'হিন্দি সিনেমা ঠেকানোর উপায় ভালো সিনেমা তৈরি'

হলমালিকরা যখন বলছেন, হল বাঁচাতেই হিন্দি সিনেমা প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা, তখন চলচ্চিত্র বোদ্ধারা বলছেন, সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাওয়া ঠেকাতে ‘মানসম্পন্ন ডিজিটাল চলচ্চিত্র’ নির্মাণের পাশাপাশি বিদেশী চলচ্চিত্র আমদানির ব্যাপারে সরকারের সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।

জয়ন্ত সাহাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Jan 2015, 05:23 AM
Updated : 25 Jan 2015, 05:23 AM

শুক্রবার দেশের অর্ধশতাধিক হলে হিন্দি সিনেমা ‘ওয়ান্টেড’ মুক্তির প্রতিবাদে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ঐক্যজোটের ব্যানারে চলছে ধর্মঘট আর বিক্ষোভ। এদিকে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত পাঁচটি সংগঠন আয়োজন করে ‘ভারতীয় চলচ্চিত্র বাংলাদেশে অবাধ ও বাণিজ্যিক প্রদর্শন:   বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্প এবং দেশীয় সংস্কৃতিতে প্রভাব’ শীর্ষক এক সেমিনার।

সেমিনারে এসেছিলেন অভিনেতা মামুনুর রশীদ,  চলচ্চিত্রকার মানজারে হাসিন মুরাদ, চলচ্চিত্রকার মুশফিকুর রহিম গুলজার,  বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সহ-সভাপতি সোহানুর রহমান সোহান, চলচ্চিত্র গবেষক ড. ফাহমিদুল হক, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র অভিনয়শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবং চলচ্চিত্র অভিনেতা মিশা সওদাগর, মাসুম পারভেজ রুবেল, ওমর সানী,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক সাবরিনা সুলতানা, চলচ্চিত্র সংসদকর্মী জাঈদ আজিজ প্রমুখ।

উদ্বোধনী বক্তব্যে মামুনুর রশীদ বলেন, “হিন্দি বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র যদি আমাদের দেশে এভাবে অবাধে চলতে থাকে, তাহলে তা শুধু আমাদের চলচ্চিত্র ইন্ড্রাস্ট্রির জন্য নয়, সামগ্রিকভাবে দেশের সংস্কৃতিকে ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।”

তার মতে, সরকারের ‘একগুয়ে মনোভাবে’র কারণেই বাংলাদেশে ভারতীয় সংস্কৃতির নিয়ন্ত্রণহীন বিস্তার হয়েছে। 

মামুন বলছেন, উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে মানসম্পন্ন সিনেমা নির্মাণ করতে হবে।

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির মহাসচিব মুশফিকুর রহমান গুলজারের অভিযোগ, দেশে ভারতীয় সিনেমা অবাধে প্রদর্শনের দায় অনেকাংশেই হলমালিকদের। তাদের বিরুদ্ধে সিনেমার টিকিট বিক্রির অর্থ ‘আত্মসাত’ করা, সিনেমা বিক্রি থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিতে ‘গরিমসি’ ও ‘হয়রানি’ করা, ‘ভিডিও পাইরেসি’র অভিযোগ আনেন তিনি।

হিন্দি সিনেমার বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনের নেতা ও বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সহ-সভাপতি সোহানুর রহমান সোহান বললেন, “বাংলা চলচ্চিত্র সবে যখন ডিজিটাল চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে শুরু করছে, তখন দেশের প্রেক্ষাগৃহে হিন্দি সিনেমা মুক্তির ব্যাপারটি দেশীয় চলচ্চিত্রকে ধ্বংস করার পায়তারা।”

সিনিয়র এ নির্মাতা বলছেন, ভারতের হিন্দি সিনেমার সঙ্গে টক্কর দেওয়ার মতো অবস্থানে এখনো পৌঁছায়নি বাংলা চলচ্চিত্র।

সিনিয়র অভিনেতা ওমর সানিও সোহানের কথায় সায় দিয়ে বলছেন, “আমাদের চলচ্চিত্রের বাজেট এবং ভারতীয় চলচ্চিত্রের বাজেটের পার্থক্য অনেক। এ প্রেক্ষাপটে ভারতীয় চলচ্চিত্র আমাদের দেশের প্রেক্ষাগৃহে চলতে পারে না।”

তার কথায় সায় দিলেন অভিনেতা মাসুম পারভেজ রুবেল, মিশা সওদাগর।

চলচ্চিত্র বিশ্লেষক ড. ফাহমিদুল হক বললেন অন্য কথা। তিনি বলছেন, “ঢাকার সিনেপ্লেক্সগুলোতে যখন বিদেশী সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে, তখন তো বুঝতে হবে দর্শকের চাহিদা আছে বলেই হলগুলো বিদেশী সিনেমা মুক্তির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দেশীয় চলচ্চিত্র প্রদর্শন করে তারা যখন ক্ষতির সম্মুখীন, তখন তারা নিজেদের পেট বাঁচাতেও হিন্দি সিনেমা চালাবে।”

চলচ্চিত্র গবেষক ফাহমিদুল আরও বলছেন, “বাংলাদেশের সিনেমাগুলোর কাহিনি ও গান এখন প্রায়ই হিন্দি কিংবা তামিল সিনেমা থেকে হুবহু নকল করা হচ্ছে। মানসম্পন্ন মৌলিক সিনেমা বানালে হলব্যবসাও হুমকির মুখে পড়তো না, আর হিন্দি সিনেমাও চলতো না হলে।”

তখন চলচ্চিত্র ঐক্যজোট নেতারা তার কথার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে দাবি করছেন, বাংলাদেশে এখন মানসম্পন্ন সিনেমা নির্মাণ ‘হচ্ছে’, যা অনেকাংশেই ভারতীয় বাংলা সিনেমা থেকে ‘উন্নত’।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক সাবিনা সুলতানা চৌধুরীর কণ্ঠে শোনা গেল ব্যঙ্গাত্মক সুর।

“হিন্দি সিনেমা আমদানির প্রক্রিয়াটি দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। আমদানিকাররা এরই মধ্যে সরকারি অনুমোদন নিয়ে ‘ওয়ান্টেড’ হলে মুক্তিও দিয়ে দিল। বড় দেরি করেই আমাদের ঘুম ভাঙ্গল।”

সাবিনা বলছেন, “যেকোনো দেশে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালানো খুব সোজা। কূটনৈতিক কুটকৌশলের মাধ্যমে খুব সহজেই অন্য দেশ একটি দেশের সংস্কৃতির উপর আগ্রাসন চালাতে পারে। আমাদের সরকারের নতজানু নীতির কারণেই আজকে ভারতীয় সিনেমা বাংলাদেশের হলগুলোতে চলছে।”

চলচ্চিত্রকার ও চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনকর্মী মানজারে হাসিন মুরাদ বলছেন, চলচ্চিত্র ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সবাইকে নিয়ে একটি সুষ্ঠু নীতিমালা প্রয়োজন, যাতে হলব্যবসাও ধ্বংস না হয় আর একইসঙ্গে পরিচালক ও প্রযোজকরাও লাভবান হন।

সমস্যা সমাধানে ড. ফাহমিদুলের পরামর্শ, “সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে, নির্দিষ্ট পরিমাণ বিদেশী চলচ্চিত্র আমদানি করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে উচ্চহারের কর কিংবা একটি প্রেক্ষাগৃহে বিদেশি চলচ্চিত্র প্রদর্শন নির্দিষ্ট সপ্তাহে সীমিত রেখে দেশি চলচ্চিত্রের প্রদর্শন নিশ্চিত করতে হবে।”

তবে তার এ পরামর্শ মানতে নারাজ ঐক্যজোটের কর্মীরা। তাদের দাবি একটাই, “দেশের প্রেক্ষাগৃহে কোনোভাবেই হিন্দি সিনেমা চলবে না। যে কোনো মূল্যে দেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে বাঁচাতে হবে।”

আয়োজনটি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদকর্মী নাবীল আল জাহান গ্লিটজকে বলেন, “চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের ইতিহাসে মূলধারার চলচ্চিত্রের সঙ্গে একটি দূরত্ব পরিলক্ষিত হয়। এই গোলটেবিল বৈঠককে সেই দূরত্ব ঘোচানোর একটি ধাপ বলেই মনে করছেন আয়োজকরা। বিশেষত, পরিচালক সমিতির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের নেতাদের এক আয়োজনে সমবেত হওয়ার এই ঘটনা বেশ বিরল।”

গোলটেবিল বৈঠকটি যৌথভাবে আয়োজন করছে- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ, ম্যুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটি, জাহাঙ্গীরনগর স্টুডেন্টস ফিল্ম সোসাইটি, রণেশ দাশগুপ্ত ফিল্ম সোসাইটি এবং জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি ফিল্ম সোসাইটি।