কাঠমান্ডুতে ওই বিমান দুর্ঘটনার পর বেঁচে যাওয়া ১০ বাংলাদেশি যাত্রীর মধ্যে ছয়জনকে দেশে এনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে।
বেদনাদায়ক এই ঘটনাটি নিয়ে সবার আগ্রহ থাকায় হাসপাতালে থাকা আহতদের দেখতে সাংবাদিকসহ অন্য অনেকে ভিড় করছেন।
এই প্রেক্ষাপটে রোববার সচিবালয়ে আহতদের চিকিৎসার সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসে স্বাস্থ্যমন্ত্রী আহতদের দেখতে না যাওয়ার পরামর্শ দেন।
সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আপনাদের (সাংবাদিক) কোনো আহতকে দেখতে যাওয়ার দরকার নেই, তাদের বিরক্ত করার দরকার নেই। কেমন আছে, না আছে, আমাদের কাছ থেকে জেনে নেবেন।”
বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের প্রধান সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন বলেন, “মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা আমাদের বারবার বলছেন যে, রোগীকে আপনারা দয়া করে কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবেন না এই মুহুর্তে।
“রোগীদের যদি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন, তবে তারা আরও ইমোশনাল হয়ে যায়। এটা একটা সাংঘাতিক..এক ট্রমার উপর আরেকটি ট্রমা হয়ে যায়।”
“যতটুকু প্রয়োজন, হাসপাতালের নিচে আপনারা আসবেন, আমরা ব্রিফিং করব,” সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন সামন্ত লাল।
ইউএস-বাংলার এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজটি গত ১২ মার্চ কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দরে অবতরণের সময় বিধ্বস্ত হলে ৪৯ জনের মৃত্যু হয়, যাদের মধ্যে ২৬ জন বাংলাদেশি। যাত্রীদের মধ্যে বাংলাদেশি ১০ জন বেঁচে যান, তাদের মধ্যে ছয়জনকে এরই মধ্যে ঢাকায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এরা সবাই অগ্নিদগ্ধ।
ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন রয়েছেন- শাহরিন আহমেদ, মেহেদী হাসান অমিয়, তার স্ত্রী সাঈদা কামরুন্নাহার স্বর্ণা, মেহেদীর ফুপাত ভাইয়ের স্ত্রী আলমুন নাহার অ্যানি, রাশেদ রুবায়েত ও শাহীন ব্যাপারী।
বার্ন ইউনিটে ভর্তি থাকা পাঁচ রোগীর বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরে অর্থোপেডিক সার্জারির সহযোগী অধ্যাপক সাইদুল ইসলাম।
## শেহরিনের (৩০) ডান পায়ে তিনটি আঙুল ভাঙা, পিঠে স্কিন লস, পায়ে প্লাস্টার
## মেহেদীর (২৯) হাঁটুতে আঘাত আছে, কিন্তু হাড় ভাঙা নেই; দুই সপ্তাহে তার সুস্থতার আশা চিকিৎসকের
## স্বর্ণার (২২) তেমন কিছু নেই, তার তলপেটে সামান্য আঘাত রয়েছে
## অ্যানি (২২) ডান গোড়ালিতে ব্যথা, কিন্ত হাড় ভাঙেনি, লিগামেন্টে একটু সমস্যা হয়েছে।
## রুবায়েতের (৩২) ডান দিকের বুকের একটি হাড় ভাঙা
## শাহীন ব্যাপারীর শরীরে ৩০ শতাংশের বেশি ‘ডিপ বার্ন’ এবং আরও কিছু ইনজুরি রয়েছে বলে সামন্ত লাল জানিয়েছেন
স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব সিরাজুল হক খান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আহত যারা দেশে আসছেন তারা চিকিৎসার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সহযোগিতা পাচ্ছেন।
এই দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসায় ১৩ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সমন্বয়ে একটি বোর্ড গঠন করেছে সরকার ।
সামন্ত লাল বলেন, “মেডিকেল টিমের সবাই একে একে সব রোগীকে দেখেছি। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ চলছে। রোগীদের মধ্যে একমাত্র শেহরিনেরই অপারেশন করতে হবে। তার মেন্টাল কন্ডিশন আরেকটু স্টেবল হলে আমরা সার্জারিতে যাব।”
অন্যান্যরা ‘কনজারভেটিভ ট্রিটমেন্টেই (ওষুধ প্রয়োগ)’ ভালো হবেন বলে আশা প্রকাশ করেন এই চিকিৎসক।
এই রোগীরা শঙ্কামুক্ত কি না- প্রশ্নে তিনি বলেন, “সব রোগীই স্টেবল আছে, মেডিকেলের ভাষায় আমরা স্টেবল বলি, কিন্তু কাউকে শঙ্কামুক্ত বলি না। একটা রোগী যতক্ষণ পর্যন্ত ছাড়পত্র নিয়ে হাসপাতাল থেকে চলে না যায়, ততক্ষণ শঙ্কামুক্ত বলা যায় না।”
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ফারুক আলম বলেন, “আমরা চারজন রোগীকে দেখেছি, তাৎক্ষণিক যা পেলাম, তা হল যে তাদের মধ্যে দুশ্চিন্তা, দুঃস্বপ্ন, ভয়-ভীতি- এগুলো কাজ করছে।
“আমরা তাদের সাইকোলজিক্যাল ফ্রাস্টেড চিকিৎসা দিয়েছি। তাদের দীর্ঘ মেয়াদী সমস্যা হতে পারে। পোস্ট ট্রমাটিক ডিজঅর্ডার হলে অনেক সময় মানুষের আত্মহত্যার চিন্তা আসে। এজন্য তাদের দীর্ঘমেয়াদী কাউন্সেলিংয়ে রাখতে হবে।”
সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ জানান, নিহত ৪৯ জনের মধ্যে নেপালে শনিবার পর্যন্ত ২৩ জনকে শনাক্ত করা গেছে, তার মধ্যে ১৭ জন বাংলাদেশি, ১৪ জন নেপালি এবং একজন চীনের নাগরিক।
তিনি বলেন, “ফরেনসিক চিকিৎসক অধ্যাপক সোহেল নেপালে বাংলাদেশ দূতাবাসে কাজ করছেন। তারা ধারণা করছেন ৯ জনের (এখনও অশনাক্ত) মধ্যে ৩ থেকে ৪ জনকে শনাক্ত করা সম্ভব হবে ডিএনও টেস্ট ছাড়াই। যে কয়জনের ডিএনএ টেস্ট লাগবে, ডিএনএ টেস্ট করা হবে। আমাদের দূতাবাস থেকে নেপাল সরকারের জন্য একটি চিঠি তৈরি করা হচ্ছে এই চিঠি দেয়ার পর অনুমতি পেলে তাদের ডিএনএ স্যাম্পল সংগ্রহ করা হবে।”
যাদের শনাক্ত করা গেছে, তাদের লাশ ইউএস-বাংলা নিয়ে আসার চেষ্টা করছে জানিয়ে আজাদ বলেন, “কিন্তু তাদের একবারে ১৫টির বেশি লাশ বহনের ক্ষমতা নেই। এজন্য তারা সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করছে।”