কার্লো গোলডনির নাটক ‘সারভেন্ট অব টু মাস্টারস’

. এস এম হুমায়ুন কবীরবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 June 2013, 04:43 AM
Updated : 16 June 2013, 04:46 AM

ভেনিসীয় নাট্যকার কার্লো গোলডোনির ‘ইল সারভিতোর দি দুও পাদ্রোনি’, ইংরেজি অনুবাদে ‘দি সারভেন্ট অব টু মাস্টার্স’ নাটকটি ঢাকার মঞ্চে নিয়ে এসেছেন তারিক আনাম খান। তাঁর দল নাট্যকেন্দ্র ২৪ জানুয়ারী প্রথমবার বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ‘দুই যে ছিল এক চাকর’ নামে সাধারণ দর্শকদের জন্য প্রদর্শন করেন। এরপর দু’একজন ব্যতিক্রম বাদে প্রতিমাসেই কমপক্ষে একবার এই নাটকটির প্রদর্শনী হয়ে গেছে। নাটকটিতে অভিনয় করেছেন, মাসুদ হাবিব, ইউসূফ হাসান অর্ক, মনামি ইসলাম কনক, শরীফ হোসেন ইমন,  আরিক আনাম খান, লুসি তৃপ্তি গোমেজ, নূরে আলম নয়ন, সাইফ আহমেদ এবং সংগীতা চৌধুরী।

গোলডোনি ১৭৪৩ সালে এই নাটকটি লেখেন ইটালি তথা তখনকার ইটালির বিখ্যাত অভিনেতা (আর্লকাঁ) আন্তনিয়ো সাচ্চো-র অনুরোধে। তারপর নানান রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ১৭৫৩ সালে চূড়ান্ত সংস্করণটি করা হয়। গোলডনির নাটক শুরু হয় বিয়াত্রিচ-এর পরিচিতির মাধ্যমে। বিয়াত্রিচ ভেনিসে এসেছে একটি মানুষকে খুঁজতে, যে তাঁর ভাইকে হত্যা করেছে| মানুষটির নাম ফ্লোরিন্দো আরেতুসি, যাকে আবার বিয়াত্রিচ ভালোবাসে। বোনের এই ভালোবাসায় তার মত ছিলনা। আর বোনের সম্মান রক্ষা করতে গিয়ে মারা যায় সে, ফ্লোরিন্দোর হাতেই। বিয়াত্রিচ তার মৃত ভাই ফ্রেদেরিগোর ছদ্মবেশ ধরে। ছদ্মবেশ ধরার কারণ ভেনিস শহরের পান্তালুন নামের একজন ব্যবসায়ীর কাছে বেশ টাকাপয়সা পেত তার ভাই। পান্তালুন আবার ক্লারিস-এর বাবা। ক্লারিস হলো আবার বিয়াত্রিচের মৃত ভাই ফ্রেদেরিগোর বাগদত্তা । এদিকে ফ্রেদেরিগোর মৃত্যুর খবর শুনে ক্লারিস অন্যজনের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে, যার নাম সিলভিয়ো। ছদ্মবেশি বিয়াত্রিচের উপস্থিতির পর ঘটনা মোড় নিতে থাকে। বিয়াত্রিচ চেষ্টা করে যাচ্ছিল টাকাপয়সা উদ্ধার করতে, যাতে সে সাহায্য করতে পারে ফ্লোরিন্দোকে| তাদের বিয়েটাও তাতে সহজ হতে পারে।

ভেনিস শহরে বিয়াত্রিচ একজন চাকর জোগাড় করে, যার নাম ত্রুফালদিনো, যে আসলে এই নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র| তিনি প্রচণ্ড রসিক একজন মানুষ। ত্রুফালদিনো ক্রমাগতভাবে অভিযোগ জানায় যে, তার পেট খালি, অনেক ক্ষুধা তার, এরকম অবস্থা যে, যা দেখবে তাই খেয়ে সে তার ক্ষুধা নিবারণ করবে। গোলডনির মূল টেক্সটে এক জায়গায় ত্রুফালদিনো তার মনিব বিয়াত্রিচের পছন্দের বেড়ালটিকেও খাওয়ার উপক্রম করেছিল। কাজেই যখন সে ফ্লোরিন্দোর সঙ্গেও কাজের সুযোগ পেল, তখন সে এটিকে আরI বেশি খাওয়ার সুযোগ হিসেবেই দেখলো।

ত্রুফালদিনোকে দৌড়ে বেড়াতে হয় ভেনিসের বিভিন্ন জায়গায়; দু’জন মনিবের ফরমায়েশে, চিঠিপত্র, টাকাপয়সা আদানপ্রদান ইত্যাদি কাজে। নানান সমস্যা তৈরি করে ত্রুফালদিনো এসব করতে গিয়ে। বিষয় আরও জটিল হয় যখন বিয়াত্রিচ আর ফ্লোরিন্দো একই হোটেলের ভিন্ন কক্ষে অবস্থান করে, আর একে অন্যকে খুঁজতে থাকে। পরিশেষে ক্লারিস আর তার চাকরাণী স্মেরালদিনার সহায়তায় বিয়াত্রিচ ও ফ্লোরিন্দো নিজেদের খুঁজে পায়। বিয়াত্রিচ নারী হিসেবে বেরিয়ে আসে ফ্রেদেরিগোর ছদ্মবেশ থেকে। ত্রুফালদিনো আর স্মেরালদিনার বিয়ে নিয়ে আলোচনা হয়। সেসময় আবিষ্কৃত হয় যে, সে দুজনেরই চাকর হিসেবে কাজ করেছে। তৎকালীন বিচারে এটি একটি অন্যায়; কিন্তু সে ক্ষমা পেয়ে যায় শেষে বিয়ে করারও অনুমতি পায়।

গোলডনির এই নাটক বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় অভিনীত হয়েছে তাদের নিজ নিজ ভাষায় I সংস্কৃতিতে অভিযোজিত হয়ে। উল্লেখ করা যেতে পারে, সোভিয়েত রাশিয়ায় ১৯৫৩ সালে, নেদারল্যান্ডস টেলিভিশনের জন্য হয়েছে ১৯৭৩ সালে, ১৯৭৬ সালে রাশিয়ান টিভির জন্য এই গল্প থেকে সিনেমা বানানো হয়েছে, চেক প্রজাতন্ত্রের প্রাগ-এ নিয়মিত প্রদর্শনী হয়েছে ১৯৯৪ থেকে প্রায় ১৫/১৬ বছর, ব্রাইটনে আর লন্ডনে হয়েছে ১৯৬০ থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে, আরও হয়েছে স্পেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৪ থেকে ২০১২ পর্যন্ত।

নাট্যকেন্দ্র গোলডনির এই নাটকটিকে নিজেদের মতো করে তৈরি করেছে। কাহিনীবিন্যাস প্রায় একই রকম। ক্রুফালদিনোর বাঙালি নাম হয়েছে তৈমুর মিয়া, যার বাড়ি ফৈজাবাদ; বিয়াত্রিচ হয়েছে মেহেরুন্নিসা দস্তগীর; মৃত ফ্রেদেরিগো হয়েছে আবদুল্লাহ দস্তগীর, যার বেশে মেহেরুন্নিসা হাজির হয়। সিলভিয়োর বাবা ড. লোমবার্ডি এখানে আসেন হেকিম জং বাহাদুর হিসেবে, যিনি বরাবর বেশি কথা বলেন আর কথায় কথায় ভারতীয় শাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি দেন। সিলভিয়োর নাম এখানে সেলিম, যে শেষ পর্যন্ত ক্লারিস মানে আনারকলিকে বিয়ে করতে সক্ষম হয়, যখন মেহেরুন্নিসা তার আসল পরিচয়ে বেরিয়ে আসে। মেহেরুন্নিসার মিলন হয় ফ্লোরিন্দো মানে শাহবাজ আলি খাঁর সঙ্গে, যদিও সে তার ভাইয়ের হত্যাকারী।

নাট্যকেন্দ্রর এই প্রযোজনাটিতে মূল নাটকের কাহিনীবিন্যাস একইরকম আছে; যদিও চরিত্রসমূহের নামকরণ মুসলিমদের নামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই করা হয়েছে আর জায়গার নাম শুনে মনে হয়েছে পারস্যদেশের কোনো প্লট। নাটকে বেশ কয়েকটি লোকগানের ব্যবহার আছে, যেখানে মূলগানের মেলডি হারিয়ে হয়ে গেছে একরকম আধুনিক সংস্করণ। তৈমুরের কণ্ঠে ‘খাবো খাবো করছে আমার পাগলা মন’ গানটি অসাধারণ কম্পোজিশন করা হয়েছে, যার কথা লিখেছেন সংগীতা চৌধুরী| সেইসঙ্গে করা হয়েছে বিখ্যাত কোরিয়ান কম্পোজিশন গ্যাংনাম স্টাইলের দেশীয় রূপ; এতে করে দর্শকরা পেয়েছে ভীষণ আনন্দ। মুখোশ ব্যবহার করে হ্যালুসিনেশনের শৈল্পিক রূপায়ন নির্দেশক খুব নিপুণভাবে করেছেন। লোকগানের সঙ্গে মডার্ন ডান্সের অদ্ভূত সমন্বয় দেখা গেছে চমৎকার কোরিওগ্রাফি। তারিক আনাম খান ২৬০ বছর আগের ইটালীয় একটি নাটককে জীবন্ত করেছেন আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে। ঠাট্টাচ্ছলে তিনি দেখিয়েছেন, ভাইয়ের হত্যাকারীকে বিয়ে করতে মেহেরুন্নিসার কোনো নীতিবোধে পীড়া দেয় না। অন্যদিকে একজন চাকর যদি দুই মনিবের কাজ করে, সেটি হয়ে যায় অন্যায়| মেহেরুন্নিসা সেই অপরাধে চাকরকে মারতে আসে ধারালো অস্ত্র নিয়ে। ভারতীয় তথা বাঙালি নীতিবোধের কোন দিকটার দিকে তাকিয়ে গোলডনির মাধ্যমে তিনি এরকম বিশেষ একটি ইঙ্গিত করলেন, তা নিয়ে ভাবনার খোরাক রয়েছে।