বাঙালির প্রাণের ছবি
শান্তা মারিয়া, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published: 14 Apr 2015 09:29 AM BdST Updated: 14 Apr 2015 09:29 AM BdST
পুঁথিপাঠ, যাত্রা, পালাগান, কবির লড়াই, গাজন, কীর্তন, ইত্যাদি আবহমান কাল থেকে ছিল বাঙালির প্রধান বিনোদন। পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয় বায়স্কোপ। পরবর্তীতে যখন সিনেমার প্রচলন হয় তখনও প্রবীণরা একে বায়স্কোপ বলতেন।
বাংলা সিনেমা দীর্ঘকাল ধরে নির্মিত হয়েছে যাত্রার ঢঙে। পাকিস্তান আমলে পূর্ববঙ্গে উর্দু সিনেমা রমরমা ব্যবসা করতো। সে সময় বাঙালির জাতীয় চেতনার উন্মেষ ও বাংলা ভাষা প্রীতির কারণে সাহসী বাঙালি পরিচালকরা এগিয়ে আসেন বাংলা ভাষায় ছবি নির্মাণে। উর্দু সিনেমার চটক আর খোলামেলা নাচ-গানের জন্য অনেক সময় বাংলা ছবি ভালো ব্যবসা করতে পারতো না। সে সময় বাঙালি পরিচালকরা এমন ছবির নির্মাণে আগ্রহী হন যা বাঙালিকে আকর্ষণ করবে তার শিকড়ের দিকে। লক্ষণীয় যে, সে সময় জাতীয় জীবনের অন্যান্য দিকেও বাঙালি গুরুত্বের সঙ্গে তারআপন শিকড়ের সন্ধানে প্রবৃত্ত হতে থাকে। পহেলা বৈশাখ উদযাপন নতুনভাবে শুরু হয় ঢাকায়। সে চিন্তা থেকেই পরিচালক সালাউদ্দিন নির্মাণ করেন লোককাহিনিভিত্তিক ছবি ‘রূপবান’।
১৯৬৫ সালে মুক্তি পায় 'রূপবান'। আবহমানকাল থেকে বাংলার সুপরিচিত এ রূপকথাটি সেলুলয়েডে দেখার জন্য প্রেক্ষাগৃহে ভিড় জমে। এ ছবিতে রূপবান চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সুজাতা, রহিম বাদশাহর ভূমিকায় মনসুর এবং রাজকন্যা তাজেলের চরিত্রে চন্দনা। ছবিটির সংগীত পরিচালক হিসেবে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন সত্য সাহা। তিনি রূপবানের যাত্রা পালা থেকে প্রচলিত গানগুলো ব্যবহার করেন যাতে লোকজ আবহ অক্ষুণ্ণ থাকে। পুরো ছবিটি নির্মিত হয়েছিল যাত্রাপালার ঢংয়ে। ফলে এটি ছিল লোকজ কাহিনির সরলতা ও সৌন্দর্যের বিশ্বস্ত চিত্রায়ন।
'রূপবান'-এর তুমুল জনপ্রিয়তার ফলে লোককাহিনি নিয়ে সিনেমা নির্মাণে উৎসাহী হন আরও অনেক পরিচালক। সফদার আলী ভূঁইয়ার পরিচালনায় ১৯৬৬ সালের মার্চে মুক্তি পায় ‘রহিম বাদশাহ ওরূপবান’। এ ছবিটিও দারুণ ব্যবসা সফল হয়। সে বছর এপ্রিলে ইবনে মিজানের পরিচালনায় মুক্তি পায় ‘আবার বনবাসে রূপবান’। রূপবানের ব্যবসায়িক সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে সে বছর আরও মুক্তি পায়সৈয়দ আউয়াল পরিচালিত ‘গুনাই বিবি’, বজলুর রহমান পরিচালিত ‘গুনাই’, আলি মনসুর পরিচারিত ‘মহুয়া’, জহির রায়হান পরিচালিত ‘বেহুলা’ এবং ইবনে মিজান পরিচালিত ‘জরিনা সুন্দরী’। এর মধ্যে জহির রায়হান পরিচালিত ‘বেহুলা’ ছবিটিতে আত্মপ্রকাশ করেন নতুন জুটি সুচন্দা-রাজ্জাক। 'বেহুলা' শুধু লোককাহিনিভিত্তিকই ছিল না এর মধ্য দিয়ে বাঙালি নারীর চিরন্তন আবেগ ও আত্মত্যাগ প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সঙ্গে পরিচালকের মুন্সীআনায় ছবিটি হয়ে উঠেছিল আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির দলিল। ‘বেহুলা’ ছবিতে বাংলার গ্রাম জীবনের অনেক ঐতিহ্যবাহী অনুষঙ্গ ধারণ করা হয়েছিল সেলুলয়েডের ফিতায়।

১৯৬৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘কাঞ্চনমালা’, ১৯৬৮ সালে ‘সাত ভাই চম্পা’ ব্যবসা সফল হয়। ‘সাত ভাই চম্পা’ গল্পটি একটি সুপরিচিত রূপকথা। সাত ভাইয়ের এক বোন পারুলের ভূমিকায় কবরী ছিলেন অনবদ্য। বস্তুত পুরো সিনেমা ছিল রাজকন্যা পারুল ও তার প্রেমিক রাজপুত্র কেন্দ্রিক। নায়ক রাজপুত্রের ভূমিকায় ছিলেন সে সময়ের জনপ্রিয় নায়ক আজিম। ‘ফুলরূপী’ রাজপুত্র অর্থাৎ পারুলের ভাইদের তেমন কোনো ভূমিকা অবশ্য ছিল না ছবিটিতে। ‘সাতভাই চম্পা'র দারুণ জনপ্রিয়তা আবারও লোককাহিনিভিত্তিক সিনেমা তৈরিতে জোয়ার নিয়ে আসে। ১৯৬৯ সাল থেকে স্বাধীনতার আগপর্যন্ত মুক্তিপ্রাপ্ত লোককাহিনিভিত্তিক সিনেমা হল ‘সুয়োরানী দুয়োরানী’, ‘কুচবরণ কন্যা’, ‘অরুণ বরুণ কিরণ মালা’, ‘রূপবানের রূপকথা’, ‘পারুলের সংসার’, ‘গাজী কালু চম্পাবতী’, ‘পাতালপুরীররাজকন্যা’, ‘বেদের মেয়ে’, ‘মলুয়া’, ‘আমির সওদাগর ও ভেলুয়া সুন্দরী’ ইত্যাদি।
স্বাধীনতার পর লোককাহিনিভিত্তিক সিনেমা নির্মাণের ধারা অব্যাহত থাকে এবং ছবিগুলোর অধিকাংশই ব্যবসাসফল হয়। এসব ছবির মধ্যে ‘কমল রানীর দীঘি’, ‘নিমাই সন্ন্যাসী’, ‘লালন ফকির’, ‘গোপালভাঁড়’, ‘মালকাবানু’, ‘কাজল রেখা’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এসব সিনেমার অধিকাংশই ছিল ব্যবসাসফল।
এই ধরনের সিনেমার সফল নায়ক-নায়িকা ছিলেন আজিম, সুজাতা, কবরী, আনোয়ার হোসেন, শাবানা, রাজ্জাক, নার্গিস, ফারুক, ববিতা এবং আরও অনেকে। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে এবং আশিরদশকে হিন্দি সিনেমার আদলে অনেক সিনেমা নির্মিত হতে থাকে এবং লোকজ কাহিনিনির্ভর সিনেমা নির্মাণের ধারা কমে আসে। সে সময় ‘ফোক ফ্যান্টাসি’ নাম দিয়ে যে উদ্ভট কিছু সিনেমা নির্মিত হয় তার কথাএখানে বলা হচ্ছে না। কারণ এগুলোর বেশির ভাগই লোককাহিনি নির্ভর নয়। সেসব ছবিতে বাংলার ঐতিহ্য, সংস্কৃতির কিছুই প্রতিফলিত হয়নি।
লোককাহিনির অনুকরণ করে উদ্ভট পোশাক, সংলাপ, অশালীন নাচ-গানের এক জগাখিচুড়ি ছিল সেগুলো। অনেকগুলোতে আবার নাগনাগিনী ইত্যাদি কাহিনি ব্যবহৃত হয় যা লোককাহিনি নির্ভর নয়।
তবে ১৯৮৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘রাধাকৃষ্ণ’ এবং ‘রাই বিনোদিনী’ সিনেমা দুটি বৈষ্ণব পদাবলীতে বর্ণিত রাধা-কৃষ্ণের কাহিনিনির্ভর। সিনেমা দুটি ব্যবসা সফলও হয়েছিল। সিনেমার গান হিসেবে রাধারমণের একটি জনপ্রিয় গানকেও ব্যবহার করা হয়েছিল।

১৯৮৯ সালে নির্মিত হয় ‘বেদের মেয়ে জোসনা’। তোজাম্মেল হক বকুল পরিচালিত এবং অঞ্জুঘোষ, ইলিয়াস কাঞ্চন অভিনীত সিনেমাটি বাংলাদেশের ব্যবসাসফল সিনেমার অন্যতম উদাহরণ হয়ে আছে এখনও।এই সিনেমার মূল কাহিনি বহুযুগ থেকেই বাংলায় প্রচলিত ছিল। তবে সিনেমার প্রয়োজনে লোককাহিনিকে কিছুটা পরিবর্তিত করা হয়। সিনেমাটিতে বেদে সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রাও দেখনো হয়। সিনেমাটির বিপুল জনপ্রিয়তার ফলে এটি পশ্চিমবঙ্গে রিমেইক হয়। বাংলাদেশের ছবিটিতে ইলিয়াস কাঞ্চন অঞ্জুঘোষ আর পশ্চিমবঙ্গের সিনেমায় চিরঞ্জীব-অঞ্জুঘোষ অভিনয় করেন।
‘বেদের মেয়ে জোসনা’র সাফল্য দেখে আবার কয়েকটি সিনেমা নির্মিত হয় যেগুলো মোটেই লোককাহিনি নির্ভর নয়। বরং তার অক্ষম অনুকরণ।
পরবর্তীতে নির্মিত লোককাহিনিনির্ভর চলচ্চিত্র ‘খায়রুন সুন্দরী’ দারুণ ব্যবসা সফল হয়। ২০০৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন মৌসুমী ও ফেরদৌস। এ কে সোহেল পরিচালিত ছবিটি লোকজ জীবনের বিভিন্ন অনুষঙ্গ তুলে ধরেছে।
লোককাহিনি ভিত্তিক চলচ্চিত্রগুলো চিরসবুজ। তারা বাংলার সমৃদ্ধ লোক কাহিনির চিত্রায়ণ এবং বাঙালির প্রাণের ছবি।
সর্বাধিক পঠিত
- বদলি করা হল চট্টগ্রামের মানবিক পুলিশ ইউনিটের শওকতকে
- পৃথ্বী ১৫২ বলে ২২৭, রেকর্ডের ছড়াছড়ি
- ইংল্যান্ড বাদ, ড্র করলেই ফাইনালে ভারত
- মেসির সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাব: মাসচেরানো
- পদ্মায় রেল সংযোগ: চীনা ঠিকাদারের কথা উড়িয়ে দিলেন রেলমন্ত্রী
- দেশে ফিরে হুইল চেয়ারে চড়ে গাড়িতে উঠলেন ফখরুল
- ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বন্দি মুশতাকের কারাগারে মৃত্যু
- স্পিন স্বর্গে ২ দিনেই ইংল্যান্ডকে হারাল ভারত
- ছক্কার রেকর্ডে রোহিতকে ছাড়িয়ে গাপটিল
- যেভাবে গ্রাহকের টাকা হাতিয়েছিলেন এক ব্যাংক কর্মকর্তা