গণমাধ্যমে সব ‘সঠিকভাবে’ আসছে না: স্বাস্থ্যের ডিজি

ডেঙ্গুর প্রকোপের প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যমে সব তথ্য সঠিকভাবে আসছে না দাবি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞ বি এন নাগপালের বক্তব্যও ভুলভাবে এসেছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 August 2019, 03:54 PM
Updated : 8 August 2019, 06:44 PM

বৃহস্পতিবার ঢাকায় দৈনিক যুগান্তর কার্যালয়ে আয়োজিত ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ ও সচেতনতায় করণীয়’ শিরোনামের এক গোলটেবিল আলোচনায় তিনি একথা বলেন।

ডেঙ্গু জ্বরে হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হওয়ায় আতঙ্কের মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার  দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ কীটতত্ত্ববিদ নাগপাল গত গত ৫ অগাস্ট স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে এসেছিলেন।

ডেঙ্গুর বাহক এইডিশ মশার জীবনাচরণের দিকটি তুলে ধরে তিনি সকাল ও সন্ধ্যায় ঘরে অ্যারোসেল স্প্রে করার পরামর্শ দিয়েছিলেন, যা গণমাধ্যমে এসেছিল।

এই গোলটেবিল আলোচনায় কীটতত্ত্ববিদ মঞ্জুর চৌধুরী বলেন, “নাগপাল যেসব পরামর্শ দিয়ে গেছেন, আমরা তার সাথে একমত নই। তিনি আমাদের মিসলিডিং তথ্য দিয়ে চলে গেছেন।”

তখন আবুল কালাম আজাদ বলেন, “তিনি (নাগপাল) বলেছিলেন, প্রতি সপ্তাহে এক ঘণ্টা করে ওষুধ দিতে। কিন্তু গণমাধ্যমে খবর এসেছে, প্রতি দিন ওষুধ ছিটানোর কথা।”

“তাহলে তো আর কোনো কাজ করতে হবে না, শুধু মশা মারতে হবে,” বলেন তিনি।

এই প্রসঙ্গ ধরে ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, “আমরা (চিকিৎসকরা) যা বলি, তা সঠিকভাবে গণমাধ্যমে আসে না সবসময়। এতে সম্পর্কের অবনতি হয়, ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়।”

‘হিসাব করলে চিকিৎসা দেওয়া যাবে না’

এবার ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবের সঙ্গে গণমাধ্যমের পরিসংখ্যানের ফারাক দেখা দিয়েছে।

গোলটেবিলে এ বিষয়ে নিজেদের পরিসংখ্যানের পক্ষে যুক্তি দেখানোর এক পর্যায়ে আবুল কালাম আজাদ বলেন, “আউটডোরে রোগীর হিসাব করতে গেলে আর চিকিৎসা দেওয়া হবে না। আরও বেশি রোগী মারা যাবে।”

ডেঙ্গু রোগী নিয়ে পরিসংখ্যান রাখতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আট সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি আছে। রোগের লক্ষণ, ধরন পরীক্ষার পর তারা নিশ্চিত করছেন, কতজন রোগী ডেঙ্গুতে সত্যিকারে আক্রান্ত হয়েছেন বা মারা গেছেন।

আবুল কালাম বলেন, “হাই লেভেলে পরীক্ষা করতে গেলে তো আমাকে উপজেলা পর্যায়ে মেশিন পাঠাতে হবে, যেটা এখন আইইডিসিআরে আছে। সঠিকভাবে কারণ নির্ণয় করা দরকার। সে কি ডেঙ্গুতে মারা গেছে, নাকি অন্য কোনো কারণে মারা গেছে।“

তাদের হিসাবে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা ২৯; কিন্তু গণমাধ্যমে শতাধিক মৃত্যুর খবর এসেছে, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমও চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে ৯১ জনের মৃত্যুর কথা নিশ্চিত হয়েছে।

আবুল কালাম আজাদ বলেন, “যতক্ষণ পর্যন্ত আইইডিসিআর বলবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত হাসপাতালগুলোও বলবে না। যেগুলো আমরা নিশ্চিত করতে পেরেছি, সেগুলো বলেছি। যেগুলো নিশ্চিত করতে পারি নাই, সেগুলো আমরা বলব না। সেগুলো আমরা বলব না, ডেঙ্গুর কারণে মারা গেছে। ”

বিভ্রান্তি এড়াতে সাংবাদিকদের রোগ তত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) তথ্যই প্রচার করতে অনুরোধ করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক।

তবে আইইডিসিআরের সাবেক পরিচালক মাহমুদুর রহমান ইতোমধ্যে বলেছেন, ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ঘটনাগুলো যাচাই করা অনাবশ্যক যেহেতু ক্ষতিপূরণ কিংবা বিমাদাবির বিষয়টি এখানে নেই, এক্ষেত্রে চিকিৎসকের কথাই যথেষ্ট।

‘মশা মারা আমাদের কাজ না’

ডেঙ্গুর বাহক এইডিস মশা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বটি সরকারি অন্য সংস্থার জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, “মশা মারা তো আমাদের কাজ না।

“এই দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের না, এই দায়িত্ব আইইডিসিআরেরও না। সারা বাংলাদেশে মশা নিধনের দায়িত্ব স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের।”

এইডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সরকারের নানা বিভাগে ‘দক্ষতা অনুপস্থিত আছে’ বলেও স্বীকার করে নেন তিনি।

আইইডিসিআর শুস্ক মৌসুমে মশা নিয়ে যে জরিপ করেছিল, তা সেটা জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় করেছিল বলে জানান আবুল কালাম।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যেমন কীটতত্ত্ববিদ নেই, তেমনি আইইডিসিআরেও তা না থাকার কথা তুলে ধরেন মঞ্জুর চৌধুরী।

‘মেনে নিতে হবে’

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপের বিষয়টি তুলে ধরে আবুল কালাম আজাদ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এতে কাজ করছে, যা ঠেকানোর ক্ষমতা কারও নেই। 

“পরম করুণাময়ের কাছে সবসময় প্রার্থনা করতে থাকি, আল্লাহতায়ালা বৃষ্টি বন্ধ কর। যদি তিনি বৃষ্টি বন্ধ করতেন, তাহলে মশা কমে যেত। আল্লাহতায়ালাও বৃষ্টি বন্ধ করছেন না। দেখেন বৃষ্টি আসছে, থামছে আবার আসছে।

“এই যে পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন হয়েছে, নগর বিশাল আকারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, এইখানে নিয়ন্ত্রণ আছে কারও? এখানে যেহেতু নিয়ন্ত্রণ নাই, অন্য জায়গাটাও আপনাকে মেনে নিতে হবে। এটা হল অবভিয়াস পরিস্থিতি।”

‘সাকসেসফুলি ম্যানেজড’

প্রতিনিয়ত ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা, মৃতের সংখ্যা বাড়লেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক দাবি করছেন, তারা এই পরিস্থিতিকে সফলভাবেই মোকাবেলা করছেন।

“পরিস্থিতি এমন হয়েছে, এত সংখ্যক রোগী যে আমরা পাব…. আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। দেখুন ১২৮টি দেশে ডেঙ্গু হয়েছে। পৃথিবীর কোনো দেশ.. বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও অনুমান করতে পারে নাই, ২০১৯ সালে এই অবস্থা হবে। বাংলাদেশে এত জনসংখ্যা… তাদের মধ্যে শৃঙ্খলার অভাব, শিক্ষার অভাব। তবুও আমরা যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেছি।”

নিজেদের সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে তিনি বলেন, “বিপুল সংখ্যক মানুষ হাসপাতালে আসছেন। আমরা আর পারছি না। হাসপাতালের বেড সীমিত।”

আতঙ্কিত হয়ে হাসপাতালে গিয়ে ডেঙ্গু পরীক্ষা না করাতেও অনুরোধ জানান ডা. আবুল কালাম আজাদ।

তারপরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে দাবি করে তিনি বলেন, “ঢাকা শহরে, ঢাকার বাইরে নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছে। তারা আবার চিকিৎসা নিয়ে চলে যাচ্ছে। তবে হাসপাতালে পরিস্থিতি এমন হয়নি যে ম্যানেজ করতে পারব না।”