সূর্যকন্যা: প্রগতির দর্পণে নারীমুক্তির প্রথম প্রতিবিম্ব

“প্রতি শিল্পেরই মূল লক্ষ্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমাজের উন্নয়নে অংশ নেওয়া এবং এর বিবর্তনে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করা।”- কথাটি প্রয়াত নির্মাতা আলমগীর কবীরের। আজীবন সমাজতান্ত্রিক সংগ্রামের এই সেনানী, বাংলাদেশে যিনি চলচ্চিত্রাচার্য্যের আসনে অধিষ্ঠিত, কলমের পর ক্যামেরাকেই করেছিলেন তার শিল্পচর্চার হাতিয়ার।

সেঁজুতি শোনিমা নদীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 March 2015, 07:18 PM
Updated : 8 March 2015, 05:04 AM

‘ধীরে বহে মেঘনা’, ‘সীমানা পেরিয়ে’র মতো সিনেমা দিয়ে তিনি স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা চলচ্চিত্রের কাণ্ডারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।  দেশ, সমাজ এবং সাধারণ মানুষের জীবনঘনিষ্ট তার সিনেমাগুলো হয়ে উঠেছে প্রগতিশীলতার আলেখ্য। ১৯৭৫ সালে মুক্তি পাওয়া 'সূর্যকন্যা সিনেমাটি ছিল নারীমুক্তির বার্তাবাহী। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশি সিনেমার ইতিহাসে এমন প্রচেষ্টা ছিল প্রথম ও একেবারেই অভিনব।

আলমগীর কবীরের দ্বিতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্য এই সিনেমাটি অনেকগুলো দিক থেকেই ছিল আধুনিক। সেই আধুনিকতাও এমন, আজকের দিনেও যা সেলুলয়েডে তুলে আনতে সাহস করেন না অনেক নির্মাতাই। কেবল গল্পের প্রয়োজনেই নয়, ‘সূর্যকন্যা’র সাহসী নারী চরিত্রদের প্রথা ভাঙ্গার আখ্যানকে তুলে ধরে আলমগীর কবীর যেন তার কল্পনার আদর্শ সমাজ ব্যবস্থাকেই তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। সেই সমাজ, যেখানে নারীরা প্রতিষ্ঠিত স্বমহিমায়, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী এবং চারিত্রিক দৃঢ়তায় বলীয়ান।

“জহির রায়হানের ‘কখনও আসেনি’ চলচ্চিত্রটি নিয়ে যেরকম অনেকেই বলেছিলেন সময়ের অনেক আগেই বানানো এক সিনেমা, ঠিক সেরকম কথাই খাটে ‘সূর্যকন্যা’র ক্ষেত্রেও। ওই সময়ে, যখন সবেমাত্র স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের শুরু হয়েছে, তখন এরকম একটি সাহসী সিনেমার মুক্তি শিক্ষিত সমাজে সাড়া ফেলে দিয়েছিল।”

বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের মহাপরিচালক এবং বাংলাদেশ ফিল্ম ইন্সটিউটের প্রধান নির্বাহী জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ সিনেমাটি নিয়ে এ কথা বলেন।

সেই সময়ে সিনেমাটি দেখার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ বলেন, “সিনেমাটি মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সাড়া পড়ে গিয়েছিল সবার মধ্যে। আমরা তখন ছাত্র। লাইন ধরে দাঁড়িয়ে টিকিট কেনার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম মনে আছে। কেবল তরুণদের মধ্যেই নয়, সাংবাদিক, শিল্পী, সাহিত্যিক- বিশেষ করে প্রগতিশীল শিক্ষিতদের সবার ভেতরেই দারুণ এক উৎসাহ কাজ করেছিল নতুন ধরনের এই সিনেমাটি নিয়ে।”

নতুনত্ব যে কেবল সিনেমার গল্পে কিংবা বিষয়বস্তুতে ছিল তা নয়। এর উপস্থাপন আর চিত্রায়নেও তখনকার দিনের হিসেবে অনেক আধুনিক পন্থা অবলম্বন করেছিলেন নির্মাতা।

সেই সাদাকালোর যুগে আলমগীর কবীর ব্যবহার করেছিলেন সংক্ষিপ্ত একটি দ্বিমাত্রিক অ্যানিমেশন ক্লিপ। অত্যন্ত সরল কথনে এবং স্বল্প সময়ে কুশলতার সঙ্গে ক্লিপটিতে তিনি তুলে ধরেন মানবসমাজের আদিতে মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে পুরুষ শাসিত সমাজের গোড়াপত্তনের ইতিহাসকে।

নারীদের দাসত্বের ইতিহাস তুলে ধরা ওই ক্লিপের পরেই শোনা যায় স্বাধীনতার মূল মন্ত্র- “মুক্তি কি এতো সহজে মেলে? মুক্তি কেড়ে নিতে হয়।”

কিন্তু মুক্তি আসলে কার কাছ থেকে কেড়ে নেবে নারী? যুগের পর যুগ ধরে যাদের হাতে বন্দী তারা, সেই পুরুষদের কাছ থেকে? সিনেমার আপাত সরল এবং অত্যন্ত রোমান্টিক গল্পকাঠামোর ফাঁক গলেই যেন এই প্রশ্নের উত্তর একটু একটু করে পাওয়া যায়।

সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্র লেনিন (বুলবুল আহমেদ) নামের এক স্বপ্নবিলাসী শিল্পী। বেকার যুবক লেনিন একদিন তারই ব্যবসায়ী বন্ধু রাসেলের দোকানে সজ্জা-শিল্পীর কাজ পেয়ে যান। দোকানকে খদ্দেরের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে তিনি সৃষ্টি করেন তিলোত্তমা এক নারী মূর্তি। এই মূর্তিই তার কাছে জীবন্ত প্রেম হয়ে ধরা দেয়। প্রতি রাতে কল্পলোকের এই সূর্যকন্যার (রাজশ্রী বোস) সঙ্গে চলতে থাকে লেনিনের প্রণয়।

ওদিকে রাসেল (আহসান আলি) ধনাঢ্য হলেও একবার বিয়ে করে তেতো অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়ায় স্থায়ী সম্পর্কের ব্যাপারে তার চরম অনীহা। দোকানের সহকারী ব্যবস্থাপক মনিকা বিশ্বাসের (জয়শ্রী কবীর) সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক থাকলেও সবার কাছ থেকে তা গোপনই রাখতে চান তিনি।

অনেকটা সমান্তরালভাবে এগিয়ে যাওয়া দুই বন্ধুর প্রেমের গল্পের কারণে সিনেমাটি নিছক রোমান্টিক ফ্যান্টাসির মোড়কেই আটকে যেত, যদি না এতে নির্মাতা তার কুশলী ভঙ্গীতে নারীবাদী বক্তব্য তুলে ধরতেন।

‘সূর্যকন্যা’ পরিচালনার পাশাপাশি এর গল্প এবং সংলাপ রচনাও করেছিলেন আলমগীর কবীর। সিনেমার প্রায় প্রতিটি সংলাপেই কখনও রূপকের আশ্রয়ে, কখনও কাব্যিকতায়, কখনও সরাসরিই নারীদের ওপর শোষণ, বঞ্চনা আর এর বিপরীতে মুক্তির অভিপ্রায়কে তুলে ধরেছেন তিনি। আর এখানেই সিনেমাটির আসল শক্তি নিহীত। 

সিনেমার শুরুর দিকেই লেনিনের কাল্পনিক প্রেমিকা সূর্যকন্যার মুখ থেকে শুনতে পাওয়া একটি সংলাপ হলো, “ চারটা বেজে গেল যে! ভোরের আলো দেখার অধিকার যে এখনও পাইনি।” গল্পের খাতিরেই খুব সাধারণভাবে বলা এই কথার মধ্যেও যেন লুকিয়ে আছে সহস্র বছর ধরে অসূর্যস্পর্শা হয়ে থাকা নিরুপায় নারীদেরই দীর্ঘশ্বাস।

সন্ধ্যা মুখপাধ্যায়ের অত্যন্ত জনপ্রিয় গান -“আমি যে আঁধারের বন্দিনী, আমারে আলোতে ডেকে নাও...” এই সিনেমার কথনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই গানের মাধ্যমেই পর্দায় প্রথমবারের মতো জড়মূর্তি থেকে জীবন্ত নারীতে পরিণত হয় সূর্যকন্যা

এলো চুলে আর অশ্রুসজল চোখের সাদা শাড়ি পরিহিতা এক নারী যখন গাইছেন এই গান - তা কি নিছক বিরহের আবর্তের বাহন? যুগের পর যুগ অবিচার, অবমাননার শেকলে আটকে থাকা নারীর স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাই যেন আকুতি হয়ে ঝরে পড়ে এই গানে।

সেই ‘আঁধারে বন্দিনী’র মুখেই শোনা যায় নারীর ইতিহাস, “ কালের এক দূর দূরান্তরে ছিলাম আমি, আমরা। ইতিহাস ধরে যদি ফিরে যাও আলোর গতিতে, তাহলে পলকে পৌঁছে যাবে সেখানে। হেসে খেলে বেড়াতাম আমরা।”

“সৃষ্টির উৎস ছিল তারা। মুক্ত আনন্দে, সুখের উল্লাসে দিন কাটতো তাদের। তারপর দেখতে দেখতে কী যেন হয়ে গেল। যাদেরকে অন্তরের ভালবাসা, শরীরের প্রতিটি অণু পরমাণু দিয়ে তিল তিল করে সৃষ্টি করলাম, হৃদয়ে দিলাম স্পন্দন, মুখে দিলাম ভাষা, তারাই একদিন রূপ নিল ভয়ঙ্কর দানোর।”

পুরো সিনেমার সবচেয়ে শক্তিশালী দৃশ্যটির অবতারণা হয় এর পরেই। ভগ্ন রাজপ্রাসাদের দরজা দিয়ে বের হয়ে সূর্যকন্যা বলে ওঠে, “তারপরের  ইতিহাস এক ভয়াবহ দাসত্বের ইতিহাস। তাই আজ আমাদের নেই কোন স্বকীয়তা। আছে কেবল আধা মনুষত্ব। আমরা কেবল সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র। ভোগের সামগ্রী।”

লেনিন যখন তার প্রেয়সীর বন্দিত্ব নিয়ে চিন্তিত, ঠিক তখনই মনিকার সঙ্গে সম্পর্কের রাসেলের সম্পর্ক এক জটিল সমীকরণে এসে দাঁড়িয়েছে। রাসেলের নিজের ভাষ্যেই, সে ‘ঘরপোড়া গরু’; বিয়ে আর সংসারের আগুনে আরেকবার হাত পোড়াতে চায় না।

ওদিকে, পারিবারিকভাবে মনিকার বিয়ে ঠিক হয়েছে গিলবার্টের সঙ্গে। রাসেলের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে, চাকরি আর এক বছরের বেতন ছুড়ে ফেলে গিলবার্টকেও দাপটের সঙ্গে সে বলে দেয়, “কোন আক্কেলে আপনি আমাকে বিয়ে করতে চান, বলুন দেখি? একবারও কি মনে হয়নি, আমিও কাউকে ভালবেসে থাকতে পারি?”

প্রেম থেকে বিয়ে কিংবা সংসার- সবক্ষেত্রেই আজকের সমাজেও নারীদের পছন্দকে তাদের অধিকার হিসেবে মেনে নিতে পারেন না অনেকেই। সেখানে, সত্তরের দশকে যখন একটি মেয়ে নিজের ভালবাসার দাবিকে জোর গলায় তুলতে পারে, শুধু তাই নয়, প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হলে অতীত ভুলে নিজেই স্বাবলম্বী হওয়ার উদ্যোগ নেয় - সেই মেয়ের আত্মমর্যাদা আর আত্মবিশ্বাসের বাহবা দিতেই হয়।

আর রক্ষণশীল পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কেবল এমন এক শক্তিশালী নারী চরিত্রের সৃষ্টিই নয়, বিয়ের আগেই প্রেমিকের সঙ্গে তার নিঃসংকোচ সহবাসের দৃশ্যায়নও নির্মাতার সাহসের পরিচয় বহন করে।

পরিচালনা, রচনা ও সংগীতায়োজন ছাড়াও এই সিনেমার অন্যতম বড় অস্ত্র কলাকুশলীদের অভিনয়। কল্পনাবিলাসী শিল্পী লেনিনের চরিত্রে প্রয়াত অভিনেতা বুলবুল আহমেদ যেমন, সূর্যকন্যার চরিত্রে কলকাতার অভিনেত্রী রাজশ্রী বোসও তেমনই  দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। অন্যদিকে জয়শ্রী কবীর, যেমন অভিনয়ে, তেমনি গ্ল্যামারে মন কেড়েছেন সবার। সমুদ্রের পাড়ে  ‘অন আ নাইট লাইক দিস’ গীতিকবিতাটির সঙ্গে জয়শ্রী কবীরের মোহনীয় নাচ সত্যিই মনে রাখার মতো।

সম্পাদনার মুন্সিয়ানার কারণে ‘সূর্যকন্যা’ বাহুল্য দোষ থেকে একেবারেই মুক্ত। এক ঘণ্টা ৪৮ মিনিটের সিনেমাটি তাই কোনো জায়গাতেই ঝুলে যায়না। সেই সঙ্গে চিত্রগ্রাহকের ক্যামেরায় সেই সময়ের ঢাকাকে দেখতে পাওয়া এক বাড়তি পাওনা।

সেলুলয়েডে কল্পনার রং চড়িয়ে নারীর শক্তি, সাহস আর মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে আলমগীর কবীর তুলে ধরেছিলেন আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে। তারপর বাংলাদেশে আর্থ-সামাজিকভাবে নারীর অবস্থার উন্ননয় হলেও, এখনও পুরুষদের সঙ্গে একই কাতারে নারীর স্থান পুরোপুরি মেনে নেওয়া হয়নি। নারীদের ‘ভয়াবহ দাসত্বের ইতিহাস’ তাই আজও খুব একটা বদলায়নি।

আজও আঁধারের বন্দিনীরা মুক্তির অপেক্ষায় পথ চেয়ে। আজকের এই দিনেও তাই ‘সূর্যকন্যা'র মতো সিনেমা কেবল প্রাসঙ্গিক নয়, জরুরীও।