'অসম্ভবকে সম্ভব করাই অনন্তর কাজ'

একটি বিজ্ঞাপনচিত্রে অনন্ত জলিল যখন এই সংলাপ আওড়ান, সেটাকে একটুও বাড়াবাড়ি মনে নাই হতে পারে। বিশেষ করে প্রথম সিনেমা ‘খোঁজ- দ্য সার্চ’ থেকে শুরু করে গেল বছরের ‘নিঃস্বার্থ ভালবাসা’- সবগুলো সিনেমাতেই ঢাকাই চলচ্চিত্রের নতুন এই তারকা যা করে দেখিয়েছেন, তারপর।

সেঁজুতি শোণিমা নদীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 August 2014, 04:36 AM
Updated : 10 August 2014, 04:36 AM

অনন্তর চলচ্চিত্রের আঙ্গিক, অভিনয়, উচ্চারণ সবকিছু নিয়েই সমালোচনা থাকতে পারে, কিন্তু ম্যাড়ম্যাড়ে ঢাকাই ছবিতে একটা ‘চকচকে’ ভাব নিয়ে আসেন তিনি। ইন্ডাস্ট্রির বেহাল দশার মধ্যেও বিশাল বিনিয়োগ করে একের পর এক ছবি বানানোর সাহসটাও তিনিই দেখিয়েছেন। বিশেষ ধরনের কাহিনিবিস্তারে আর সংলাপ প্রক্ষেপণের ‘গুণে’ অনন্তর ছবি বিরতিহীন বিনোদনের খোরাক যোগায়।

আর সে-কারণেই, ঈদে মুক্তি পাওয়া ‘মোস্ট ওয়েলকাম টু’ নিয়েও প্রত্যাশার পারদ ছিল উঁচুতে। প্রায় পৌনে তিন ঘণ্টার সিনেমা দেখার পর বলতে হচ্ছে, সেই প্রত্যাশার প্রতি সুবিচার করতে পারেননি তিনি।

বিরক্তির কারণ অনেকগুলোই। দুর্বল গল্প, গোঁজামিলে ভরা চিত্রনাট্য, পরিচালনার বেহাল দশা, অপরিপক্ক অভিনয়— বাংলাদেশের সিনেমার নিয়মিত ত্রুটিগুলো তো রয়েছেই, সঙ্গে যোগ হয়েছে লাগাতার বৈশিষ্ট্যহীন গানের দৃশ্যায়নে কাঁচা হাতের কম্পিউটার জেনারেটেড ইমেজারির ব্যবহার।

অভিনেতা অনন্ত তার ২০১২ সালের সিনেমা ‘মোস্ট ওয়েলকাম’ পর্যন্ত কাজ করেছেন অন্য পরিচালকদের সঙ্গে। ২০১৩ সাল থেকে নিজের ছবি নিজেই পরিচালনা করা শুরু করেন তিনি। একাধারে পরিচালনা, প্রযোজনা, আর অভিনয়- তিনটি কাজই করতে গেলে অনন্তের পক্ষেও যে তা অসম্ভব হয়ে পড়ে, সেটাই প্রমাণ করলো ‘মোস্ট ওয়েলকাম টু’।

গল্প না গোঁজামিল?

বাঙালি বিজ্ঞানী হাসান মইন খান (সোহেল রানা) আবিষ্কার করেছেন ক্যান্সারের প্রতিষেধক। সেই প্রতিষেধক মানবসেবায় কাজে লাগাতে চান তিনি। আর আন্তর্জাতিক অপরাধচক্র চায় সেটিকে বাগিয়ে নিয়ে ব্যবসা করতে। বিজ্ঞানী আর তার পুরো পরিবারের জীবন তাই হুমকির মুখে। এহেন সংকটকালে সৎ, নিষ্ঠাবান আর অন্যায়কারীদের যম হিসেবে আবির্ভাব পুলিশ অফিসার অনন্তের। বিজ্ঞানীর রক্ষাকর্তার দায়িত্ব পালনের মধ্যেই অনন্ত প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন বিজ্ঞানী খানের নাতনী অধরা চৌধুরীর (আফিয়া নুসরাত বর্ষা) সঙ্গে। এর মধ্যে আবার হাসান মইন খানকে ধরে নিয়ে যায় অপরাধীরা। দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেয় ‘ছোঁয়াচে’ ক্যান্সারের ভাইরাস (!)। আর দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ অনন্তকে অব্যাহতি দেওয়া হয় পুলিশের চাকরি থেকে। অনন্ত কী পারবে বিজ্ঞানীকে উদ্ধার করতে? নাকি তার আগেই ক্যান্সারের ‘মহামারি’ নিঃশেষ করে দেবে গোটা জাতিকে?

এ ধাঁচের গল্প নিয়ে হলিউড, বলিউডে তৈরি হয়েছে অসংখ্য সিনেমা। তবে অসংখ্য গোঁজামিল ঝাঁঝরা করে দিয়েছে গল্পের কাঠামোকে। কয়েকটি গোঁজামিল পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি।

গোঁজামিল ১: অনন্ত একজন সৎ পুলিশ অফিসার। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তার পর্যায়ের সরকারি চাকরিজীবীর পৈত্রিক/বৈবাহিক সূত্রে পাওয়া ছাড়া আলিশান বাড়ি থাকা কিছুটা অসম্ভব। সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন তিনি। বিধবা মা (দিতি) আর বোনকে নিয়ে তিনি থাকেন প্রাসাদপ্রতীম বাড়িতে। চালান পাজেরোর মতো বিলাসবহুল গাড়ি।

গোঁজামিল ২: কুকুর থেকে ছড়াতে পারে জলাতঙ্ক। কিন্তু ‘মোস্ট ওয়েলকাম টু’ ‘জানালো’, ক্যান্সারের মতো রোগও ছড়ানো সম্ভব ঐ সারমেয়-সংস্পর্শেই!

গোঁজামিল ৩: জলবসন্ত কিংবা যক্ষার মতো এই ক্যান্সার আবার সংক্রামক। হাঁচি, কাশি এমনকী স্পর্শ থেকেও ক্যান্সারের ‘ভাইরাস’-এ আক্রান্ত হওয়া সম্ভব। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ডাক্তারদের তাই দেখা গেল গ্যাসমাস্ক আর প্লাস্টিকের মোটা দস্তানা পরে রোগীদের সেবা দিতে!

গোঁজামিল ৪: গুণ্ডাদের সঙ্গে মারপিট করতে করতে ‘সুপারকপ’ অনন্ত ঢাকার রাস্তা থেকে চলে আসেন আশুলিয়ার তুরাগ-তীরে। পরের দৃশ্যেই একই গুণ্ডাদের সামলাতে নায়িকাসমেত অনন্ত, জলপ্রপাতে ঘেরা এক বনে পৌছে যান।

গোঁজামিল ৫: গুণ্ডাদের তাড়া খেয়ে সেই ‘অলৌকিক’ বনে রাত কাটানোর পর নায়িকা অধরার উদ্দেশ্যে অনন্তর সংলাপ- ‘চলো, তোমাকে বাসায় দিয়ে আসি’! আগের দৃশ্যেই যে দুর্গম অরণ্য দেখানো হলো, সেখান থেকে অধরাকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার অসম্ভব প্রস্তাবও বোধকরি অনন্তের পক্ষেই সম্ভব!

বলিহারি ভিস্যুয়াল ইফেক্টস

নব্বইয়ের দশকে বিটিভির জনপ্রিয় সিরিজ অ্যারাবিয়ান নাইটসের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে? ‘আলিফ-লায়লা’ নামেই বেশি পরিচিত ওই সিরিজে মেঘের উপর দিয়ে দৈত্য আর পরীদের নেমে আসাসহ নানা রকমের দৃশ্যে যে ধরনের স্পেশাল ইফেক্ট ব্যবহার করা হতো, অনেকটা সেরকম কারসাজিই দেখা গেল সিনেমার সবগুলো গানে। সাধারণভাবে ‘ক্রোমা’ নামে পরিচিত সেই বিশেষ প্রযুক্তির ওপর ভর করে বর্ষাকে নিয়ে অনন্ত ঘুরে বেড়ালেন অ্যান্টার্কটিকা থেকে সাহারা মরুভুমি; সুইডেন থেকে সিঙ্গাপুর!

বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে একের পর এক গান। প্রথম চার-পাঁচটি গানের পর বাকিগুলোর কথা মনে রাখাও কঠিন হয়ে পড়ে।

আগের প্রতিটি সিনেমাতেই অনন্ত-বর্ষা জুটির গানগুলো ছিল উপভোগ্য। কারণ, দেশ-বিদেশের নয়নাভিরাম লোকেশনে সেইসব গান দেখতেও ছিল দারুণ, শুনতেও ছিল ভাল। ‘খোঁজ-দ্য সার্চ’-এ জলপ্রপাতের অসাধারণ লোকেশনে অনন্ত-বর্ষার ‘এতোদিন কোথায় ছিলে’ গানটির কথা অনেকদিন মনে রেখেছে দর্শক। কিন্তু এবারের গানগুলোতে সত্যিকারের লোকেশনের বদলে ক্রোমা দিয়েই কাজ সারতে চেয়েছেন অনন্ত। আর ‘চিকেন তান্দুরি’র মতো গানে বলিউডি সুর আর নাচের অনুকরণও হতাশ করেছে। সবমিলিয়ে গানের দিক থেকেও ‘মোস্ট ওয়েলকাম টু’ অনন্তর আগের সিনেমাগুলোকে অতিক্রম করতে পারেনি।

পুরো সিনেমাতেই যে বিষয়টি দৃষ্টিকটু মনে হয়েছে সেটা হলো বিদেশি ছবির দৃশ্যের ‘ইনসার্টে’র অতিরিক্ত ব্যবহার। কুকুরের ক্যান্সার ছড়ানোর দৃশ্য থেকে শুরু করে অ্যাকশন দৃশ্যগুলিতেও বিদেশি ছবি থেকে শট কেটে জুড়ে দিয়েছেন অনন্ত। সেই সঙ্গে পুরো সিনেমার সম্পাদনাতেও ছিল ভুলের ছড়াছড়ি।  

অভিনেতা অনন্তের ‘উন্নতি’

এতসব হতাশার মাঝেও যে বিষয়টি আলাদা করে চোখে পড়েছে, সেটা হল অভিনেতা হিসেবে অনন্ত জলিলের উন্নতি। বেশ কিছু দৃশ্যে আবেগের অভিব্যক্তি দিলেন বেশ গভীরতার সঙ্গেই, অনন্তের প্রথম দিককার সিনেমায় যেটা ছিল অনুপস্থিত।  ইংরেজি উচ্চারণও এবার অনেকটাই ঠিকঠাক।

অনন্তের অভিনয় মোটামুটি উৎরে গেলেও বর্ষার অবস্থা থেকে গেছে আগের মতোই। অভিনয় কিংবা নাচ- কোনটিই খুব ভালোভাবে করতে পারেননি তিনি। তবে অ্যাকশনে ছিলেন উপভোগ্য।

সিনেমায় সবচেয়ে ভাল অভিনয়টা এসেছে মিশা সওদাগরের কাছ থেকে। যদিও সিনেমার শেষ পর্যন্ত তার উপস্থিতি ছিল না। এছাড়া প্রবীর মিত্র (পুলিশ কমিশনার রাহাত খান) আর সোহেল রানার অভিনয় ছিল চলনসই। অনন্তর মায়ের চরিত্রে দিতি আর বর্ষার মায়ের চরিত্রে চম্পার মেলোড্রামাটিক অভিনয় বাহুল্য মনে হতে পারে।

সবমিলিয়ে ‘মোস্ট ওয়েলকাম টু’ অনন্ত জলিলের ঘোর ভক্তদের জন্যই।