'এক কাপ চা' মন্দ নয় 

একটি গড়পড়তা বাণিজ্যিক ধারার বাংলা সিনেমা থেকে দর্শক কী প্রত্যাশা করেন? উত্তরটি নিশ্চিতভাবেই - বিনোদন। সেই সঙ্গে ভাল অভিনয়, নির্মাণশৈলী আর সংগীত পেলে তো কথাই নেই।

সেঁজুতি শোণিমা নদীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Nov 2014, 10:24 AM
Updated : 28 Nov 2014, 10:31 AM

ঢাকাই চলচ্চিত্রের নায়ক ফেরদৌস প্রথমবারের মতো আত্মপ্রকাশ করেছেন প্রযোজক হিসেবে। নিজের বিপরীতে মৌসুমীকে নিয়ে তার রোমান্টিক কমেডি ‘এক কাপ চা’ সেসব প্রত্যাশা অনেকটাই পূরণ করতে পেরেছে। 

বাণিজ্যিক ধারার ঢাকাই সিনেমায় ফেরদৌস ফিরলেন বেশ বিরতি দিয়েই। তার বিপরীতে মৌসুমীর রসায়ন বরাবরই সমাদৃত হয়েছে দর্শক মহলে। এবারো তার ব্যতিক্রম হয়নি। সিনেমার সেই অংশগুলোই সবচেয়ে আকর্ষণীয় যেখানে মৌসুমী-ফেরদৌস একসঙ্গে পর্দায় এসেছেন। মৌসুমী আরও একবার প্রমাণ করলেন, বয়স, বিয়ে, সংসার- এর কোনো কিছুই নায়িকা হিসেবে তার আবেদন কমাতে পারেনি। ফেরদৌসের সঙ্গে তার রোমান্টিক দৃশ্যগুলিকে স্বার্থক করে তোলার ক্ষেত্রে তার অবদানই ছিল বেশি।

নিজের প্রযোজিত প্রথম সিনেমায় নিজেই নায়ক হওয়ার চাপ সামলে ফেরদৌসও উতরে গেছেন। নিজের চরিত্রকে বেশ সফলভাবেই তুলে আনতে পেরেছেন তিনি।

সিনেমার গল্প সরলরৈখিক। শহুরে এক কলেজের শিক্ষক শফিক প্রেমে পড়েন কলেজেরই লাইব্রেরিয়ান দীপার। ইংরেজির প্রভাষক শফিক ছাত্রদের সাহসী হওয়ার মন্ত্রে উজ্জীবিত করতে চাইলেও নিজের প্রেম নিবেদনের ক্ষেত্রে একেবারেই ভীরু। তাই প্রতিরাতেই দীপাকে স্বপ্নে দেখলেও সরাসরি প্রেম নিবেদনে সংকোচ তার অনেক। তবে আমাদের এই সাহিত্যের শিক্ষক ভীষণ রোমান্টিক। সকালবেলাটা তিনি শুরু করেন দীপার টেবিলে একটা করে গোলাপ ফুল রেখেই।

শফিকের ভীরু-লাজুক প্রকৃতির একেবারেই বিপরীত দীপা। সপ্রতিভ কলেজ লাইব্রেরিয়ানের চরিত্রচিত্রনে কর্মজীবি নারীদের দৃঢ়তা আর শক্তি তুলে ধরেছেন মৌসুমী। সিনেমার মূল চরিত্রগুলোর মধ্যে একমাত্র তিনিই ছিলেন অতি অভিনয়ের দোষমুক্ত। 

শফিক একদিন ঠিক করে মনের কথা খুলে বলবে। দীপা ততদিনে পেইং গেস্ট হিসেবে থাকতে শুরু করেছেন মিস্টার গোমেজের বাড়িতে। গোমেজের ছোট ছেলে পিটার গুরুতর অসুস্থ হওয়ায় শুক্রবার ছুটির দিন হলেও শফিকের সঙ্গে ঘর থেকে বেরোতে অস্বীকৃতি জানায় সে। শফিক তাই নিজের সংকোচ ঝেড়ে ফেলে ফুলের তোড়া আর উপহার নিয়ে হাজির হয় দীপার বাসায়। সেখানে এসে জানতে পারে পিটারকে বাঁচাতে প্রয়োজন একটি বিশেষ ইঞ্জেকশনের। সেটা পাওয়া যাবে ডক্টর আফজালের বাড়িতেই। সেই ইঞ্জেকশন আনতে যাওয়ার ঘটনাতেই জড়িয়ে যায় শফিক। সেখান থেকেই সিনেমার মোড় ঘুরে যায়। 

‘এক কাপ চা’ শুরুই হয় ‘লিলুয়া বাতাস’ গানটি দিয়ে। সিনেমার শুরুতেই দীপার সঙ্গে শফিকের বিয়ের স্বপ্নের এই গানে উপস্থিত হয়েছেন আলমগীর, নিপুণ, নিরব, ইমন, আঁখি আলমগীরদের মতো তারকারা। সিনেমার বিভিন্ন অংশে অতিথি চরিত্রে আরও অনেক তারকার উপস্থিতির শুরু এখান থেকেই। কলেজের প্রধান অধ্যক্ষের চরিত্রে নায়করাজ রাজ্জাক, গাড়িতে করে ফেরদৌসকে লিফট দেওয়ার প্রথম চরিত্রটিতে মীর সাব্বির, সাদা গাড়িতে ফেরদৌসকে লিফট দেওয়া দ্বিতীয় ব্যাক্তির চরিত্রে শাকিব খান, কয়েদির চরিত্রে ওমর সানি আর ডক্টর আফজালের চরিত্রে হুমায়ূন ফরিদী- দর্শকদের জন্য চমক হয়েই আসেন। এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় রাজ্জাক, হুমায়ূন ফরিদী আর মীর সাব্বিরের কথা, যারা এই স্বল্প পরিসরেও অভিনয় প্রতিভার প্রমাণ দিয়েছেন। 

সিনেমায় একটি বিশেষ চরিত্রে অভিনয় করেছেন টালিগঞ্জের অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা। বার ড্যান্সার দিলরুবার চরিত্রে দেখা গেছে তাকে। যে আইটেম গানটি দিয়ে তার প্রবেশ- বলতেই হচ্ছে সেটিই পুরো সিনেমার সবচেয়ে হতাশাজনক অংশ। ‘বাপরে বাপ’ নামের গানটিতে পশ্চিমবঙ্গের এই অভিনেত্রীর রূপসজ্জা, পোশাক আর কোরিওগ্রাফি সুরুচির পরিচয় দেয় না। সেই সঙ্গে তার অংশটি সিনেমায় বাড়তি সংযোজন বলেও মনে হয়েছে। 

সিনেমার তিন খল চরিত্র গুন্ডা ফেইসবুক এবং তার দুই সাঙ্গ-পাঙ্গর অভিনয়ও খুব একটা জমেনি। বরাবরই মেলোড্রামাটিক অভিনয়ে অভ্যস্থ কাবিলাকে দিয়ে এই সিনেমায় কমিক-রিলিফ আনতে চেয়েছেন পরিচালক। কিন্তু সেটা তার অতি-অভিনয়ের কারণে ফলপ্রসু হয়নি। 

‘বাপরে বাপ’ গানটি ছাড়া সিনেমার বাকি গানগুলি উপভোগ্য । ফেরদৌস-মৌসুমীর রোমান্টিক দুটি গান ‘এক কাপ চা’ আর ‘স্বপ্ন দেখি আমি’র সুর, কথা আর গায়কী সবই ছিল ভাল। এমনকী দ্বিতীয় গানের নৃত্য পরিচালনাতেও ছিল কুশলতার পরিচয়। মৌসুমীর আবেদনময় রূপ ভালোভাবেই উঠে এসেছে গানদুটিতে।

সিনেমার কারিগরি দিক নিয়ে প্রথমবার পরিচালনায় নামা নঈম ইমতিয়াজ নেয়ামুলকে বেশ কিছু অভিযোগের মুখোমুখি হতে হবে। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যে বারবার ফোকাস হারিয়েছে কামেরা। ফেরদৌস-মৌসুমীর গুরুত্বপূর্ণ ক্লোজ আপ শটে মৌসুমী ফোকাসের বাইরে ছিলেন। একই সমস্যা হয়েছে এজাজুল ইসলামের সঙ্গে পিক-আপে করে মৌসুমীর ফেরদৌসকে খুঁজতে যাওয়ার দৃশ্যেও। 

তবে ফেরদৌসের মৌসুমীর টেবিলে গোলাপ রাখা কিংবা নায়কের ধাক্কায় নায়িকার হাত থেকে বই পড়ে যাওয়ার মতো বাংলা সিনেমায় অতি ব্যবহৃত দৃশ্যুগুলো উপস্থাপনে নতুনত্ব এনেছেন পরিচালক। চিত্রগহণের দিক থেকে অন্যসব ঘাটতি তিনি কিছুটা হলেও পুষিয়ে দিয়েছেন কাহিনিবিন্যাসে কুশলতার পরিচয় দিয়ে।

রোমান্টিক কমেডি সিনেমা হিসেবে ‘এক কাপ চা’র কাছ থেকে হাস্য-রসাত্মক ক্ষুরধার কিছু সংলাপের আশা ছিল। কিন্তু রোমান্টিক সংলাপের আতিশয্যে সে আশার গুড়ে বালি পড়েছে। কমিক সংলাপ এসেছে কেবল দুবারই। তবে দুটিই সিনেমার অতিথি দুই চরিত্র মীর সাব্বির আর ওমর সানির কাছ থেকে। পার্থক্য কেবল সংলাপের উপস্থাপনে। মীর সাব্বিরের উপস্থাপন যেখানে ছিল তাৎক্ষণিক এবং সাবলীল, ওমর সানির নিষ্প্রভ অভিব্যাক্তি সেখানে কিছুটা হতাশ করেছে।

তবে, সবদিক বিবেচনা করলে খুব বেশি হতাশ করেনি ‘এক কাপ চা’। সুস্থ বিনোদনের আকালের এই বাজারে ‘এক কাপ চা’  কিছুটা হলেও সজীব হাওয়ার পরশ বুলাবে। 

সিনেমাটির প্রিমিয়ার অনুষ্ঠানে ছবি তুলেছেন নয়ন কুমার।