‘ওরা ১১ জন’: স্বাধীনতার প্রথম পূর্ণাঙ্গ আলেখ্য

“এই সেই ১১ জন। ওরাই তবে সেই রাজকুমার। যারা ‘বাংলাদেশ’ নামের রাজকন্যাটিকে বহু বছর ধরে আটকে রাখা পাকিস্তানি রাক্ষসদের হাত থেকে মুক্ত করে নিয়ে এসেছে।”- কথাটি ‘ওরা ১১ জন’ সিনেমার অভিনেত্রী কেয়ার।

সেঁজুতি শোণিমা নদীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 March 2015, 05:36 AM
Updated : 26 March 2015, 05:37 AM

চাষী নজরুল ইসলামের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য এই চলচ্চিত্রে কেয়ার ভূমিকা ছিল একজন নারী মুক্তিযোদ্ধার। শুটিং-এর প্রথম দিনে তার সহশিল্পীদের সঙ্গে পরিচয়ের স্মৃতি তুলে ধরতে তিনি বলেছিলেন এই কথাগুলো।

অভিনেত্রী কেয়ার কথাগুলোকে নিছক ভাবাবেগের বশে বলে ফেলা প্রশংসাবাণী মনে করলে ভুল হবে। কারণ, সত্যিকার অর্থেই স্বাধীন বাংলাদেশে তৈরি হওয়া মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রথম সিনেমা ‘ওরা ১১ জন’-এর ১১ জন কলাকুশলী ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। রণাঙ্গনের সম্মুখসমরে জয়ী হয়েই তারা ছিনিয়ে এনেছিলেন এদেশের স্বাধীনতা।

১৯৭২ সাল। সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশে তখন সমস্যার অন্ত নেই। পাকিস্তানিদের সঙ্গে নয় মাস লড়াইয়ের দগদগে ক্ষত দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে। যুদ্ধের বিভীষিকা থেকে তখনও মুক্তির অপেক্ষায় থাকা জনগণের অনেকের পেটেই ভাত নেই। এরকম সময়ে সিনেমা? তাও আবার মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করেই?

সেই সাহসটাই দেখিয়েছিলেন প্রয়াত নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলাম। বিজয় অর্জনের এক সপ্তাহের মধ্যেই তিনি নেমে পড়েন ‘ওরা ১১ জন’ নির্মাণের কাজে। অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে তুলে ধরা কালোত্তীর্ণ এই সিনেমার কারণেই চিরদিন অমর হয়ে থাকবেন একুশে পদকজয়ী এই নির্মাতা।

নিজের জবানীতে চাষী নজরুল ইসলাম অনেকবার বলেছেন, যুদ্ধের সময়েই তিনি ঠিক করে রেখেছিলেন, বেঁচে থাকলে একদিন তৈরি করবেন স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে চলচ্চিত্র। ‘ওরা ১১ জন’-এর মাধ্যমে নিজের সেই প্রতিজ্ঞা পূরণ করেছিলেন তিনি!

ত্রিশ লাখ শহীদের এই যুদ্ধে পাকিস্তানের নৃশংস গণহত্যার করুণ ইতিহাস উঠে আসে ‘ওরা ১১ জন’-এ। এর মধ্যেই বাঙ্গালির আত্মত্যাগ, অন্যায়ের বিরূদ্ধে মাথা নত না করা, গেরিলা যোদ্ধাদের বীরত্ব বাস্তবানুগভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন চাষী নজরুল ইসলাম। সেই সঙ্গে এদেশীয় দালালদের পাকিস্তানিদের পদলেহনের ঘৃণ্য ইতিহাস ও তার পরিণতিও দেখানো হয়েছে সিনেমাটিতে। এছাড়াও, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক অধিকাংশ সিনেমাতেই যে বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে যায়- যুদ্ধে নারীর সেই অবদানকেও সরাসরি তুলে আনে এই সিনেমা। কেবল বীরাঙ্গনা হিসেবে নারীর আত্মত্যাগই নয়, যুদ্ধের ময়দানে পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নারীদের লড়াইয়ের চিত্রও উঠে এসেছে ‘ওরা এগারো জন’-এ।

“আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ বপিত হয়েছিল ১১ দফা ছাত্র আন্দোলন থেকে, যা পরবর্তীকালে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়। তাছাড়া আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ১১ জন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। এই চিন্তা থেকে সবার সম্মতিক্রমে ছবির নাম নির্বাচিত হল ‘ওরা ১১ জন’।” - একবার এক সাক্ষাৎকারে সিনেমাটির নামকরণ সম্পর্কে এমনটাই জানিয়েছিলেন চাষী নজরুল ইসলাম।

সিনেমার নামের মতোই এর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নানা দৃশ্যে নানা রূপকের ব্যবহার কুশলতার সঙ্গেই ঘটিয়েছেন পরিচালক। সিনেমার শুরুতে ছয়টি কামানের শব্দ ব্যবহার করা হয়েছিল। নির্মাতার ভাষ্যে, ওগুলো ছিল ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের ছয় দফার প্রতীক। ‘ওরা ১১ জন’-এর শুরু সাইফুল ইসলামের কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত ‘ও আমার দেশের মাটি’ দিয়ে। আর শেষ সাবিনা ইয়াসমিনের ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ দিয়ে। দেশপ্রেম থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের গাঁথাই যেন গান দুটি দিয়ে বোঝাতে চেয়েছিলেন নির্মাতা।

সিনেমার ১১ জনের মুক্তিবাহিনির প্রত্যেক সদস্যই যে সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, সে কথা বলা হয়েছে আগেই। খসরু, মুরাদ, হেলাল, বেবি, নান্টু, ওলীন, মঞ্জু, আতা, ফিরোজ, আবু, আলতাফ- শেষের জন বাদে এদের কারোরই ছিল না অভিনয়ের কোন প্রশিক্ষণ। তারপও কিছু দৃশ্যে সংলাপের জড়তা ছাড়া, সিনেমার নব্বই শতাংশেই এঁদের দৃঢ় উপস্থিতি আন্দোলিত করে দর্শকদের।

সিনেমাটিতে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধার অভিনয় সম্পর্কে চলচ্চিত্র সমালোচক চিন্ময় মুৎসুদ্দীর মূল্যায়ণ, “যুদ্ধের সময়কার ‘দুর্জয়-শপথে দৃপ্ত বাংলাদেশ’- এর ছবিই যেন মূর্ত হয়ে ওঠে এই ১১ জনের মধ্যে। আবেগ-তাড়িত দর্শক নিজেকেই খুঁজে পায় তাদের মধ্যে। পরিচালকের কৃতিত্ব এখানেই।”

চাষী নজরুল ইসলাম যে সিনেমায় কেবল সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়েই অভিনয় করিয়েছেন, তা নয়। যুদ্ধের দৃশ্যগুলিতে সত্যিকারের অস্ত্র এবং গোলাবারুদের ব্যবহার করেছিলেন। নির্মাতার ছবিটিকে বাস্তবঘনিষ্ঠ করে তোলার আরেকটি প্রয়াস দেখা যায় যুদ্ধকালীন নিউজ ফুটেজ ব্যবহারে। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ, গণহত্যার ছবি, শরণার্থী শিবিরের দিকে মানুষের ছুটে চলা, পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ এবং জনগণের বিজয়োল্লাস- সবকিছুরই একদম প্রথম দিককার এবং বিরল কিছু নিউজরিল কুশলতার সঙ্গে এই সিনেমায় দেখানো হয়েছে। নতুন প্রজন্মের জন্য মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের দালিলিক প্রমাণ হিসেবেও তাই সিনেমাটি বিবেচিত হবে সবসময়।

সিনেমার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা। ‘ওরা ১১ জন’-এর পুরোটা জুড়েই পুরুষের পাশাপাশি রণাঙ্গনে নারীর ভূমিকাকে দেখানো হয়েছে সমানভাবে।

সিনেমার অন্যতম চরিত্র, মুক্তিযোদ্ধা খসরুর বোন, মেডিকেল ছাত্রী মিতার ভূমিতায় অভিনয় করেছিলেন শাবানা; যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই প্রত্যন্ত গ্রামে চলে যায় যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করতে। সেখানেই পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নিগৃহীত হতে হয় তাকে। ধর্ষণের গ্লানি বয়েও শেষ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবাতেই নিয়োজিত থাকে সে।

ওই একই গ্রামে বাস করে কেয়া। খসরুর অধীনে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে গোপনে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয় সে। অস্ত্রের পশিক্ষণপ্রাপ্ত কেয়া যখন জানতে পারে তার নিজের বাবাই গ্রামের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান, তখন চোখে জল এলেও বাবাকে গুলি করে মেরে ফেলতে দ্বিধা করে না সে। পাকিস্তানিদের আক্রমণ শুরু হলে পুরুষ সহযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই মেশিনগান চালায়।

সেবিকা, যোদ্ধা- এই দুই চরিত্রের পাশাপাশি নিপিড়িতা, নিগৃহিতার চরিত্রেও নারীকে দেখিয়েছেন পরিচালক। খসরুর বাগদত্তা শীলাকে (নূতন) যেমন দেখা যায় যুদ্ধ শেষে বন্দিশিবির থেকে মুমুর্ষ অবস্থায় খসরুর কোলে লুটিয়ে পড়ে প্রাণত্যাগ করতে। স্বাধীনতা যুদ্ধে দুই লাখ নারীর সম্ভ্রম বিসর্জনের ইতিহাসই যেন এক নিমেষে উঠে আসে দৃশ্যটির মাধ্যমে।

সেইসঙ্গে বীরাঙ্গনাদের প্রাপ্য সম্মান দেওয়ার বিষয়টিও সিনেমার শেষের অংশে তুলে ধরেছেন নির্মাতা। দীর্ঘদিন পাকিস্তানিদের অত্যাচার সওয়া পারভেজ ফিরে এসে যখন জানতে পারে, তার প্রেমিকা মিতার সম্ভ্রমহানীর কথা, তখন ঘৃণায় দূরে ঠেলে দেওয়ার পরিবর্তে ভালোবাসা দিয়ে প্রেয়সীকে বুকে টেনে নেয় সে।

পারভেজের চরিত্রে সিনেমাটিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা নায়করাজ রাজ্জাকের অভিনয় ছিল এককথায় অনবদ্য।

রাজ্জাক, শাবানার পাশাপাশি পার্শ্ব-চরিত্রগুলোতে নিজেদের কুশলতার পরিচয় রেখেছেন আলতাফ, হাসান ইমাম, রওশন জামিল, সুমিতা দেবী, মিনারা জামান, এ টি এম শামসুজ্জামানের মতো অভিনয়শিল্পীরা। বিশেষ করে সন্তানকে একবার দেখবার আশায় পথ চেয়ে থাকা গেরিলার চরিত্রে আলতাফ, যুদ্ধে নিজের বড় ছেলেকে হারিয়ে ছোট ছেলেকেও মুক্তিবাহিনির হাতে সঁপে দেওয়া মায়ের চরিত্রে রওশন জামিল আর ধূর্ত, স্বার্থান্বেষী কিন্ত একইসঙ্গে কাপুরুষ রাজাকারের চরিত্রে এ টি এম শামসুজ্জামানের অভিনয় মনে রাখার মতো।

যুদ্ধের মতো করুণ এবং জটিল একটি বিষয়ের উপস্থাপনেও দর্শকেরা যাতে হাঁপিয়ে না ওঠে, সেদিকে দৃষ্টি ছিল পরিচালকের। সিনেমাটিক রিলিফ হিসেবেই তাই হয়তো তিনি বার বার অবতারণা করেছেন হাস্যরসের। জনতার ধাওয়ায় পাকিস্তানি সৈন্যের পানিতে পড়ে যাওয়া কিংবা, ঝোপের আড়ালে গরুর শব্দ শুনেই মুক্তিবাহিনি ভেবে রাজাকারদের ভয়ে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার দৃশ্যগুলো তাই প্রশংসার দাবিই রাখে।

সিনেমা দীর্ঘ হলেও, এর গল্পকাঠামো, সংলাপ আর বক্তব্যের কারণেই ‘ওরা ১১ জন’ শেষ পর্যন্ত দেখার দাবি রাখে। ত্রুটিমুক্ত না হলেও বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে নতুন এক ধারার পথিকৃত হিসেবে এই সিনেমা সবসময়ই থাকবে উচ্চাসনে। স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রথম এবং পূর্ণাঙ্গ এই চলচ্চিত্রের জনক হিসেবে নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলামের স্মৃতিও তাই চির অম্নান হয়েই থাকবে সিনেমাপ্রেমীদের মনে।