মাসিক নিয়ে ভাঙছে ‘চুপ’ থাকার সংস্কৃতি

দেশের রক্ষণশীল সামাজিক কাঠামোতে পরিবারেও মাসিক বা পিরিয়ডের সময়ে এক ঘরে হয়ে যায় মেয়েরা। এ সময়ে শারীরিক-মানসিক পরিবর্তন ও সমস্যা নিয়ে কথা বলার পরিবেশ না পাওয়ায় স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতেও থাকে তারা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলাচ্ছে পিরিয়ড নিয়ে নীরবতার এই সংস্কৃতি।

তারেক হাসান নির্ঝরবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 Dec 2018, 05:06 PM
Updated : 31 Dec 2018, 05:06 PM

মেয়েদের এই স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াটি নিয়ে লজ্জা না পেয়ে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মেয়েদের পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে সচেতনতা মেনে চলার জন্য সরকারের পাশাপাশি কাজ করছে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাও।

তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগে যে পিরিয়ড ছিল গোপন বিষয়, এখন তা নিয়ে সরাসরি কথা বলছেন বিভিন্ন বয়সী নারীরা।

বাংলাদেশের স্কুল পড়ুয়া নারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে গত বছর জুলাইয়ে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে ‘মেন্সট্রুয়াল হাইজিন ম্যানেজমেন্ট অ্যামোং বাংলাদেশি অ্যাডেলোসেন্ট স্কুল গার্লস অ্যান্ড রিস্ক ফ্যাক্টরস এফেক্টিং স্কুল অ্যাবসেন্সঃ রেজাল্ট ফ্রম অ্যা ক্রস সেকশনাল সার্ভে’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়।

দেশের ৭শ স্কুলের ১১-১৭ বছর বয়সী ২ হাজার ৩৩২ জন নারী শিক্ষার্থীর নিয়ে করা ওই গবেষণায় বলা হয়, ৯৮ শতাংশ মেয়েরই ১৪ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে পিরিয়ড শুরু হয়।

এতে বলা হয়, শুধু পিরিয়ডের কারণেই ৪১ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী মাসে ২ দশমিক ৮ দিন স্কুলে কামাই করেন। এই হার গ্রামের স্কুলগুলোতে ৪২ শতাংশ আর শহরের স্কুলে ৩৮ শতাংশ।

অর্থাৎ শিক্ষাবর্ষের প্রায় ১৬ শতাংশ দিনই স্কুলে যান না মেয়েরা।

পিরিয়ডের জন্য স্কুলে অস্বস্তি অনুভব করেন ৯৯ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী। এ সময় তারা স্কুলে ছেলেদের পাশে বসতে অস্বস্তিতে ভোগেন, বলেছেন ৫৯ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী।

মাসিক চলাকালীন বিভিন্ন কাজ করতে নিষেধ থাকায় স্কুলে অনুপস্থিত থাকেন ৪১ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী।  

কারণে হিসেবে অনেকেই বলেছেন, স্কুলে ন্যাপকিন পাল্টানোর সুযোগ থাকে না। অভিভাবকরাই তাদের স্কুলে যেতে নিষেধ করেন বলেও মেয়েদের অনেকে জানায়।

৬৪ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী বিশ্বাস করেন, পিরিয়ডের জন্য শ্রেণি কার্যক্রম ছাড়াও অন্যান্য কার্যক্রমে পিছিয়ে আছেন তারা।

তবে যেসব স্কুলে মেয়েদের জন্য আলাদা টয়লেটে তালা থাকে না সেখানে মাসিক চলাকালীন সময়েও বেশি উপস্থিতি দেখা যায়; যার পরিমাণ ৩৫ শতাংশ।

২০১৬ সাল থেকে ঢাকা, রাজশাহী ও কিশোরগঞ্জে বয়ঃসন্ধি ও পিরিয়ড সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে কাজ করে আসছে বেসরকারি সংস্থা ঋতু।

পিরিয়ড নিয়ে সামাজিক-পারিবারিক ট্যাবু প্রসঙ্গে ঋতুর প্রতিষ্ঠাতা শারমিন কবির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পিরিয়ড নিয়ে আমাদের পরিবারগুলোতেই এক ধরনের বাধা তৈরি হচ্ছে। পরিবারের সদস্য, মা-বাবা, ভাই-বোন কেউই এটা নিয়ে কথা বলে না।

“স্কুলগুলোতে মেয়েদের জন্য নানা সুবিধা থাকলেও পিরিয়ড নিয়ে আলোচনার সময় ছেলেদের দূরে রেখে শুধু মেয়েদেরকে এই বিষয়টা বোঝানো হয়। এতে ছেলেমেয়েরা মনে করে বিষয়টা নিশ্চয়ই গোপন।”

বড় হওয়ার মত পিরিয়ডও একটি স্বাভাবিক বিষয় বলে মন্তব্য করেন শারমিন কবির।

তিনি বলেন, “বরং এটা নিয়ে মেয়েদের প্রাউড ফিল করা উচিত। কারণ পিরিয়ডের জন্যই একটা মেয়ে একটা জীবন নিয়ে আসতে পারে দুনিয়াতে। সেই জিনিসটাই আমরা উপলব্ধি করার চেষ্টা করি না।”

বয়ঃসন্ধির শুরু থেকেই ছেলেমেয়েদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলে ‘বিষয়টিকে’ স্বাভাবিক করে ফেলা উচিত বলে মনে করেন ঋতুর এই প্রতিষ্ঠাতা।  

তিনি বলেন, “একটা মেয়ে বা ছেলের ফিজিক্যাল ও সাইকোলজিক্যাল পরিবর্তনগুলো বয়ঃসন্ধিতেই আসে। তখন থেকেই ছেলেদের গলার স্বর চেইঞ্জ হয়ে যায়, ওরা নিজেকে লুকিয়ে রাখে, মেয়েদের আস্তে আস্তে ব্রেস্ট হতে থেকে, তাদের মধ্যে কিছু ইমোশনাল চেইঞ্জ আসতে থাকে। এইগুলা কিন্তু আমরা অ্যাড্রেস করি না।

“তখনই কিন্তু আমরা ছেলেমেয়েদের বোঝাতে পারি এই পরিবর্তনগুলা স্বাভাবিক, একেক জনের একেক ধরনের হয়, তোমারও এরকম হতেই পারে। এটা হচ্ছে প্রথম ধাপ।”

প্রথম মাসিকের আগে-পরে এ নিয়ে মেয়েদের কাছে প্রয়োজনীয় তথ্য জানানো হয় না বলেও মন্তব্য করেন শারমিন কবির।  

“যে মেয়েটার প্রথমবার পিরিয়ড হবে বা হল বেশিরভাগের ক্ষেত্রে সে কোনো ভ্যারিফাইড বা ফরমাল কোনো ইনফরমেশন কমই পায়। ইনফরমেশন থেকে আরো বেশি প্রয়োজন হচ্ছে মেন্টাল সাপোর্টটা, যে তোমার পিরিয়ড হবে, এটা কেন হচ্ছে, কীভাবে হচ্ছে, কীভাবে তুমি এটা মেইন্টেইন করবা, কেন এটা তোমার জন্য আশীর্বাদ, এটা অভিশাপ না; এই জিনিসগুলা আমরা কেউ বলি না।

“ফলে দেখা যাচ্ছে এই অতি স্বাভাবিক বিষয়টাকে আমরা খুব অস্বাভাবিক করে ফেলেছি। অস্বাভাবিক করার কারণে পিরিয়ডের যে ব্লাড বা লাল রক্তটা সেটা তার কাছে অভিশাপের মত। সেটা হলে সে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়।”

পিরিয়ড নিয়ে বাংলাদেশে ‘ফরমাল স্টাডি’ খুব কম রয়েছে বলেও জানান তিনি।  

“যে দুয়েকটা হয়েছে তা আইএনজিওগুলো করেছে। তবে পূর্ণাঙ্গ থিসিস রিসার্চ একেবারেই নেই এ বিষয়ে।”

পিরিয়ড নিয়ে সচেতনতা তৈরিতে ঋতুর কার্যক্রম নিয়ে শারমিন কবির বলেন, “আমাদের কাজের প্রধান জায়গাটা হচ্ছে বয়ঃসন্ধি এবং পিরিয়ড। এই কাজের জন্য আমাদের তিনটা অ্যাপ্রোচ আছে।

“প্রথমটা হচ্ছে, সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কর্মশালা। স্কুলে স্কুলে ছেলেমেয়ের সমন্বয়ে গ্রুপ করে দেই সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য। কারো কোনো সমস্যা হলে ঐ গ্রুপের মাধ্যমে যে কেউ আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারে।”

শুধু মেয়েদেরই নয়, তাদের মা-বাবা ও স্কুলের ছেলে বন্ধুদেরকেও পিরিয়ড নিয়ে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে বলেন তিনি।

“আমরা একটা ঋতু কমিক গ্রুপ বানিয়েছি যেটা অবচেতনভাবেই সবার মাঝে পিরিয়ড সম্পর্কে একটা সচেতনতা তৈরি করবে। আমরা স্যানিটারি ন্যাপকিন উৎপাদন করছি যেটা পরিবেশবান্ধব, সাশ্রয়ী এবং অবশ্যই স্বাস্থ্যসম্মত।”

এই কাজগুলোতে গার্মেন্টসের নারী কর্মীদেরও যুক্ত করতে পেরেছেন বলে জানালেন শারমিন কবির।

পিরিয়ড বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে ২০১১ সাল থেকে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশন এইড।

সংস্থাটির বাংলাদেশি শাখার ডেপুটি ম্যানেজার ডা. নুসরাত কাদির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে টমপাড়া পুনর্বাসন এলাকার যেখানটায় আমরা কাজ করছি সেখানে দুটো স্কুল আর দুটো মাদ্রাসায় আমরা ট্রেনিং দেই। এরপর আমরা স্বপ্নদোষ আর মাসিক নিয়ে ডিসপ্লে বোর্ড তৈরি করি।”  

ট্রেনিং দেওয়ার পর তাদের অনেকের মধ্যেই যে জড়তা ছিল তা কিছুটা কমে যায় বলে জানান ডা. নুসরাত কাদির।

“এরপর দেখা গেছে সেই মাদ্রাসার হিজাব পরা মেয়েরাও তাদের স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে আমার কাছে আসা শুরু করেছে।”

তিনি বলেন, “আমরা যে অ্যাডলোসেন্ট ক্লাব করেছিলাম তার সদস্যদের আমরা ট্রেনিং দেই। এই সদস্যরা ওই এলাকার আরো যে বয়ঃসন্ধিকালীন ছেলেমেয়েরা আছে তাদের বোঝানো শুরু করেছে।”

সেখানে ৮০ জন মেয়েকে মাসিক চলাকালীন সময়ে সাবান, ন্যাপকিন, রুমাল, মাসিকের তারিখের হিসেব রাখার জন্য কার্ডসহ এই সময়ে পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিতে একটা কিটবক্স দেওয়া হয়।

যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না উল্লেখ করে অ্যাকশন এইডের এই কর্মকর্তা বলেন, “সেক্সুয়াল বা সেক্স কথা আসলেই আমাদের একটা ভ্রান্ত ধারণা এটা নিশ্চই খারাপ কিছু হবে।

“পাঠ্যপুস্তকে বিষয়টি এসেছে কিন্তু যে শিক্ষগকরা পড়াবেন তা উইলিংলি পড়াচ্ছেন না। …আমরা বলেছি বাবা-মার সাথে খোলাখুলি কথা বলার জন্য; মা-মেয়েও এসব নিয়ে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না।”

‘আমরা এভাবে চলে আসছি, তোমরাও এভাবে চলবা’, ‘এটা খাওয়া নিষেধ, ওটা খাওয়া যাবে না, করা যাবে না’ – এমন কিছু কুসংস্কার ও বিধিনিষেধে আটকে রাখা হচ্ছে মেয়েদের বলে মনে করেন ডা. নুসরাত কাদির।  

“আবার দরিদ্র পরিবারের নারীরা ন্যাপকিন কেনার সামর্থ্যও রাখেন না। আবার আমাদের ধর্মীয় কিছু গোড়ামি আছে, সেটাও একটা বাধা। আবার যারা হাইজিন সম্পর্কে একজন অন্যজনকে শেখাচ্ছেন তারাও অনেকসময় ঠিকমত না জেনে শেখাচ্ছেন। সেজন্য আমরা খুব ছোট ছোট মেসেজ দিচ্ছি এবং চাচ্ছি সেটা প্রপারলি পৌঁছাক।”

সামাজিক-পারিবারিক ট্যাবু কাটিয়ে উঠতে ‘গেইটকিপারদের’ সচেতন করতে গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন,  “আমার পিরিয়ড হলে আমি কাকে বলছি? আমার মাকে, বোনকে, স্কুলের টিচারকে। এই মানুষগুলা যারা আমাকে হ্যান্ডেল করছে তাদেরকে সচেতন করা প্রথম কাজ।”

পিরিয়ড বিষয়ে দেশজুড়ে সচেতনতা তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখছে সরকারও।

দেশের সব স্কুলেই এখন মেয়েদের জন্য রয়েছে আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা, স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে সংরক্ষণ করে রাখা আছে স্যানিটারি ন্যাপকিন, ষষ্ঠ শ্রেনির পাঠ্যপুস্তকে যোগ করা হয়েছে মাসিক নিয়ে প্রবন্ধও।

পিরিয়ডের সময় স্কুলে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে বলে জানালেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. শরমিন ফেরদৌস চৌধুরী।

তিনি বলেন, “প্রত্যেকটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কো-এডুকেশন কিংবা গার্লস এডুকেশনে দুই জায়গাতেই মেয়েদের জন্য আলাদা বাথরুমের ব্যবস্থা আছে। সব স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে স্যানিটারি ন্যাপকিন সংরক্ষিত থাকে। মেয়েরা যদি কেউ কেয়ারলেস হয়ে বা পিরিয়ডের টাইমটা তাদের মনে নাই স্কুলে চলে আসে সেক্ষেত্রে প্রধান শিক্ষক এটার ব্যবস্থা নিয়ে নেন।”

তবে পিরিয়ড নিয়ে পুরনো ধ্যানধারণা থেকে বেরিয়ে  এসে ‘বাংলাদেশ পাল্টেছে’ বলে মনে করেন তিনি।

“এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রতিটা প্রতিষ্ঠানই সচেতন এবং আমাদের সন্তানরা এখন কেউই আর রিইউজেবল ন্যাপকিন ব্যবহার করে না। এটা তারাও কেনে, যে কোনো জরুরি পরিস্থিতিতে স্কুল থেকেও নিতে পারে। স্কুলে আয়াও আছে, সুইপারও আছে, সব সুবিধাই তারা পাচ্ছে।”

স্কুলগুলোতে ব্যবস্থা কতটুকু দেওয়া হচ্ছে এবং এতে কোনো পরিবর্তন আসছে কি না তা নিয়ে জানালেন লক্ষীপুরের চন্দ্রগঞ্জ থানার চৌপল্লী কে ডি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পরীক্ষিত চন্দ্র দেবনাথ।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গ্রামের মেয়েরা মাসে চার দিন করে ১২ মাসে প্রায় ৪৮ দিন স্কুল মিস করে। বিভিন্ন স্কুলে ন্যাপকিন এবং অন্যান্য জিনিসপত্র রাখা হচ্ছে, মেয়েরা সেগুলা ম্যাডামের (নারী শিক্ষক) কাছ থেকে নিয়ে যাচ্ছে। এটা যুগান্তকারী উদ্যোগ।”

পিরিয়ড নিয়ে চুপ থাকার সংস্কৃতি ‘অনেক কমেছে’ বলেও মনে করেন এই শিক্ষক।

তিনি বলেন, “যেমন আমার স্কুলে মেয়েরা এখন দরখাস্তের মধ্যে নিঃসংকোচে ওরা বলে, ‘স্যার, আমার পেট ব্যথা আছে’। পেট ব্যথা বললে আমরা বুঝি যে কি অবস্থা। আমরা ছুটি দিয়ে দেই। হঠাৎ করে কোনো মেয়ের সমস্যা হলে সেটার জন্য ম্যাডামের কাছে সব রাখা আছে।”