মজার ইফতার নিয়ে সতর্কতার পরামর্শ

পেঁয়াজু, বেগুনি, আলুর চপ, কাবাব, চাপ-মুখরোচক এসব খাবার ইফতারের অনুসঙ্গ হয়ে উঠলেও এগুলোর বিষয়ে সতর্ক করেছেন পুষ্টিবিদরা।

কাজী নাফিয়া রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 May 2018, 02:47 PM
Updated : 26 May 2018, 03:53 PM

সারা দিন অভুক্ত থেকে তেলেভাজা এই খাবার খেয়ে অনেকেই গ্যাসের সমস্যায় ভুগছেন জানিয়ে তারা বলছেন, ইফতারে প্রথমে শরবত-পানীয় ও ফল খাওয়াই উত্তম। তেলেভাজা খাবার খেলেও সেগুলো পরিমাণে কম এবং একেকদিন একেকটা খাওয়া উচিত।

রোজার বিকালে ঢাকাসহ সারা দেশের হোটেল-রেস্তোরাঁর সামনের অংশে তেলেভাজা ইফতার সামগ্রী দেখে খাওয়ার ইচ্ছা হলেও তাতে সংযত থাকতে বলছেন পুষ্টিবিদরা। বেশিরভাগ হোটেল-রেস্তোরাঁয় একই তেল বারবার ব্যবহার করায় ওই সব খাবার ক্যান্সারের ঝুঁকি তৈরি করে বলে সতর্ক করেছেন তারা।

রোজায় গ্যাসের সমস্যা নিয়ে আসা রোগীর সংখ্যা বেড়েছে বলে জানান ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালের পুষ্টি বিশেষজ্ঞ তামান্না চৌধুরী।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ইফতারে আমরা সাধারণত মচমচে খাবারগুলোই প্রথমে খাই, কিন্তু ভাজা খাবার প্রথমে খাওয়ার ফলে এসিডিটি বা গ্যাস হয়।

“রোজায় খাওয়ার সময়ের পরিবর্তন ও ভাজাপোড়া খাবার খাওয়ার ফলে অনেককেই এসিডিটির সমস্যায় ভুগতে হচ্ছে। আবার অনেকের কোষ্ঠকাঠিন্য হচ্ছে, কারও কারও হজমের সমস্যার কারণে লুজ মোশনও হচ্ছে।

তামান্না চৌধুরী

“রোজা রেখে অতিরিক্ত ভাজাপোড়া হজম করতে না পারলে এসিডিটি বা গ্যাসের সমস্যা ও পাতলা পায়খানা হওয়ার ফলে শরীর পানিশূন্য হয়ে যায়।”

এছাড়া ইফতারে তেলেভাজা খাবারের পাশাপাশি অন্যান্য উচ্চ প্রোটিন ও ক্যালরিসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ায় অনেকের কোলেস্টেরল, ইউরিক এসিড, রক্তচাপ ও ওজন বেড়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন পুষ্টিবিদ তামান্না।

তিনি বলেন, “ভাজাপোড়ার পাশাপাশি ইফতারে এমন অনেক খাবার থাকে যেগুলো থেকে আমরা ফ্যাট, ক্যালরি, প্রোটিন পেয়ে থাকি। একজন মানুষের দৈনিক যতটুকু ফ্যাট, ক্যালরি প্রয়োজন প্রতিদিন সে তার চাহিদার তুলনায় বেশি নেয়। ফলে রক্তে কোলেস্টেরল বেড়ে যাচ্ছে, ইউরিক এসিডের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে, অনেকের প্রেসার বেড়ে যাচ্ছে এবং ওজনটাও বেড়ে যাচ্ছে।

সুন্দর ও সুস্থভাবে রোজা পালনের জন্য পরিমিত পরিমাণে তেলেভাজা খাবার ও অন্যান্য খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

হোটেল-রেস্তোরাঁর তেলেভাজা খাবার একেবারেই বর্জনের পক্ষে তামান্না চৌধুরী।

তিনি বলেন, “বাসায় বানানো ডুবো তেলে ভাজা খাবারে হয়ত ফ্যাট-ক্যালরি বেশি থাকে, কিন্তু তা স্বাস্থ্যসম্মত। কারণ তেলটা সাবধানে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু বাইরের বানানো খাবারে এক তেল বার বার ব্যবহার করা হয়। ওই তেল ক্যান্সারের অন্যতম কারণ।”

রাজধানীর ধানমণ্ডির ইফতার বাজার। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

ইফতারে একেকদিন একেক আইটেম খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “আজকে পেঁয়াজু খেলে কাল হয়ত বেগুনি খেলেন বা আলুর চপ খেলেন। ডালজাতীয় খাবার একদিন পর পর খেলেন। পরিবারের সদস্যদের জন্য প্রতিদিন যতগুলো তলেভাজা খাবার প্রয়োজন তার বেশি না বানালে কিন্তু খাওয়াও হবে না। একই খাবার প্রতিদিন না খেয়ে খাবারে বৈচিত্র্য এনে খেতে হবে।”

তেলেভাজা খাবারের বিষয়ে সতর্ক হতে বলছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. নাজমা শাহীনও।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তেলেভাজা খাবার সব সময়ই অস্বাস্থ্যকর। আর আমাদের এখানে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে তেলেভাজা খাবারগুলো তৈরি করা হয় না। হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোতে বাসি থেকে গেলে সেটা আবার ভেজে পরের দিন বিক্রি করা হয়। ফলে যাদের এসিডিটি আছে, এগুলো এসিডিটি আরও বাড়ায়।

“তারা প্রতিবার ফ্রেশ তেল ব্যবহার করে না। একটা তেল দীর্ঘক্ষণ ধরে ব্যবহার করে, আবার একদিনের তেল আরেক দিনেও ব্যবহার করে। এতে পোড়া তেলটার মধ্যে ট্রান্স ফ্যাটি এসিড থাকে, যা শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এতে বিভিন্ন ধরনের টিস্যু ও হার্টের ক্ষতি হতে পারে। সেজন্য ট্রান্স ফ্যাটি এসিডকে সারা বিশ্বে এড়িয়ে চলার জন্য বলা হয়।”

নাজমা শাহীন

এসব খাবার বাসায় বানিয়ে খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “একদমই তেলেভাজা খাওয়া যাবে না, সেটিও কিন্তু বলা হচ্ছে না। বলা হচ্ছে যে, তেলেভাজার পরিমাণটা বেশি হয়ে যাচ্ছে।”

সতর্ক থাকতে হবে ফলেও

ইফতারে তেলেভাজা খাবারের পরিবর্তে ফল, চিড়া, দই, অল্প তেলে তৈরি নুডলস ও ফলের রস খাওয়া স্বাস্থ্যসম্মত বলে জানিয়েছেন পুষ্টি বিশেষজ্ঞ তামান্না চৌধুরী।

তবে ফলের বিষক্রিয়া এড়াতে রঙ ও গন্ধ দেখে ফল কেনার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। 

তামান্না চৌধুরী বলেন, “যে ফলের মওসুম নয়, যেটা এখনও ওঠেনি সেটা খাওয়া যাবে না। কারণ সেটায় কিছু মেশানোর আশঙ্কা থাকে। মোটা খোসার ফল যেমন কলা, মাল্টায় ফরমালিন ভেতর পর্যন্ত পৌঁছায় না। ওইটাও আমরা খেতে পারি।”

ফল কাটার আগে আধা ঘণ্টা ভিনেগার পানিতে ডুবিয়ে রেখে খোসা ফেলে খেলে ফলের বিষক্রিয়া দূর হয়ে যায় বলে জানান তিনি।

“ইফতারে ফলের ক্ষেত্রেও রকমফের করে খেতে হবে। আমে যদি আমরা মনে করি কার্বাইড থাকে, তাহলে প্রতিদিন সেটা খেলে সমস্যা হয়ই। এজন্য একেক দিন একেক ফল খেতে হবে। বিভিন্ন পানিজাতীয় ফল খেতে হবে।”

তবে ফল নিয়ে তেমন দুশ্চিন্তার কারণ দেখছেন না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাজমা শাহীন।

তিনি বলেন, “ফলকে সতেজ রাখার জন্য যে ফরমালিন ব্যবহার করা হয়, সেটা ফলের উপরে ব্যবহার করা হয়। সেটা ভিনেগার দিয়ে ধুলে চলে যায়।

“ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে সারা বিশ্বেই ফল পাকানো হয়। কারণ পাকা ফল গাছ থেকে পেড়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। এগুলো যখন পরিপক্ক হয়, তখন এগুলোকে বাজারজাতকরণের আগ মুহূর্তে সেটা ইথোফেন কিংবা ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে পাকানো হয়।”

তবে বাংলাদেশে চিত্রটা বেশ ভিন্ন বলে মনে করেন নাজমা শাহীন।

তিনি বলেন, “এখানে যেটা হয়েছে, সেটা হচ্ছে আমগুলো পরিপক্ক হওয়ার আগেই রোজার বাজারটা ধরার জন্য এগুলো ব্যবহার করেছে।আম পাকার আগেই কাঁচা আমকে ইথোফেন দিয়ে পাকিয়ে বাজারে এনেছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। এতে কোনো স্বাস্থ্য ঝুঁকি নাই। কিন্তু এতে পাঁকা আমের টেস্ট পাওয়া যাবে না। একজন ভোক্তার কাছে পাকা আমের দামে এটা বিক্রি করা অপরাধ। কিন্তু স্বাস্থ্য ঝুঁকি নেই।”

ইফতারে বেশি বেশি ফল খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে নাজমা শাহীন বলেন, “আমরা পানি খেয়ে প্রথমে খেজুরটা খাই। এতে শক্তি ও সুগার পাই। খেঁজুর খাওয়ার সাথে সাথে সুগারের ঘাটতি থাকলে তা পূরণ হয়ে যায়। লেবুর শরবত খেলে ভিটামিন সি ও সুগার পাওয়া যায়।”

ইফতারে তেলেভাজা খাবার এড়িয়ে নানা রকমের ফল, কাঁচা ছোলা, পুডিং, ফালুদা, ফিরনি, দই-চড়া খাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।