[১] ‘পিঁপড়াবিদ্যা'য় মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর সিনেমা সাবালকত্ব অর্জন করল। এই অর্থে করল যে এতে আগের সিনেমাগুলির মতো বয়ঃসন্ধিকালীন প্রগলভতা, দিগভ্রান্ততা কম। চিত্রনাট্যে আনিসুল হকের গদ্যকৃতির অভাব এটাকে নভেলসুলভ বাচালতার পথ ছেড়ে চলচ্চিত্রের মৌল প্রকাশভঙ্গীর আরেকটু কাছাকাছি হওয়ার সুযোগ দিয়ে থাকবে।
Published : 28 Oct 2014, 06:28 PM
'পিঁপড়াবিদ্যা’য় দুটি সাম্প্রতিক অনুষঙ্গের প্রবেশ ঘটেছে - চিত্রনায়িকার সেক্সটেপ ফাঁস এবং মাল্টি লেভেল মার্কেটিং-এর নামে ধাপ্পাবাজি। অনেক পরিচালক-প্রযোজকই, যারা দাবি করেছেন যে তারা সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে ছবি তৈরি করছেন, তারা যে কারণেই হোক সেন্সর পার হতে হিমশিম খাচ্ছেন। কাজী হায়াতের 'সর্বনাশা ইয়াবা' অবশ্য মুক্তি পেয়েছে। এই জাতীয় সিনেমাকে ’সামাজিক অসঙ্গতি’র ছবি বলার চল রয়েছে। যেন সমাজে বেশ সঙ্গতি থাকবার কথা। এই সিনেমাগুলি সমাজে সেই সঙ্গতি ফেরাতে চায়। 'পিঁপড়াবিদ্যা'ও এই অভিলাষ ত্যাগ করে নাই। কীভাবে - সে প্রসঙ্গে পরে আসি।
[২]
যারা 'থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নম্বরে' বের্তলুচ্চির ‘বিসিইজড' আর ‘টেলিভিশনে' ইলমাজ এরদোয়ানের ‘ভিজনতেলে' খুঁজে পেয়েছিলেন, তারা জানবেন এরই মধ্যে পৃথিবীর অন্য পিঠে প্রকাশিত 'পিঁপড়াবিদ্যা’র সমালোচনায় বেন স্টিলারের 'ওয়াল্টার মিটি'কে টেনেছেন সমালোচক। যারা বিদেশি ছবিগুলি সব দেখেন নাই, তাদের বলা যায় এরদোয়ানের ছবির কিছু হাড্ডিগুড্ডি ফারুকী তছরুপ করেও থাকতে পারেন, কিন্তু 'থার্ড পার্সন' আর ‘পিঁপড়া' - অন্য কোনো ছবির স্মৃতি উসকে দিতে পারে বড়জোর; সেটা জগতের শ্রেষ্ঠ সিনেমাগুলির বেলাতেও বলা যায়।
‘পিঁপড়াবিদ্যা'র বেলায় কোথা থেকে কী নেয়া হয়েছে সেসব শিক্ষানবিসী অনুশীলনের চেয়ে এটা বলা জরুরি যে এতে ঢাকাই ছবির দর্শক সিনেমায় নিজের চেনা ফ্যান্টাসির প্রতিচ্ছবি যে দেখতে পেয়েছেন তা বিরল ঘটনা।
নিম্নমধ্যবিত্ত এবং 'ইতিহাসের পরিবর্তনের ধারা নিয়ন্ত্রণে অক্ষম' এই অর্থে ‘লুম্পেন' শ্রেণীর যৌন ফ্যান্টাসি পিঁপড়াবিদ্যার কাহিনিকে চালিয়ে নিয়ে যায়।
[৩]
ঢাকাই ছবিতে এমন ফ্যান্টাসির ঠাঁই নাই। তার কাঁধে তুলে দেওয়া হয়েছে নীতিশিক্ষা বিলানোর অলীক জোয়াল। ছোটলোকের ফ্যান্টাসিকে অশ্লীলতা বলে বিদায় করে দেওয়া হয়েছে কবে। নায়িকাদের মেদজর্জর পেট আটকে গেছে রাষ্ট্রের একচোখা নন্দনতত্ত্বে। যে শ্রেণী-অসূয়া 'যাত্রা দেখে ফাত্রা লোকে' প্রবাদে উপস্থিত, সে অসূয়াই সিনেমাকে নাম দিয়েছে ‘ছিনেমা'। সরকারি বয়ান থেকে পত্রিকার রিপোর্ট সবখানেই শোনা গেছে সাফ-সুৎরা সিনেমার জন্য হাহাকার। তাতে ‘অশ্লীল' সিনেমাকে বিদায় দেওয়া হয়েছে।
মনে করতে পারি, রবীন্দ্রনাথ ‘নষ্টনীড়' গল্পে বা 'ঘরে বাইরে' উপন্যাসে যৌন ফ্যান্টাসিকে ভিক্টরীয় অনুশাসনের যে মোজা পরিয়ে গেছেন, সত্যজিৎ রায়ের মতো পরিচালক সেটা খুলতে চান নাই বা সময়ের কারণে পারেন নাই। ঋতুপর্ণ ঘোষ তাঁর অকালমৃত্যুর আগে সেই মোজা খুলতে বসেছিলেন। ফারুকী এক পায়ের মোজা খুলেছেন বটে।
[৪]
মিঠুর দোদুল্যমান চেহারার ক্লোজ-আপে শেষ হয় ‘পিঁপড়াবিদ্যা'; সে কি পাগল নাকি পাগলের ভান করছে - এই প্রশ্নে। মিঠুকে এর আগেও যখন যেভাবে দরকার মিথ্যা বলতে দেখা গেছে, এমনকি সুবিধা মতো নিজের চরিত্র বানিয়ে নিতেও। সুতরাং এইবার পাওনাদারের হাত থেকে বাঁচতে পাগলের চরিত্র সে নিতেই পারে। পাল্লাটা ঐদিকেই ভারি। আর সেটাই যদি হয়, ধাপ্পাবাজ মিঠু আরেকটা প্রতারণার জাল বুনেছে মাত্র। না সে শুধরে গেছে, না সে হাল ছেড়ে দিয়েছে। এই হলো পিঁপড়াবিদ্যার প্রধান চরিত্র। ঘণ্টাদুই তার সঙ্গে থেকে, তার ক্রমাগত ধরা খাওয়া দেখতে দেখতে, যদিবা তার প্রতি মায়া জন্মায়, সেটা পরিচালকের চাওয়া নাইবা হল।
সুতরাং, এই চরিত্রটি, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের বেকার বড় ভাইটি, পরিবার ও নিজের টিকে থাকার সংগ্রামে বেপরোয়া হয়ে যা কিছু করেছে তার দায় দায়িত্ব তো তাকেই নিতে হবে। রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের আর্থিক ব্যবস্থা, পুঁজির গতিপথ, পুঁজি একাট্টা করার মৌলিক পদ্ধতি আর গোটা পুঁজিতন্ত্রের যে অন্তর্নিহিত দুর্বলতা বিদ্যমান, তাকে ‘পিঁপড়াবিদ্যা' ঘাটায় না। এর বেশি কিছু ভাবে না, তাই ভাবায়ও না।
তাহলে যেটা দাঁড়াল সেটা হলো এই, পিঁপড়াবিদ্যা সমাজের অসঙ্গতির জন্য দায়ী করছে নিম্নমধ্যবিত্ত ও লুম্পেন বেকারকেও। তার উচ্চাভিলাষই তার পতনের সূত্র। মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কিংবা শেয়ার-বাজারের দ্যূতক্রীড়া - কোথাও উচ্চশ্রেণীর ভূমিকা থাকলেও তা পিঁপড়াবিদ্যায় উহ্য। পশ্চিমে বড়লোকের প্রতিষ্ঠান যখন ছোটলোকের টাকা হাতিয়ে সেটা জুয়ায় খুইয়েছে, তখন পশ্চিমের সরকার বাহাদুরেরা ছোটলোকদের ট্যাক্সের টাকা ফের বড়লোকদের দিয়ে সেই অসঙ্গতি সংশোধন করেছে। পিঁপড়াবিদ্যার মিঠুও দিনের শেষে ঐ একই সংশোধনের চক্করে। এই হলো পিপিলীকার পাখা - মিঠু জাতীয় লোকেদের উচ্চাভিলাষ, যার পরিণতি - এই যে দেখেন - এমনই হয়।সুতরাং, ক্যামেরা দোদুল্যমান থাকলেও, মিঠুর গল্পের বেশ একটা ঈশপীয় সমাপন ঘটে, সেইখানে কোনো দোদুল্যমানতা নাই।
[৫]
নীতিবাগীশ দর্শক এক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন করতে পারেন। মিঠু একটা দুইনম্বরি, অতি-লোভের ‘উচিৎ' শাস্তি সে পেয়েছে, সুতরাং তার বিষয়ে দোদুল্যমান থাকার কোনো জায়গা নাই। তার শ্রেণীগত পরিচয় তাকে জোচ্চুরি করার লাইসেন্স দেয় না। আলবৎ। সেক্ষেত্রে মিঠুর অপকর্মের শিকার যে নায়িকা, রিমা, তার দিকে নজর দেয়া যাক। রিমা ভিক্টিম।
চিত্রনায়িকা রিমা ও তার ছেলেবন্ধুর প্রাইভেট কর্মকাণ্ডের ভিডিও মিঠুর হাতে পৌঁছে যায়, মিঠু তাকে ব্ল্যাকমেইল করে, যার এক পর্যায়ে সে রিমাকে তার সঙ্গে দৈহিক সম্পর্কে যাবার জন্য বাধ্য করে। ‘পিঁপড়াবিদ্যা'র এই জায়গাটা চমৎকার। রিমাকে প্রথমে পরাজয় স্বীকার করে নিতে দেখা গেলেও, হঠাৎই সে মিঠুকে প্রহার করা শুরু করে। কষিয়ে চড় মারতে মারতে জানিয়ে দেয় ভিডিওটা নিয়ে মিঠু যা ইচ্ছা করতে পারে, তার আর কিছু যায় আসে না। বাংলাদেশের সমাজে যৌনসন্ত্রাসের ভিক্টিমকেই যেখানে পাপের বোঝা বইতে হয়, যেখানে অহরহ তাদের আত্মহত্যা করতে হয়, সেখানে এই ঘুরে দাঁড়ানোর সিন - 'তোর যা ইচ্ছা কর' - সিনেমাটিকে বিশেষ উচ্চতায় নিয়ে যায়। কিন্তু পতনে সময় লাগে না। খুব তাড়াতাড়িই আবার রিমাকে দেখা যায় যে মিঠুর কাছ থেকে ভিডিও পুনরুদ্ধারে মরীয়া হতে। প্লট এগিয়ে চলে শিকার ও শিকারীর ক্লান্তিকর ইঁদুর-বিড়াল খেলায়।
রিমার চরিত্রটি শেষ পর্যন্ত দৃঢ়তা না পাওয়ায় এবং সেকারণে সেক্সটেপ ফাঁস হওয়াকে সন্ত্রাস হিসাবে চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হওয়ায়, ফারুকীর ছবির বিনোদিত দর্শক সেই পুরাতন রক্ষণশীল প্রশ্নখানিই মাথায় নিয়ে বাড়ি ফেরে। আগে বল্, ওসব ছবি তুলতে গেলি কেন?
অতঃপর, মিঠুর মতোই রিমার ক্ষেত্রেও, নিপীড়ক রাষ্ট্র/সমাজব্যবস্থাকে রেয়াত দিয়ে ক্ষুদ্র ব্যক্তিকে ডাইনীপোড়ানোর খেলায় লেলিয়ে দিয়ে সমাজে সঙ্গতি ফেরত আসে। টুস টুস করে উঁকুন মারায় যে ক্ষণিকের আনন্দ, ‘পিঁপড়াবিদ্যা'য় সে আনন্দ প্রচুর। এ আরেক সাফল্য।