ফকির আলমগীর: দ্রোহ, পপ আর গণমানুষের গান

ভাঙা ভাঙা গলা নিয়ে তার আফসোস ছিল, তবে অর্ধ শতকের বেশি সময় ধরে সেই কণ্ঠে গেয়ে যাওয়া গণমানুষের গানই ফকির আলমগীরকে পৌঁছে দিয়েছে মানুষের হৃদয়ের কাছে।

সাইমুম সাদ গ্লিটজ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 July 2021, 02:28 AM
Updated : 24 July 2021, 07:36 AM

‘ও সখিনা’ কিংবা ‘মায়ের একধার দুধের নাম’ গানগুলো এ দেশের মানুষকে ঝাঁকড়া চুলের দরাজ গলার এই শিল্পীর কথা মনে করিয়ে দেবে আরও বহুদিন।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার রাতে মারা যান একাত্তরের কণ্ঠযোদ্ধা, গণসংগীত শিল্পী ফকির আলমগীর। তার বয়স হয়েছিল ৭১ বছর।

একুশে পদকপ্রাপ্ত এই শিল্পীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, “ফকির আলমগীরের মৃত্যুতে দেশের সঙ্গীত অঙ্গনে যে শূন্যতা সৃষ্টি হলো তা কখনো পূরণ হওয়ার নয়। তার গান তরুণ প্রজন্মের মাঝে দেশপ্রেমের নবজাগরণ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।”

আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার শোকবার্তায় বলেন, “এ দেশের সংগীতাঙ্গনে, বিশেষ করে গণসংগীতকে জনপ্রিয় করে তুলতে তার ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।”

ফকির আলমগীরের জন্ম ১৯৫০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর জেলার ভাঙা থানার কালামৃধা গ্রামে। কালামৃধা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকে স্নাতক শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর করেন।

এর মধ্যেই ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ফকির আলমগীর জড়িয়ে যান বাম ধারার ছাত্র রাজনীতিতে। সেই সূত্রে ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠী ও গণশিল্পী গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে তার গান আর সংগ্রামের জগতে প্রবেশ।

ঠিক তার পরপরই এল ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সেই উত্তাল সময়। গানের শিল্পী ফকির আলমগীর তাতেও কণ্ঠ মেলালেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি যোগ দিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে।

২০১৮ সালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ফকির আলমগীর বলেছিলেন, সাতই মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুনেই তিনি যুদ্ধে গিয়েছিলেন।

“এটা শুধুমাত্র কোনো ভাষণ নয়। এর মধ্যে যুদ্ধের নির্দেশ ছিল, রণকৌশল ছিল। ততদিনে তো গেরিলা যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল। তার ভাষণ শুনেই আমি যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম।”

ফকির আলমগীরের বয়স তখন ২১ বছর। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে কলকাতার নারিকেল ডাঙায় শরণার্থী শিল্পী গোষ্ঠীতে যোগ দেন তিনি। সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত এম এ মান্নান ছিলেন সেই সংগঠনের দলনেতা। সেখানে ফকির আলমগীরের সহশিল্পী হিসেবে ছিলেন তিমির নন্দী, নাট্যকার-অভিনেতা মামুনুর রশীদসহ আরও অনেকে।

শুক্রবার রাতে তিমির নন্দী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, “আমাদের সঙ্গে ফকির আলমগীর ছিল। ও ছোটবেলা থেকেই খুব ভালো বাঁশি বাজত। আমাদের অনুষ্ঠানে সে বাঁশিই বাজাত। গীতিনাট্যের চিত্রনাট্য লিখতেন অভিনেতা, নাট্যকার মামুনুর রশীদ, বিপ্লব দাস; সুরারোপ করতেন অনুপ ভট্টাচার্য।

“সেই সমস্ত গীতিনাট্য নিয়ে আমরা কলকাতা ও কলকাতার আশপাশে সীমান্তে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করেছি। অনুষ্ঠান করে যে পারিশ্রমিক পেতাম সেটা মুক্তিযুদ্ধ কল্যাণ তহবিলে দান করেছি। কলকাতার বাইরেও বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠানে যেতাম, ফকিরের সঙ্গেই থাকতাম। সেই সময় ফকিরের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা গাঢ় হয়েছে; আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল।”

স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে পাশ্চাত্য সংগীতের সঙ্গে দেশজ সুরের মেলবন্ধন ঘটিয়ে বাংলা পপ গানের বিকাশে মাতেন তরুণ শিল্পীদের একটি দল। আজম খান, ফিরোজ সাঁই আর ফেরদৌস ওয়াহিদের সঙ্গে ফকির আলমগীরও তখন পপ গানে উন্মাদনা ছড়িয়েছিলেন শ্রোতাদের মাঝে।

ফেরদৌস ওয়াহিদের সঙ্গে তার বন্ধুত্বের শুরুটা তখন থেকেই। পরে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা আরও গভীর হয়েছে।

বন্ধুর মৃত্যুর খবর শুনে শোকাতুর ফেরদৌস ওয়াহিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, “সবার সঙ্গে লোকটার বন্ধুসুলভ ভাব ছিল। প্রাণবন্ত একটা মানুষ ছিল। সে আমার বন্ধু ছিল। আর বাংলাদেশের এমন একজন গায়ক ছিল, যাকে আমি বাংলার সংগীতের বাঘ বলি।

“গণসংগীত বলতে যেটা বোঝায় সেই জায়গায় তেমন কেউ কাজ করেনি, কিন্তু ও করেছে। তার মৃত্যুতে গণসংগীতের জায়গাটা শূন্য হয়ে গেল। জায়গা কেউ ধরে রাখতে পারেনি আবার চেষ্টাও করেনি। ও একাই চালিয়ে নিয়ে গেছে।”

ফকির আলমগীরের গণমানুষের শিল্পী হয়ে ওঠার পেছনে বড় ভূমিকা ছিল যে গানের চরিত্রের, তার নাম সখিনা। ১৯৮২ সালে বিটিভিতে ঈদের আনন্দমেলায় ‘ও সখিনা গেছস কিনা ভুইলা আমারে’ গানটি প্রচারের পর দর্শকদের মাঝে সাড়া পড়ে যায়। গানটি লিখেছেন আলতাফ আলী হাসু। কণ্ঠ দেয়ার পাশাপাশি ফকির আলমগীর গানটির সুরও করেছিলেন।

পরে আশির দশকের শেষভাগে তিনি নিজেই লেখেন ‘চল সখিনা দুবাই যাব, দ্যাশে বড় দুঃখরে’। তার কণ্ঠের সেই গানটিও বেশ আলোচনার জন্ম দেয়।

সে সময়ের কথা স্মরণ করে তিমির নন্দী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভাঙা ভাঙা গলা নিয়ে ফকির আলমগীরের আফসোস ছিল। আমাকে বলত, দোস্ত এই গলায় গান গাইব কী করে?

“ও সখিনা’ গানটা তো খুব হিট করেছিল। সবাই ফকির আলমগীরের গানের খুব প্রশংসা করছিল। তাতে দেখলাম, গণসংগীত শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।”

২০১৬ সালে ফকির আলমগীর এক নিবন্ধে তার সেই সখিনার গল্প বলেছেন সবিস্তারে।

তিনি লেখেন, “সখিনা আবহমান বাংলার প্রেমিকা ও বধূ। কারও কাছে দুঃখিনী পল্লীবালা আবার কারও কাছে আহ্লাদী বোন। কারও কাছে সে বন্যায় ভেসে যাওয়া বিক্ষুব্ধ চিৎকার। এই সখিনা কখনো রিকশাওয়ালার প্রিয়তমা স্ত্রী। কখনও কারখানার শ্রমজীবী নারী, কখনও বা ফুটপাতের ইটভাঙা শ্রমিক।”

নব্বইয়ে সামরিক শাসনবিরোধী গণ-আন্দোলনে প্রতিবাদী গানে ফকির আলমগীরের সরব উপস্থিতি তাকে তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয়তার নতুন মাত্রায় নিয়ে যায়। তবে তার আগেই মাকে নিয়ে লেখা তার আরেকটি গান মানুষের মুখে মুখে ফিরত। ‘মায়ের একধার দুধের দাম’ গানটি সিনেমাতেও ব্যবহৃত হয়েছিল।

ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান

২০১৮ সালে এক সাক্ষাৎকারে ফকির আলমগীর বলেছিলেন সেই গানের পেছনের গল্প। ১৯৭৭ সালে মাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি গাড়িতে যাচ্ছিলেন ফরিদপুরে। আরিচা ঘাটে এক অন্ধ বাউলের কণ্ঠে প্রথম তিনি ওই গান শোনেন। তিনি এতটাই আপ্লুত হয়েছিলেন, যে ঢাকায় ফিরে নিজের মত করে গানটি তৈরি করেন। পরে বিটিভির এক অনুষ্ঠানে সেটি পরিবেশিত হয়।

‘মন আমার দেহ ঘড়ি’, ‘আহারে কাল্লু মাতব্বর’, ‘ও জুলেখা’, ‘ঘর করলাম না রে আমি’, ‘সান্তাহার জংশনে দেখা’,  ‘বনমালী তুমি’সহ তার গাওয়া বহু গান আশি ও নব্বইয়ের দশকে দারুণ জনপ্রিয় ছিল।

গানে গানে গণমানুষের কথা বলার প্রতিজ্ঞা থেকেই ফকির আলমগীর গেয়েছেন ‘ধোঁয়ায় ছেয়েছে গাজার আকাশ,; আবার সাভারের রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিও তার গানে এসেছে।

নেলসন ম্যান্ডেলার জন্মদিন উপলক্ষে গাওয়া একটি গান ছিল ফকির আলমগীরের নিজের কাছেই প্রিয়। ১৯৯৭ সালের মার্চে বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে নেলসন ম্যান্ডেলা যখন বাংলাদেশে এসেছিলেন, সে সময় তাকে নিয়ে লেখা সেই ‘কালো কালো মানুষের দেশে’ গানটি শুনিয়েছিলেন ফকির আলমগীর। 

ফকির আলমগীর সাংস্কৃতিক সংগঠন ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠাতা। গণসংগীত চর্চার আরেক সংগঠন গণসংগীত শিল্পী পরিষদের সভাপতি এবং সম্মিলিত সাংস্কৃতি জোটের সহ-সভাপতির দায়িত্বও তিনি পালন করেছেন।

গানের পাশাপাশি নিয়মিত লেখালেখির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন এই শিল্পী। ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও বিজয়ের গান’, ‘গণসংগীতের অতীত ও বর্তমান’, ‘আমার কথা’, ‘যারা আছেন হৃদয় পটে’সহ বেশ কয়েকটি বই প্রকাশ হয়েছে তার।

বাংলাদেশের গণসংগীতে অবদানের জন্য ১৯৯৯ সালে ফকির আলমগীরকে একুশে পদক দেয়। এছাড়া শেরেবাংলা পদক, ভাসানী পদক, জসীমউদ্‌দীন স্বর্ণপদক, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সম্মাননাও তিনি পেয়েছেন ।

স্ত্রী সুরাইয়া আলমগীর এবং তিন ছেলেকে রেখে গেছেন ফকির আলমগীর।