'ও ক্যাপ্টেন, মাই ক্যাপ্টেন'

‘চাক, ক্যাম... গ্রেট টু সি ইউ...’ বলেই লন্ডনের মঞ্চ থেকে এক গাল হাসি নিয়ে দর্শকসারির দিকে তাকালেন এক অভিনেতা। দর্শকরা হাসিতে ফেটে পড়লেন। হাসছিলেন প্রিন্স চার্লস এবং ডাচেস অফ কর্নওয়াল ক্যামিলা পারকারও। সম্ভবত বিশ্বে একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন রবিন উইলিয়ামস, যার পক্ষে সম্ভব ছিল সামনাসামনি রাজদম্পতির সঙ্গে এভাবে ‘বেয়াদবি’ করা।

হাসান বিপুলবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 August 2014, 07:23 AM
Updated : 14 August 2014, 01:10 PM

রবিন উইলিয়ামসের রসিকতার শিকার হয়েছেন হলিউড তারকা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, এমনকি স্বয়ং পোপ পর্যন্ত। অথচ তাদের কেউই কখনও অপমানিত বোধ করেননি সেসব দুষ্টুমিতে।

যাকে মনে করা হতো অফুরন্ত প্রাণশক্তির আধার, সেই রবিন উইলিয়ামস নিজেই নিজের জীবনাবসান ঘটালেন ১১ অগাস্ট, সোমবার।

বলা হতো ৬৩ বছরের তরুণ তিনি। কিন্তু জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো কাটিয়েছেন বিষণ্নতায়। আজও রবিন উইলিয়ামসের নাম উচ্চারিত হলেই কোটি ভক্তের মনে ভেসে ওঠে হাসিমাখা এক মুখের ছবি। অথচ তার অভিনীত ‘মনে দাগ কাটা’ প্রায় সব চরিত্রই তীব্র মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে থাকা এক মানুষ।

বিভিন্ন স্ট্যান্ডআপ কমেডিতে রবিন ছিলেন স্বতঃস্ফূর্ত, তাৎক্ষণিক তৈরি করতেন তীর্যক সব রসিকতা। অথচ কোন কাজটি করা উচিৎ অথবা উচিৎ নয় সে বিবেচনায় বরাবরই ছিলেন ধীর-স্থির। অর্থের বিচারে দরিদ্র ছিলেন না বটে, তবে হলিউডের শীর্ষ ধনী তারকার তালিকায় তার নামও ওঠেনি কোনোকালেই। তারপরও 'মিসেস ডাউটফায়ার’সহ অন্তত চারটি ব্যবসাসফল চলচ্চিত্রের সিকুয়াল তৈরির প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে তিনি দ্বিতীয়বার ভাবেননি।

রবিন উইলিয়ামসের জীবনাবসানে মার্কিন সাময়িকী টাইম-এ এক প্রতিবেশীর মন্তব্য-- “আমি দাবি করব না যে আমি তাকে খুব ভালোভাবে চিনতাম। তবে আমার ভাবতে ভালো লাগত যে আমি তাকে চিনি।” প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, প্রায়ই এলাকার ছোট রেকর্ড শপে তিনি গানের সিডি উল্টেপাল্টে দেখতেন। এলাকার কোনো প্রয়োজনে কিংবা কোনো মহৎ উদ্দেশে তাকে ডাকা হলে ফিরিয়ে দেননি কখনও। অথচ প্রতিবেশীবান্ধব সজ্জন মানুষটি তখন মনের দিক থেকে অসম্ভব একাকী জীবন কাটাচ্ছেন, ফের ডুবছেন মদে।

এরও অনেক আগে, আশির দশকের শুরুতে যখন রবিন উইলয়ামসের তারকাদ্যুতি ক্রমশ উজ্জ্বল হচ্ছে, সে সময়ই তিনি প্রথমবার তলাচ্ছেন কোকেইনের অন্ধকারে। কয়েক বছরের মধ্যে ফিরেও এসেছিলেন। পশাপাশি টিভি সিরিজ ‘মর্ক অ্যান্ড মিন্ডি’র কাল্পনিক এলিয়েন থেকে কয়েক বছরের মধ্যে ‘পপাই’ আর ‘দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাকর্ডিং টু গ্রাপ’ পার হয়ে তিনি ফিরলেন ভিয়েতনাম যুদ্ধের বাস্তবতায়।

১৯৮৭ সালে ‘গুড মর্নিং ভিয়েতনাম’ নামের ওই সিনেমাতেই সায়গনে পোস্টিং পাওয়া উর্দির আড়ালে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন এক রেডিও জকি সৈনিকের চরিত্রে অভিনয় করে প্রথম অস্কার মনোনয়ন পান তিনি।

পরের অস্কার মনোনয়ন পান সেই সিনেমাটির জন্য, রবিন উইলিয়ামসের নামের সমার্থক হয়ে উঠেছে যেটি। ‘ডেড পোয়েটস সোসাইটি’ নামের ওই সিনেমায় তিনি স্রোতের বিপরীতে চলা ক্ষ্যাপাটে শিক্ষক। যিনি ছাত্রদের উৎসাহ জোগান ফুরিয়ে যাওয়া দিনগুলোকে ধরে রাখার জন্য। যিনি ছাত্রদের বলেন-- ‘সিজ দ্য ডে’।

এরপর শোকাতুর গৃহহীনের চরিত্র নিয়ে ‘দ্য ফিশার কিং’।

চতুর্থবারে ‘গুড উইল হান্টিং’-এর জন্য হাতে উঠল অস্কার। পঞ্জিকায় তখন ১৯৯৮ সাল। শ্রাইন অডিটোরিয়ামে স্বর্ণযুবাকে হাতে নিয়ে এক মুহূর্তের জন্য হয়ত রসিকতা করতে ভুলে গেলেন রবিন। সরল স্বীকারোক্তি-- “গোটা জীবনে এই একবারই হয়ত আমার মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরুবে না।”

দর্শকদের হাসিতে অবশ্য পরক্ষণেই ফিরে গেলেন স্বরূপে। ‘গুড উইল হান্টিং’-এর গোটা টিম আর স্ত্রীকে ধন্যবাদ দেওয়ার পর বললেন, “আর ধন্যবাদ আমার বাবাকে, যিনি ওই আকাশে কোথাও আছেন। আমি অভিনেতা হতে চাই শুনে যিনি বলেছিলেন, খুবই ভালো কথা, কেবল ঠেকনা দেওয়ার জন্য একটা বিকল্প পেশাও রেখো, যেমন ধরো ঝালাইয়ের কাজ!”

পরের বছর সত্য ঘটনা অবলম্বনে ‘প্যাচ অ্যাডামস’। প্রচলিত রীতির বাইরে গিয়ে চিকিৎসাবিদ্যার এক ছাত্র মানসিক হাসপাতালে রোগীর মুখে হাসি ফোটাতে চান।

এরপর নানারকম চরিত্রে অভিনয় করেছেন রবিন। ২০০২ সালের ‘ইনসমনিয়াতে’ তিনি থ্রিলার লেখকের আড়ালে খুনি। ওই একই বছর ‘ওয়ান আওয়ার ফটো’-তে বিকারগ্রস্ত ফটো ডেভেলপার।

ব্যস্ত অভিনয় আর স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ান ক্যারিয়ারের পাশাপাশি সময় দিয়েছেন এইচবিও প্রযোজিত ‘কমিক রিলিফ’-এ, যেটির অর্থ চলে যেত গৃহহীনদের সহায়তায়।

মানবিক গুণসম্পন্ন এই অভিনয় শিল্পী অন্তত ছয়বার গিয়েছেন আফগানিস্তানে, আরও কয়েকবার ইরাক আর কুয়েতে। না, আক্রান্তদের মানবিক সহায়তা দানের জন্য নয়, সেখানে অবস্থানরত মার্কিন সেনাদের মনোবল চাঙ্গা করার জন্য। ওই সময়ই আবার তিনি কমেডি শো করেছেন, নাম ছিল ‘উইপনস অফ সেল্ফ ডেস্ট্রাকশন’। আর সবশেষে ফিরেছেন ব্রডওয়েতে। নাটকের নাম ‘বেঙ্গল টাইগার অ্যাট দ্য বাগদাদ জু’। রাজিভ জোসেফের লেখা ওই নাটকে রবিন উইলয়ামসের চরিত্র ছিল চিড়িয়াখানার এক বাঘের যে ইরাকে মার্কিন আক্রমণের সময় বন্দি হয়। এক পর্যায়ে সে নিহত হয় মার্কিন সেনার গুলিতে।

মার্কিন সমর মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল জন কারবি তার সন্তানের ১৮তম জন্মদিনের ঠিক আগে রবিন উইলয়ামসের কাছে সন্তানের জন্য উপদেশ চেয়েছিলেন। রবিনের উপদেশ ছিল, ‘হৃদয়কে অনুসরণ কর, মস্তিষ্ক মাঝেমধ্যে ভুল করে’।

বিষাদগ্রস্ত রবিন জীবনের শেষ সিদ্ধান্তে মস্তিষ্ক নয়, সম্ভবত হৃদয়কেই অনুসরণ করেছেন। কোনো যুক্তিই কী আসলে আত্মহত্যার রায় দেয়?

যদিও ‘ডেড পোয়েটস সোসাইটি’র জন কিটিং সিনেমায় মৃত্যু নয়, জীবনের পথ দেখায়। যে পাগলাটে শিক্ষক তার ছাত্রদের কাছে কেবল বই পড়ানো মাস্টারমশাই নন, ওয়াল্ট হুইটম্যানের ভাষায় তিনি হয়ে ওঠেন ‘ও ক্যাপ্টেন, মাই ক্যাপ্টেন’।