আলমগীর কবির-বুলবুল আহমেদ: শিল্পসার্থক ছবির স্রষ্টা যে জুটি

একজন পরিচালকের স্বপ্ন থাকে তিনি যে ছবিটি নির্মাণ করবেন তাতে এমন একজন অভিনয় করবেন যিনি পরিচালকের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পারেন। আর অভিনেতার স্বপ্ন থাকে এমন একজন পরিচালকের ছবিতে কাজ করার যিনি তার ভিতরের অভিনয় প্রতিভাকে পর্দায় তুলে আনবেন শিল্পসার্থক রূপে।

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 July 2015, 02:31 PM
Updated : 14 July 2015, 02:31 PM

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অভিনেতা বুলবুল আহমেদ এবং পরিচালক আলমগীর কবির জুটির মিলিত প্রয়াসে সৃষ্টি হয়েছে এমনই কয়েকটি শিল্প সার্থক চলচ্চিত্র। তাদের এই সৃষ্টি  বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ক্ল্যাসিকের মর্যাদা পেয়েছে।

মাত্র পঞ্চাশ বছর বেঁচে ছিলেন আলমগীর কবির। এই ক্ষণস্থায়ী জীবনেই তিনি নির্মাণ করেন এমন কয়েকটি চলচ্চিত্র যা আজও এ দেশের দর্শককে ভাবায়, অনুপ্রাণিত করে।

১৯৭৩ সালে আলমগীর কবির নির্মাণ করেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘ধীরে বহে মেঘনা’। সে ছবিতে ছোট একটি ভূমিকায় ছিলেন বুলবুল আহমেদ। বুলবুল আহমেদও তখন চলচ্চিত্র জগতে মাত্র প্রবেশ করেছেন ‘ইয়ে করে বিয়ে’ ছবিতে ছোট একটি চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে। নবীন পরিচালক ও নবীন অভিনেতার মধ্যে বন্ধুত্ব জমে ওঠে। পরস্পরের কাজের ভক্ত হন তারা।

১৯৭৫ সালে আলমগীর কবির নির্মাণ করেন তার দ্বিতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র ‘সূর্য কন্যা’। কাহিনি, চরিত্রচিত্রণ, সংলাপ, সংগীত, সর্বোপরি পরিচালনার দিক থেকে ছবিটি ছিল সুনির্মিত ও ব্যতিক্রমী। গতানুগতিক বাণিজ্যিক ছবি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ধাঁচের ‘সূর্যকন্যা’ বাণিজ্যিক সফলতা ও সমালোচকদের উচ্চ প্রশংসা দুটোই পেয়েছিল। এ ছবিতে নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেন বুলবুল আহমেদ।‘সূর্যকন্যা’র নায়ক ভাস্কর, কল্পনাপ্রবণ লেনিন চৌধুরীর চরিত্র অত্যন্ত সার্থকভাবে পর্দায় তুলে ধরেন বুলবুল। লেনিন চৌধুরী বাণিজ্যিক ধারার ফর্মুলা-নায়কদের মতো নন একেবারেই। তিনি মারপিট জানেন না, পরীক্ষায় প্রথমও হন না কিংবা গান গাইতে বা নাচতেও জানেন না। মধ্যবিত্ত পরিবারের এক তরুণ যিনি স্বপ্ন দেখেন, সমাজতন্ত্র ও নারী অধিকার নিয়ে ভাবেন, যিনি শিল্পী, যিনি কল্পনাপ্রবণ—এমন একটি চরিত্রে আলমগীর কবিরের প্রয়োজন ছিল পরিশীলিত ব্যক্তিত্বের এক অভিনেতাকে। আর চরিত্রের এই দাবি পুরোপুরি মিলে গিয়েছিল বুলবুল আহমেদের মধ্যে। ছবিটিতে দেখা যায় কল্পনাপ্রবণ শিল্পী লেনিন নিজের তৈরি একটি ম্যানিকুইনের প্রেমে পড়ে। ‘সূর্যকন্যা’য় লেনিনের চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে সে সময় বাংলাদেশে দ্বিতীয় কোনো অভিনেতা ছিলেন না। এই চলচ্চিত্রের দুটি গান ‘আমি যে আঁধারের বন্দিনী’ এবং ‘চেনা চেনা লাগে তবু অচেনা’ দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। এই চলচ্চিত্রের  জন্য আলমগীর কবির শ্রেষ্ঠ পরিচালক ও শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও লাভ করেন জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার। আর ‘সূর্যকন্যা’র মুক্তির পর বুলবুল আহমেদ ঢাকার চলচ্চিত্রে নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা ও বিপুল জনপ্রিয়তা পান।

আলমগীর কবির ও বুলবুর আহমেদ জুটির পরবর্তী ছবি ‘সীমানা পেরিয়ে’। ‘সীমানা পেরিয়ে’ মুক্তি পায় ১৯৭৭ সালে। এ ছবিতে ধনিক শ্রেণি ও শ্রমজীবী শ্রেণির মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং সেই দ্বন্দ্ব অতিক্রমের গল্প বলা হয়েছে। সমুদ্র উপকূলে জলোচ্ছ্বাসের পর একটি নির্জন দ্বীপে আটকে পড়া টিনা (জয়শ্রী কবীর) এবং কালু (বুলবুল আহমেদ) কীভাবে নিজেদের শ্রেণিগত সংস্কার ত্যাগ করে পরস্পরকে ভালবাসে তার উপাখ্যান ‘সীমানা পেরিয়ে’। একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে ছবিটি নির্মাণ করেন আলমগীর কবির। ১৯৭০ সালের প্রলয়ংকরী জলোচ্ছ্বাসের পর বরিশালের দক্ষিণে একটি দ্বীপে আটকে পড়া দুজন নারী পুরুষের খোঁজ পাওয়া যায়। তারা আদিম মানব-মানবীর মতো প্রতিকূল প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচেছিলেন। ঘটনাটি সে সময় সংবাদপত্রে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এ ছবির সংগীত পরিচালনা করেছিলেন ভূপেন হাজারিকা।‘মেঘ থম থম করে’ এবং ‘বিমূর্ত এই রাত্রি আমার’ গান দুটি বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম সেরা গান হিসেবে আজও দারুণ জনপ্রিয়। এ চলচিত্রের সংলাপ ও চিত্রনাট্যকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান আলমগীর কবির। বুলবুল আহমেদ পান শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার।

১৯৭৯ সালে মুক্তি পায় এই জুটির আরেকটি ছবি ‘রূপালি সৈকতে’। এ চলচ্চিত্রটিও সমালোচকদের প্রশংসা এবং ব্যবসায়িক সাফল্য পায়। ছবিটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস)পুরস্কার পায়।

১৯৮৫ সালে নির্মিত হয় ‘মহানায়ক’। এটি আলমগীর কবিরের শেষ নির্মাণ। এটি প্রযোজনা করেছিলেন বুলবুল আহমেদ। ছবিটির কাহিনিও ছিল ব্যতিক্রমী। এ ছবিও বাণিজ্যিক সাফল্য পেয়েছিল।

আলমগীর কবির দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন ১৯৮৯ সালে আর বুলবুল আহমেদ ২০১০ সালের ১৪ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। আমাদের চলচ্চিত্রজগতের এই দুই মহান ব্যক্তিত্বের ছবিগুলো আজও বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে সুঅভিনয় ও ব্যতিক্রমী কাহিনির মাধ্যমে শিল্পসার্থক চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রেরণা দেয়।