প্রসঙ্গ নারী নির্মাতা: বেড়েছে রক্ষণশীলতা?

আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপনের শত বছর পেরিয়েছে আর বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছে চার দশকেরও বেশি সময় আগে। কিন্তু আজও বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কর্ত্রী হয়ে উঠতে পারেননি নারীরা।

চিন্তামন তুষারচিন্তামন তুষারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 March 2015, 05:44 AM
Updated : 8 March 2015, 05:52 AM

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নারী ও পুরুষ যোদ্ধারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই লড়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশের জন্মের ৪৪ বছর পর দেখা যাচ্ছে সাস্কৃতিক জগতের নেতৃত্ব প্রদানে নারীদের অংশগ্রহণ শূন্যের কোঠায়। 

উন্নয়ন হয়েছে, ক্ষমতায়ন হয়নি

চলচ্চিত্র জগতে বিচরণের দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ কোহিনুর আখতার সুচন্দা। জহির রায়হানের উপন্যাস ‘হাজার বছর ধরে’ অবলম্বনে তিনি নির্মাণ করেন একই নামের সিনেমা। ২০০৫ সালে এটি মুক্তি পায়।

তিনি বলেন, “আমার সিনেমার কাহিনি নারীকেন্দ্রিক। নারী নির্যাতন, বাল্য বিবাহ ইত্যাদি দেখিয়েছি সিনেমাটিতে এবং এটা হাজার বছর ধরে চলে আসছে, এখনও হচ্ছে। সেগুলো আস্তে আস্তে হয়ত দূর হয়ে যাবে।”

রামেন্দু-ফেরদৌসি তনয়া ত্রপা মজুমদার নিজের নাম প্রতিষ্ঠা করেছেন মেধা, প্রতিষ্ঠা এবং অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে। টিভি নাটকে অভিনয়ের পাশাপাশি মঞ্চে নির্দেশক হিসেবে অভিষিক্ত হয়েছেন বেশ আগেই। তার সাম্প্রতিক নির্দেশিত নাটক ‘কুহকজাল’।

তিনি মনে করেন, নারীর অগ্রগতি হয়েছে তবে ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হয়নি। যে কারণে বিভিন্ন ক্ষেত্রেই নারীর উপস্থিতি চোখে পড়লেও নেতৃত্বের তলানিতে অবস্থান।

“এই দুইটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় - উন্নয়ন এবং ক্ষমতায়ন। আগে যেমন আমরা ধারণা করতাম, নারী অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হলেই ক্ষমতায়ন হবে। সেটা হয়তো পুরোপুরি সত্য না। এখন অনেকক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, নারী অর্থ উপার্জন করেও পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে তার যে ক্ষমতায়ন হওয়া উচিত ছিল, তার মতামতের যে গুরুত্ব থাকা উচিত ছিল - সেটা হয়ত পুরোপুরি অর্জন এখনও সম্ভব হয়নি।”

খুব অল্পদিনেই টিভি দর্শকের মন জয় করেন নাজনীন হাসান চুমকি। তবে তার শিকড় মঞ্চ নাটকের গভীরে। তার নির্মিত টিভি নাটক ‘নিভৃত যতনে’ প্রচারিত হয়েছে সম্প্রতি। তিনি লেখালেখিও করছেন নিয়মিত।

নির্মাতা পর্যায়ে কাজ করার আগ্রহ নানা কারণে নারীদের মধ্যে কম বলে মনে করেন তিনি।

চুমকি বলেন, “নির্মাতা সব দিকে নির্দেশনা দেয়। প্রোডাকশন বয়, ক্যামেরাম্যান, সেট ডিজাইনার থেকে শুরু করে এমনকি স্ক্রিপ্টেও সময় দিতে হয় তাকে। সুতরাং সবকিছু মিলিয়ে এই ক্ষেত্রে আসতে চাইলে অনেক হিসেব নিকেশ করতে হয়। যা একজন পুরুষকে করতে হয় না।”

ছোট পর্দা ও মঞ্চ নাটকের আরেক চেনা মুখ জয়ীতা মহালনবীশ। স্বল্পদিনের ক্যারিয়ারে অভিনয় থেকে শুরু করে নির্দেশনা সবই করছেন দাপটের সঙ্গে।

বললেন, নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বিচরণের ক্ষেত্রে।

“আমি নাটকের কাজে মফস্বলে ঘোরাঘুরি করি যথেষ্ট। সেখানে নাট্যকলায় পড়াশোনা করে এমন মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি। ওদের আলাদা চোখে দেখা হয়। ওরা যথেষ্ট সমস্যার মুখে, কয়েকজন ঢাকায় চলে এসেছে।”

“মফস্বলকে বিবেচনা করলে আমার মনে হয় যে নারীরা অনেক বেশি উপেক্ষিত। বাসা থেকে বের হতেই পারে না, কাজ করতে তো বটেই।”

আরও বললেন, নারীর মানসিক প্রকাশের জায়গাটা অনেক সীমাবদ্ধ আর যদি কেউ বড় চিন্তা করেও সেটা প্রকাশ করতে ভয় পায়। 

ত্রপার মুখেও শোনা গেল একই কথা, “থিয়েটারের মেয়েদেরকে কিছু প্রতিবন্ধকতা ফেইস করতে হয়। সেই সমস্যাগুলো পুরোপুরি সামাজিক। থিয়েটারে নারীর প্রতিবন্ধকতা নেই, এটা আমি স্পষ্ট করে অনুভব করি।”

সুচন্দাও স্বীকার করেন, “অনেকে ভাবতেন, নারী নির্মাতারা কি ছবি বানাবেন, কেমন ছবি বানাবেন। এটা তো অনেক কঠিন কাজ। মেধা তো বটেই, শারীরিকভাবেও তারা ভাবছেন, আমি এটা পারবো কিনা। সেটা তাদের একটা ভ্রান্ত ধারণা ছিল। আমরা সে ধারণা ভেঙ্গে দিয়েছি।”

চুমকি মনে করিয়ে দিলেন পারিবারিক প্রতিবন্ধকতার কথা ।

“আমি বলছি না বিবাহিত হতে হবে। সংসারে মেয়েদের অনেক দায়িত্ব থাকেই। মাকে সময় দেয়া বা বাসার কিছু কাজ করা। একটা সময় তাকে দিতেই হচ্ছে, এরপর তাকে অভিনয় করতে হচ্ছে। অভিনয় করাও একটা সময়ের ব্যাপার। তারপরে তো সামাজিকতা আছেই। সবকিছু করে এনার্জি বলে একটা বিষয় থাকে।”

কিন্তু এই পরিস্থিতি আগে ছিল না বলে মনে করেন জয়িতা।

“মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সময়ে এসে খুব কঠিন হয়ে যেত। আমার মনে হয়, ওই সময় মানসিক জায়গায় মেয়েরা অনেক উন্নত ছিল।”

“একাত্তরে ভয় পেলে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ সম্ভব ছিল না। কিন্তু এই সময়ে এসে একটা মেয়ে কেন রাত ১২টায় ঘরে ফিরবে না। এই কথাটা বলতে আমি ভয় পাবো।”

ত্রপা বলেন, “আমরা যখন এসেছি আমরা একটা তৈরি প্ল্যাটফর্ম পেয়েছি। প্ল্যাটফর্মটা তৈরি করে দিয়েছে আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেব যারা এসেছে তাদের জন্য তো আরও সহজ হওয়ার কথা।”

নারীর আছে সহজাত শক্তি

সব সমস্যা মাথায় নিয়েও নারী কাজ করছে, সফলতার দেখাও পাচ্ছে। এর কারণ হিসেবে এই নারী নির্মাতারা বললেন নারীর সহজাত শক্তির কথা। 

সুচন্দা বলেন, “পুরুষদের থেকে নারীরা বেশি ধৈর্য্যশীল। বাস্তব জীবনে যদি আমরা দেখি, পারিবারিক জীবনে সহনশীলতা, ধৈর্য্য - এ সমস্ত ব্যাপার কিন্তু আছে নারীদের মধ্যে।”

চুমকিও তাই বলেন, “নির্মাণ কাজে যে পরিমাণ ধৈর্য্য লাগে আমি বলব যে সেই ধৈর্য্য নারীদের আছে। অনেক বেশি আছে। নারী নিদের্শকরা অনেক ধৈর্য্য নিয়ে অনেক প্রতিবন্ধকতাকে খুব হাসিমুখে এড়িয়ে কাজ করতে পারে।”

ত্রপাও আশাবাদী - “এটা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আজ হোক কাল হোক, এই স্বীকৃতি একদিন আসবেই। মানে, যে সমতার কথা আমরা বলি সেটা প্রতিষ্ঠিত হবেই। খুব স্বাভাবিক নিয়মেই হবে।”

জয়ীতার মতে, “স্বাধীন দেশে মেয়েদের অনেক সুযোগ সুবিধা বেড়েছে বৈকি। আর মেয়েরাও আগের থেকে অনেক বেশি বের হচ্ছে, যদিও এটা খুব শহরকেন্দ্রিক। গ্রাম বা মফস্বলের অবস্থা ভালো না। আমি আমার পরিবেশ নিয়ে শহরকেন্দ্রিক একটা জায়গায় দাড়িয়ে ভাবতে পারি। ওরাও ভাবতে পারে, কিন্তু কিছুই করতে পারে না।”

আলাদা সুযোগ কি চাই?

তাহলে কি নারীদের আলাদা করে সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন? সুচন্দা বলেন, “সবক্ষেত্রেই দেখা যায়, মানহীন লোকও সুযোগ পাচ্ছে। যাদের মধ্যে প্রকৃত মান আছে তারা সুযোগ পাচ্ছে না। সুযোগ পচ্ছে না বিধায় তারা প্রমাণ করতে পারছে না। দুয়েকজন যখনই সুযোগ পাচ্ছে, তারা প্রমাণ করে দিচ্ছে।”

জয়িতা বলেন, “একজন নারী নির্মাতা বা নারীর জন্য কেন আলাদা করে কোটা থাকবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে চাকরি পেতে তাকে পুরুষের সমান যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। এই কনসেপ্টটা সব সেক্টরেই থাকা উচিত। কিন্তু এই কথা আমি বলতে পারি না। অবস্থাই এমন, মেয়েদের ওই সুযোগটা না দিলেও হয়ত হচ্ছে না। কারণ নারীদের হীনমন্যতার শুরু পরিবার থেকেই... হেয় হচ্ছে পরিবার থেকেই।”