়ে আনার পাশাপাশি খাবারে শিল্পোৎপাদিত ট্রান্স ফ্যাট পরিহার করার ঘোষণাও দিয়েছে।
বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো আইন বা উদ্যোগ না থাকায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন তারা।
কর্মশালায় আরও বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টারস ফোরামের সভাপতি তৌফিক মারুফ, অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া অ্যালায়েন্সের (আত্মা) যুগ্ম আহ্বায়ক মিজান চৌধুরী, গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটর’র বাংলাদেশের কান্ট্রি কো-অর্ডিনেটর মুহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস এবং প্রজ্ঞা’র নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের।