মশা মারতে অর্ধশত কোটি টাকা ব্যয়ের পরও বাড়ছে ডেঙ্গু

রাজধানীর মশা মারতে দুই সিটি করপোরেশন বিদায়ী অর্থ বছরে খরচ করেছে ৪৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা। কিন্তু তাতেও মশা কমছে না, আর তাই বর্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে শুরু করেছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা।

ওবায়দুর মাসুম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 June 2019, 05:34 PM
Updated : 18 June 2019, 06:16 PM

ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর স্বজনদের অভিযোগের তীর নগর কর্তৃপক্ষের দিকে; এদিকে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের আন্তরিকতার অভাব নেই, তবে রয়েছে সীমাবদ্ধতা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার তথ্য অনুযায়ী, এ বছর গত ১৫ জুন পর্যন্ত ৪৮৬ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছিল, যাদের মধ্যে দুজন মারা যান। কিন্তু ১৫ জুনের পর দুই দিনে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৭২ জন বেড়ে যায়।

এ সংখ্যা ২০১৮ সালের একই সময়ের চেয়ে বেশি। ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৪২৮ জন আক্রান্ত হয়েছিলেন ডেঙ্গুতে। মারা গিয়েছিলেন তিনজন।

জুন মাসের শুরু থেকেই ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার কর্মকর্তারা; আক্রান্তদের প্রায় সবাই ঢাকার।

রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ডা. সামিয়া তাহমিনা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বর্ষা এডিস মশা বিস্তারের উপযোগী সময়। এ কারণে এ সময় বেশি আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ।

“এবার এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার পরিমাণ গত বারের চেয়ে বেশি। প্রচণ্ড গরমের পর এখন বাতাসে আর্দ্রতা বেড়েছে। জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে মশা ডিম পাড়ছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ডিম ফুটে বাচ্চা খুব দ্রুত বের হচ্ছে।”

এর আগে রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা গত ৩ থেকে ১২ মার্চ ১০ দিন মশার উৎস নিয়ে একটি জরিপ চালিয়েছিল। তখন ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার ৯৭টি ওয়ার্ডের ১০০টি স্থানের ৯৯৮টি বাড়ি পরিদর্শন করে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল। ওই জরিপে ডিএসসিসির ৮০ নম্বর ওয়ার্ডে এডিস মশার লার্ভার ঘনত্বের সূচক বা বিআই (ব্রুটাল ইনডেক্স) সবচেয়ে বেশি ৮০ পাওয়া গিয়েছিল।

হাতিরঝিল এলাকার দুপাশে দুই সিটি করপোরেশনেরই কয়েকটি ওয়ার্ড পড়েছে। সেসব এলাকায় এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব বেশি পাওয়ার কথা জানিয়েছিল রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা।

বর্ষায় এডিস মশার উপদ্রব বাড়তে পারে বলেও তখন সতর্ক করেছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। সেই শঙ্কার বাস্তব রূপ নিয়েছে জুনের শুরুতেই।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশা নিধনে সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবিও উঠেছে এরকম কর্মসূচি থেকে (ফাইল ছবি)

হাসপাতালে বাড়ছে ভিড়

বর্ষার শুরুতেই ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী বাড়তে শুরু করেছে। সোমবার হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসায় তারা আলাদা একটি ওয়ার্ড খুলেছেন।

হাসপাতাল কর্মকর্তারা জানান, গত শনিবার একদিনেই নয়জন শিশু ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়। সোমবার সেখানে চিকিৎসা নিচ্ছিল সাতটি শিশু।

ডেঙ্গু এবার আগের চেয়ে মারাত্মক হয়ে এসেছে বলে মন্তব্য করেছেন হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. এল ই ফাতমী।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তার হাসপাতালে এবার গত বারের চেয়ে বেশি রোগী আসছে।

হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে বেড়েছে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা

“এমনও হয়েছে একদিনে ২০টা বাচ্চা ভর্তি হয়েছে। এবার যে ধরনের রোগী আসছে তাদের মধ্যে ডেঙ্গু হেমোরেজিক এবং শক সিনড্রোম বেশি পাচ্ছি। আমাদের এখানে শিশু বিভাগে যারা ভর্তি আছে, তাদের প্রায় ৫০ ভাগ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত।”

অবস্থা গুরুতর হওয়ায় কয়েকটি শিশুকে অন্য হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানান ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ফাতমী।

তিনি বলেন, “আমাদের এখানে পিআইসিইউ সাপোর্ট নাই। এ কারণে শকে যাওয়ার আগে দুটো বাচ্চাকে (অন্য হাসপাতালে) রেফার করেছি। দুটি বাচ্চাই পরে মারা গেছে।”

মিরপুরের মতো নানা স্থানেই জন্মাচ্ছে মশা (ফাইল ছবি)

ওষুধ ‘ছিটায় না’ কর্তৃপক্ষ

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হলি ফ্যামিলিতে চিকিৎসা নিচ্ছিল আবদুর রহমান নামে আড়াই বছরের এক শিশু। তার দাদা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা মতিউর রহমান শিকদার মশার উপদ্রবের দুষলেন নগর কর্তৃপক্ষকে।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার বাসা কাঁঠালবাগান ঢালে। সেখানে মশার উপদ্রব অনেক বেশি, কিন্তু ওষুধ ছিটায় না বললেই চলে। গরমের আগে মাঝেমধ্যে আসত, মাস দেড়েক হল আর দেখিনি।”

পুরান ঢাকার চাঁনখারপুল এলাকার ১১ বছরের ষষ্ঠী ঘোষও ভর্তি হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে। তার পিসি সীমা ঘোষেরও একই অভিযোগ।

তিনি বলেন, “আপনারা মেয়রকে বলবেন, আমাদের এলাকায় যেন ঠিকমতো মশার ওষুধ ছিটায়। মশার কামড় খেয়ে বাচ্চার এখন জীবন-মরণ সমস্যা।”

ওই হাসপাতালেই শিশু সন্তানের পাশে থাকা ইস্কাটনের বাসিন্দা আজিজ হাসানও বলেন, তার এলাকায় সিটি করপোরেশনের মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম নেই বললেই চলে।

মশা মারতে ফগিং মেশিন নিয়ে মাঠে নামতেও দেখা গেছে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকনকে (ফাইল ছবি)

কী বলছে কর্তৃপক্ষ

নগরবাসীর অভিযোগের মুখেও ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, মশক নিধনে তাদের কাজে আন্তরিকতার অভাব নেই।

ডেঙ্গু এখনও উদ্বেগজনক পর্যায়ে নেই বলেও দাবি করেছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শরীফ আহমেদ।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ডেঙ্গু এখনও ভয়ঙ্কর বা আতঙ্কিত হওয়ার মতো নেই।”

মশা নিধনে কাজ করার কথা জানানোর পাশাপাশি শরীফ বলেন, এডিস মশা বাসার ভেতরেই জন্মায় বেশি। এজন্য নগরবাসীকে নিয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রমও চালাচ্ছেন তারা।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোমিনুর রহমান মামুনও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে একই কথা বলেন।

তিনি বলেন, “বাড়ির অভ্যন্তরেও বিভিন্ন উৎসে এডিস মশা জন্মায়। বিভিন্ন নির্মাণাধীন ভবনের জলাধার, লিফটের নিচে বিভিন্ন জায়গায় পানি জমে থাকে, যেখানে এডিস মশা জন্মালেও আমাদের কর্মীরা সেসব জায়গায় যেতে পারে না। এজন্য নাগরিকদের সচেতনতা বাড়াতে হবে।”