ভাষা আন্দোলন যে সিনেমার মূল সুর

গল্পটি অতি সাধারণ এক পরিবারের। দোর্দণ্ড প্রতাপ ননদ, নিরীহ প্রকৃতির ভাইয়ের বউদের নিয়ে সংসারের কূটচালের কাহিনি। কিন্তু এরই আড়ালে বলা হয়ে যায় একটি জাতিকে দমন করে রাখার ইতিহাস এবং নিপীড়িত জনতার জেগে ওঠার কথা। অসাধারণ চিত্রনাট্য, সংলাপ, মন্তাজ, সংগীত, অভিনয় আর পরিচালনায় ছবিটি হয়ে ওঠে ক্ল্যাসিক। বাংলা চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’র কথা বলছি।

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Feb 2015, 03:54 PM
Updated : 21 Feb 2016, 05:54 AM

শহীদ বুদ্ধিজীবী জহির রায়হানের অনবদ্য সৃষ্টি ‘জীবন থেকে নেয়া’। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৭০ সালের এপ্রিলে। ভাষা আন্দোলন ও উনসত্তরের গণআন্দোলনের পটভূমিকায় বিকশিত ছবির কাহিনি। কাহিনির মূল কেন্দ্রে রয়েছে একটি পরিবার। এ পরিবারে আছেন দুই ভাই আনিস( শওকত আকবর) ও ফারুক(রাজ্জাক)। তাদের বড়বোন রওশন জামিল। বোনের স্বামী খান আতাউর রহমান।

বাবার বাড়িতে থাকা বিবাহিত বড়বোন রওশন জামিলের কারণে বাড়ির সবাই অস্থির। সংসারের সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করে তিনি স্বামী ও নিজের দুইভাইয়ের উপর দমন-পীড়ণ চালান। তার আঁচলে দোলে চাবির গোছা। তার পিছনে পিছনে গৃহপরিচারিকা বয়ে নিয়ে চলে পানের বাটা। রূপক এই দৃশ্যের মাধ্যমে স্বৈরশাসকের ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার কথা বলা হয়।

নিপীড়িত স্বামী খান আতাউর রহমান আদালতের সামান্য কর্মচারী। তিনি তার বন্ধু বেবী জামানের পরামর্শে বড় শালা শওকত আকবরের বিয়ে ঠিক করেন সাথী (রোজী সামাদ) নামে এক শান্ত তরুণীর সঙ্গে। ভাইয়ের বিয়ে দিতে বোন নারাজ, পাছে সংসারের চাবি হাতছাড়া হয় সেই ভয়ে। এই রূপকের মাধ্যমে নির্বাচন দিতে নারাজ স্বৈরশাসকের কথা বলা হয়। বোনকে না জানিয়েই শওকত আকবরের বিয়ে দেন খান আতা।

সাথী বউ হয়ে এ পরিবারে আসে। তার ওপরও শুরু হয় নির্যাতন। এদিকে সাথীর ছোট বোন বীথি( সুচন্দা)র সঙ্গে প্রেম হয় রাজ্জাকের। দুলাভাই ও বড় ভাইয়ের অনুমতি নিয়ে বীথিকে বিয়ে করেন রাজ্জাক। এই দুবোনের বড় ভাই আনোয়ার হোসেন প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলনের কর্মী। তিনি দেশের মানুষের অধিকারের কথা বলতে গিয়ে কারাবরণ করেন। বাড়ির পুরনো বিশ্বস্ত গৃহকর্মী আমজাদ হোসেন মৃত্যুবরণ করেন আন্দোলনে।

সুচন্দার  নেতৃত্বে বাড়ির সবাই রওশন জামিলের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়। বাড়ির দেয়ালে পোস্টার পড়ে। রওশন জামিলের কাছ থেকে চাবির গোছা চলে আসে দুই বোনের হাতে। পানের বাটা ঘোরে তাদের পিছনে। ক্ষমতা হারিয়ে ষড়যন্ত্র করতে থাকে বড়বোন। সাথী ও বীথি সন্তানসম্ভবা হয়। দুই বোন হাসপাতালে ভর্তি হয়। কিন্তু সাথী মৃত সন্তান প্রসব করে। এ শোক সাথী সহ্য করতে পারবে না ডাক্তারের এই আশংকায় বীথির সন্তানকে তুলে দেওয়া হয় তার কোলে। তাকে নিজের সন্তান ভেবে লালন পালন করতে থাকে সাথী। এই সময় ষড়যন্ত্র করে রওশন জামিল দুবোনের মধ্যে মনোমালিন্যের সূত্রপাত ঘটায় এবং কৌশলে বীথিকে বিষ খাইয়ে সেই দোষ চাপায় সাথীর ঘাড়ে। বীথি বেঁচে ওঠে কিন্তু বিষ প্রয়োগের অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পুলিশ কর্মকর্তার ভূমিকায় ছিলেন সে সময়ের নামজাদা খলনায়ক রাজু আহমেদ। আদালতে মামলা চলে। সরকারী উকিল হন শওকত আকবর। তিনি স্ত্রীকে দোষী মনে করে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ান। আর সাথীর পক্ষে উকিল হন খান আতা। তিনি আদালতে প্রমাণ করে দেন মূল অপরাধী তার স্ত্রী রওশন জামিল।

এই ছবিতে শহীদ মিনারে প্রভাত ফেরী, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটি এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই শ্লোগানের অসাধারণ দৃশ্যায়ন রয়েছে। ‘আমার সোনার বাংলা’ এবং ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানের চিত্রায়নও ছিল অনবদ্য। ছবিতে রাজ্জাককেও গণআন্দোলনের কর্মীর ভূমিকায় দেখা যায়। 

উনসত্তরের গণআন্দোলনের স্থির চিত্র ব্যবহার  করা হয়। মিছিলের দৃশ্য দেখানো হয়। সব মিলিয়ে পরিচালকের মুন্সিয়ানায় সাধারণ একটি পরিবারের গল্প হয়ে ওঠে বাঙালির জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের অসাধারণ দলিল। এ ছবিতে ব্যবহৃত রবীন্দ্রসংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ স্বাধীনতার পর আমাদের জাতীয় সংগীতের স্বীকৃতি পায়। ছবিতে প্রত্যেক কুশীলবের বিশেষ করে খান আতাউর রহমান, আনোয়ার হোসেন এবং রওশন জামিলের অভিনয় ছিল অনবদ্য। রূপকধর্মী সংলাপও এ ছবির অন্যতম সম্পদ। ক্যামেরার কাজ ছিল দারুণ। বিশেষ করে প্ল্যাকার্ড বহনের সময় গুলির শব্দ এবং প্ল্যাকার্ড পড়ে যাওয়ার মা|ধ্যমে মৃত্যুকে বোঝানো। সিনেমাটির চিত্রগ্রাহক ছিলেন আফজাল চৌধুরী। সিনেমাটির প্রযোজকও ছিলেন জহির রাহয়ান। চিত্রনাট্য লিখেছিলেন জহির রায়হান ও আমজাদ হোসেন।

এ ছবির একটি আলোচিত গান ছিল খান আতাউর রহমানের কণ্ঠে ‘এ খাঁচা ভাঙবো আমি কেমন করে’। ছবির কাহিনিতে দেখা যায় যখনই ঘরজামাই খান আতা গানটি গাইতে যান তখনি বাঁধার মুখোমুখি হন। স্ত্রীর নির্যাতনে তিনি কখনও গানটি সম্পূর্ণ গাইতে পারেন না। ফলে ছবির দর্শকরা পুরো গানটি শুনতে পারেন না।

পরবর্তীতে ছবির সংগীত পরিচালক খান আতাউর রহমান এক সাক্ষাৎকারে বলেন গানটি তিনি ইচ্ছাকৃতভাবেই শেষ করেননি। কারণ খাঁচা ভাঙার সংগ্রামের কোনো শেষ নেই। মানুষের মুক্তি পুরোপুরি যতদিন অর্জিত না হবে ততদিন খাঁচা ভাঙার আকুতি ও সংগ্রাম চলবে।