রঙিন রবিন

“একটি আনন্দময় মুহূর্তের কথা ভাবো, আমার মতো তুমিও উড়তে পারবে”— ‘হুক’ সিনেমার পিটার প্যান উড়ে চলে গেছেন, সেলুলয়েডে রেখে গেছেন অসংখ্য আনন্দময় মুহূর্ত।

শরীফুল হক আনন্দবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 August 2014, 08:12 AM
Updated : 12 August 2014, 09:25 AM

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোতে বেলা ১১টা ৫৫ মিনিটে নাইন ওয়ান ওয়ানে একটি কল আসে। বলা হয়, একজন ব্যক্তিকে তার বাড়ির ভেতরে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গেছে এবং তার শ্বাস-প্রশ্বাসও বন্ধ রয়েছে। জরুরি চিকিৎসাপ্রদানকারীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে সেই ব্যক্তিকে মৃত ঘোষণা করেন। রবিন ইউলিয়ামসের মৃত্যুর সময় হিসেবে নথিবদ্ধ করা হয় ১১ অগাস্ট, সোমবার, বেলা ১২ টা ২মিনিট।

উইলিয়ামসের স্ত্রী সুজান স্নাইডার এক বিবৃতিতে বলেন, “তাকে আমরা স্মরণ করবো, তবে মৃত্যুতে নয়, বরং তার সেই অসংখ্য আনন্দ ও হাসির মুহূর্তে, যা তিনি লাখো মানুষকে দিয়ে গেছেন।”

প্রাসাদের বাসিন্দা উইলিয়ামসের বাবা ছিলেন ডেট্রোয়েটের এক অটোমোবাইল কোম্পানির বড় কর্মকর্তা। ছোটবেলাটা কেটেছে হাজারো খেলনা সেনা আর বড় বাড়ির খালি কামরার সান্নিধ্যে। কে ভেবেছিল একাকী সেই ছেলেটি হাসি-তামাশায় দুনিয়া মাতাবে।

১৯৯৮ সালে মুক্তি পাওয়া ‘হোয়াট ড্রিমস মে কাম’  সিনেমার দৃশ্যে রবিন উইলিয়ামস।

ক্যারিয়ারের শুরুটা হয়েছিল একজন স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ান হিসেবে। ১৯৭৭ এ ‘ক্যান আই ডু ইট টিল আই নিড গ্লাসেস’ এবং ‘দ্য রিচার্ড প্রায়র শো’- এর মাধ্যমে তাকে দেখতে পায় মার্কিন দর্শকরা।

১৯৭৮ সালে শুরু হয় এবিসি নেটওয়ার্কের টিভি সিরিজ ‘মর্ক অ্যান্ড মিন্ডি’র মাধ্যমে টিভি সিরজের মর্ক চরিত্রে অভিনয় করেন উইলিয়ামস। অর্ক গ্রহের বাসিন্দা মর্ক, যে অভিনন্দন জানায় ‘নানু, নানু’ বলে, উইলিয়ামসকে করে তোলে ছোটপর্দার তারকা।

১৯৮০ সালে তিনি পেয়ে যান সিনেমায় অভিনয় করার সুযোগ। জনপ্রিয় কার্টুন চরিত্র ‘পপাই’- এ অভিনয় করে কিশোর ভক্তকূল তৈরি করেন উইলিয়ামস। তবে ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরে যায় ব্যারি ল্যাভিনসন পরিচালিত ‘গুড মর্নিং, ভিয়েতনাম’ সিনেমাটির মাধ্যমে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া প্রথাবিরোধী এক রেডিও জকির চরিত্রে অভিনয় তাকে এনে দেয় অস্কার মনোনয়ন। পিটার ওয়ারের ক্লাসিক সিনেমা ‘ডেড পোয়েটস সোসাইটি’তে অভিনয় এক ইংরেজি শিক্ষকের চরিত্রে যিনি তার শিক্ষার্থীদের বলেন, ‘এই মুহূর্তে বাঁচো’।

১৯৮৯ সালে মুক্তি পাওয়া ‘ডেড পেয়েটস সোসাইটি’ সিনেমার দৃশ্যে রবিন উইলিয়ামস।

১৯৯৩ সালে মুক্তি পাওয়া ‘মিসেস ডাউটফায়ার’ সিনেমার দৃশ্যে রবিন উইলিয়ামস, স্যালি ফিল্ড, লিসা জ্যাকব, ম্যাথু লরেন্স ও মারা উইলসন।

জীবনের প্রতিটি মূহূর্তকে আনন্দময় করে তোলার সেই ফুর্তি এবং প্রাণশক্তি উছলে পড়েছে তার ভেতর থেকে। ডিজনির অ্যানিমেটেড সিনেমা ‘আলাদীন’ এর ক্ষ্যাপাটে জিনি কিংবা ‘জুমানজি’- এর জঙ্গলে আটকে থাকা অ্যালেন পেরিশ-উইলিয়ামসের অসামান্য প্রাণচাঞ্চল্য পর্দার চরিত্রগুলোকে জীবন্ত করে তুলেছে। আমেরিকান ফিল্ম ইন্সটিউটের শত বছরের সেরা হাসির সিনেমার মধ্যে ৬৭ নম্বরে থাকা ‘মিসেস ডাউটফায়ার’- সিনেমায় নারীর সাজে উইলিয়ামস, কমেডি সিনেমার এক নতুন ধারারই জন্ম দেন। নব্বইয়ের দশকে জুটে যায় আরও দুটি অস্কার মনোনয়ন। ‘দ্য ফিশার কিং’-এ গৃহহীন পেরির চরিত্রে তার অভিনয় শেষ পর্যন্ত তাকে অস্কার এনে না দিলেও ১৯৯৭ এ ‘গুড উইল হান্টিং’-এক থেরাপিস্টের চরিত্র অভিনয় করে পার্শ্ব চরিত্রে সেরা অভিনেতার অস্কার জিতে নেন।

সবসময়ই যে পর্দায় হাসির খোরাক যুগিয়েছেন তা নয়। ২০০২ সালে ক্রিস্টোফার নোলানের ‘ইনসমনিয়া’ সিনেমায় দুর্ধ্বর্ষ এক ধর্ষকামী খুনি কিংবা ১৯৯৯ এর ‘বাইসেনটেনিয়াল ম্যান’- এ মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে চাওয়া এক অ্যান্ড্রয়েডের চরিত্র তার ক্যারিয়ারে যোগ করেছে ভিন্ন মাত্রা। 

দর্শকদের কেবল বিনোদনই যোগানই, মানুষের দুর্দশায় তাদের পাশেও এসে দাঁড়িয়েছিলেন এই মানুষটি। হুপি গোল্ডবার্গ এবং বিলি ক্রিস্টালকে সঙ্গে নিয়ে তিনি গড়েছিলেন কমিক রিলিফ, যা ঘরহারা মানুষদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে বার বার। হারিকেন ক্যাটরিনায় ক্ষতিগ্রস্থ মানুষদের পুনর্বাসনে তিনি আয়োজন করেছিলেন বছরব্যাপী একটি কমেডি শো’র, যার পুরো টাকাই তিনি বিলিয়ে দিয়েছেন অসহায় মানুষগুলোর জন্য।

১৯৯৫ সালে মুক্তি পাওয়া ‘জুমাঞ্জি’ সিনেমার দৃশ্যে রবিন উউলিয়ামস, ক্রিস্টেন ডানস্ট।

১৯৯৭ সালে মুক্তি পাওয়া ‘গুডউউল হান্টিং’ সিনেমার দৃশ্যে রবিন উইলিয়ামস ও ম্যাট ডেমন।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এক বিবৃতিতে রবিন উইলিয়ামস সম্পর্কে বলেছেন, “তিনি তার অপরিসীম মেধা খোলা হাতে বিলিয়ে দিয়েছেন তাদের মধ্যে, যাদের তা সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল-- সেটা দেশের বাইরে অবস্থানরত আমাদের সেনারা হোক কিংবা দেশের রাস্তায় প্রান্তিক মানুষেরা।”

১৯৫১ সালের ২১শে জুলাই শিকাগোতে জন্ম নেওয়া রবিন ম্যাকলরিন উইলিয়ামস জুলিয়ার্ড স্কুলে অভিনয় শিক্ষা লাভ করেন। প্রথম স্ত্রী ভ্যালেরি ভেলারডির সঙ্গে এক ছেলে জ্যাক এবং দ্বিতীয় স্ত্রী মারশা গ্রেসের সঙ্গে এক মেয়ে জেলডা ও এক ছেলে কোডিকে রেখে গেছেন।