মাতৃমৃত্যু হার না কমার কারণ ‘পিতৃতান্ত্রিক সমাজ’

গর্ভবতী মায়েদের মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা বাংলাদেশ সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার হলেও ২০১০ সালের পর তাতে তেমন পরিবর্তন আসেনি। আর এর মূল কারণ হিসেবে পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক কাঠামোকেই বাধা হিসেবে দেখছেন গবেষকরা।

তারেক হাসান নির্ঝরবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Dec 2018, 06:47 PM
Updated : 25 Dec 2018, 06:47 PM

২০০১ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যু হার প্রতি লাখ জীবিত জন্মে ৩২২ থেকে ১৯৪ এ হ্রাস পায়।

২০১৬ সালে বাংলাদেশ সরকারের করা ‘বাংলাদেশ মাতৃমৃত্যু ও স্বাস্থ্যসেবা জরিপ’ অনুযায়ী এক লাখ জীবিত শিশুর জন্ম দিতে ১৯৬ জন মায়ের মৃত্যু হয়।  তবে একই বছর জুনে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত রিসোর্স কিটে এই সংখ্যার কথা বলা আছে ১৭০ জন।

জরিপের ফলাফলে বলা হয়, ২০১০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশে মাতৃস্বাস্থ্য সেবায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও মাতৃমৃত্যু হার স্থিতাবস্থায় রয়েছে।

২০১৬ সালের পর এ সম্পর্কিত কোনো জরিপ আর হয়নি।

যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে বাংলাদেশে  ‘নীরবতার সংস্কৃতি’ বিদ্যমান বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাদেকা হালিম।

তিনি বলেন, মাতৃমৃত্যু হার কমাতে সরকার থেকে বিগত সময়ে বহু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও এই হার এখনো কমেনি।  

“এর মূল কারণ আমাদের মারাত্মক পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীদের এখনও দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক ভাবা হয়। বাংলাদেশের নারীদের সেই অর্থে এখনো নিজের শরীর এবং নিজের মনস্তত্বের
পর নিয়ন্ত্রণ নেই; এখানে স্বামীর সিদ্ধান্তই সব।”

নারী কয়টি সন্তান নেবেন বা কত বছরের বিরতিতে সন্তান নেওয়া হবে এবং নারী হাসপাতালে যাবেন কিনা তা নির্ধারণ করেন স্বামী অথবা শাশুড়ি অথবা পরিবারের পুরুষ সদস্য বলে মন্তব্য করেন ঢাবির সমাজবিজ্ঞান বিভাগের এই অধ্যাপক।  

তিনি বলেন, “এই অবস্থা থেকে বের হতে হলে প্রথমেই আমাদের মাইন্ড সেট ঠিক করতে হবে। পুরুষতান্ত্রিক যে কাঠামো আছে তাকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে। এছাড়াও প্রশিক্ষিত মিড-ওয়াফের যে ব্যবস্থা আছে সেটাকেও কাজে লাগাতে হবে।”

লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জ থানার উত্তর জয়পুর ইউনিয়নের অন্তত পাঁচ জন নারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মূলত সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক কারণেই তারা স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কম যান।

যেসব পরিবারের আর্থিক অবস্থা তুলনামূলক ভালো তারা বড় ধরনের সমস্যায় পড়লে ব্যক্তিগত চেম্বার নিয়ে বসা ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। আর অপেক্ষাকৃত কম অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের নারীরা স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যান।

নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহিণী লায়লা বেগম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগে তো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাওয়ার চল ছিল না তেমন, এখন অনেকের দেখাদেখি অনেক প্রসূতি মায়েরাই যায়। ঘরের মধ্যেই একটা বাধা আছে।”

স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়াটাকে মুরুব্বিরা ‘ঢং’ মনে করেন  বলে জানান লায়লা বেগম।  

“আমাকে আমার পরিবার থেকে একথাও শোনানো হয়েছে যে, আমার বাচ্চা তো ঘরেই হইছে, তোমার এত ডাক্তারের কাছে যাওয়া লাগে কেন? এছাড়াও গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্যসমস্যা নিয়ে কথাবার্তা বলাটাকে অনেকে ভালোভাবে দেখে না। গোপনে কথা বলা লাগে।”

এই ধরনের সামাজিক প্রেক্ষাপটকে মায়ের মৃত্যুর হার না কমার অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখেন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক জাকিয়া আখতার।

প্রজনন স্বাস্থ্যকে এখনও ‘গুরুত্ব’ দেওয়া হয় না উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমরা জ্বর হলে ডাক্তারের কাছে যাই, কিডনিতে সমস্যা হলে ডাক্তারের কাছে যাই, স্বাভাবিক সকল অসুখ-বিসুখেই আমরা ডাক্তারের শরণাপন্ন হই।

“…যে কারণে আপনি পৃথিবীতে আসছেন, যে রিপ্রোডাক্টিভ অরগান না থাকলে আপনি পৃথিবীতেই আসতেন না, আপনার জন্মই হত না সেটাকে আপনি গুরুত্ব দিচ্ছেন না। আপনার জন্মের পরেই তো কিডনি, জন্মের পরেই তো হার্ট। সুতরাং এটাকে গুরুত্ব দিতে হবে।”

পুরো বিষয়টিই ‘নারীর ক্ষমতায়নের’ সঙ্গে যুক্ত বলে মনে করেন সরকারি এই কর্মকর্তা।  

“নারীর ক্ষমতায়ন যত হবে, নারীরা যখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রাখবেন তখন অবশ্যই নারী সিদ্ধান্ত নেবেন তার সন্তান কোথায় হবে, কতটা হবে, কখন হবে, কীভাবে হবে, দুটি নেবে না একটি নেবে, সে বিয়ে করবে কখন…।”

জাকিয়া বলেন, “আমরা সাংস্কৃতিকভাবেই মনের মধ্যে একটা বদ্ধমূল ধারণা রাখি যে, মহিলার সন্তান হবে কেউ জানবে না, অথবা বাইরের মানুষ সেটা দেখবে না অথবা তার সন্তানটা হবে বাসায়। শাশুড়ি ভাবেন, আমারো তো সন্তান বাড়িতে হয়েছে, তোমার হাসপাতালে যেতে হবে কেন?”

সাধারণ মানুষের প্রাথমিক চিকিৎসা, স্বাস্থ্য সেবার দক্ষতা ও সেবার মান উন্নয়নের মধ্য দিয়ে সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা দিয়ে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে ‘চতুর্থ স্বাস্থ্য জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচি’ শীর্ষক একটি প্রকল্প গত বছর মার্চে অনুমোদন দিয়েছে সরকার।

২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যু হার প্রতি এক লাখ জীবিত জন্মে ১২১ এ কমিয়ে আনা এই প্রকল্পের লক্ষ্য। এছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজির আওতায় মাতৃমৃত্যু হার ৭০ এ কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।  

গত ১০ বছরে মাতৃমৃত্যুর হার অপরিবর্তিত থাকার ব্যাখা দিতে গিয়ে ‘বাংলাদেশ মাতৃমৃত্যু ও স্বাস্থ্যসেবা’ জরিপে বলা হয়েছে, মাতৃমৃত্যু হ্রাসে মাতৃস্বাস্থ্য সেবা বৃদ্ধির প্রভাব কম, স্বাস্থ্য সেবার মান সন্তোষজনক নয়, অধিকাংশ স্বাস্থ্যকেন্দ্র মানসম্মত মাতৃস্বাস্থ্য সেবা প্রদানের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত নয়, রক্তক্ষরণ ও একলাম্পশিয়ার কারণে ৫৫ শতাংশ মা মারা গেলেও এ সংক্রান্ত চিকিৎসায় অগ্রগতি কম, প্রয়োজনীয় মাত্রার চেয়েও সিজারিয়ান প্রসবের হার বেশি।  

মাতৃকালীন মৃত্যুর জন্য সেবাকেন্দ্রে না এসে ঘরেই সন্তান প্রসবের প্রবণতাকেও দায়ী করেন জাকিয়া।

প্রসূতির জরুরি অবস্থায় সবকিছু বাসায় ‘ম্যানেজ’ করা সম্ভব হয় না উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমাদের এখনো ফিফটি পার্সেন্ট হোম ডেলিভারি হচ্ছে, ফোর্টি সেভেন পার্সেন্ট হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারি।”

যতদিন অপরিপক্ক হাতে প্রসব হবে ততদিন মাতৃমৃত্যু বেশি হবে, বলেন জাকিয়া।

“যারা হোম ডেলিভারি করান তারা সাধারণত গরিব এবং একটু রিমোর্ট এরিয়াতে থাকেন বলে সময়মত আসতে পারেন না। যখন জরুরি পরিস্থিতি তৈরি হয় তখন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে প্রসূতি মা মারা যান।”

গত কয়েক বছরে সরকারি ব্যবস্থাপনায় মাতৃমৃত্যুর হার কমানোর চিত্র তুলে ধরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এমডিজি লক্ষ্যমাত্রা আমরা এখনো ফুলফিল করতে পারি নাই। সেদিক থেকে আমরা বলবো হয়নি। কিন্তু মাতৃমৃত্যু আমরা প্রায় পঞ্চাশ ভাগ কমিয়ে ফেলেছি। কারণ আগে যেটা ৩২০ ছিল সেটা এখন ১৭০। আমরা অর্ধেকের বেশি কমিয়েছি।”

প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারি বৃদ্ধি করে মাতৃত্বকালীন মৃত্যু কমাতে সরকারি পদক্ষেপ নিয়ে জাকিয়া বলেন, “…৬৪টা জেলায় ইউনিয়ন পর্যায়ে ১৮৫টা মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র আছে; এছাড়াও সারাদেশের সাড়ে চার হাজার ইউনিয়নে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র আছে যার তিন হাজার ৩৮৮টা আমাদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এই কেন্দ্রগুলোতে আমরা নরমাল ডেলিভারি সেবা চালু করেছি।

“অর্থাৎ সিজার হবে না কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা ব্যবহার করে নরমাল ডেলিভারি হবে। সব জায়গায় আমরা প্রশিক্ষিত মিড-ওয়াইফ দিয়েছি।”

এছাড়া মাতৃমৃত্যু রোধ ও প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারি বাড়াতে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জনপ্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।

জরুরি সেবার সময় মানুষের অর্থ সঙ্কট এড়াতে বার্থ প্ল্যানিং ও গর্ভবতী মায়ের জন্য ‘মায়ের ব্যাংক’  চালু করা হয়েছে।  

“জনগণকে পরিবার পরিক্কল্পনা, মা ও শিশু স্বাস্থ্য, প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে সপ্তাহে সাত দিন চব্বিশ ঘন্টা সরাসরি তথ্য ও পরামর্শ দিতে সুখী পরিবার নামে একটি কল সেন্টার চালু করা হয়েছে; যার নম্বর ১৬৭৬৭।”