‘তুমি যে আমার কবিতা’

বাক প্রতিবন্ধী এক তরুণী। তার চোখে বাংলার শ্যামলিমা। সহজ-সরল হাসি অধরে। সেই হাসি দেখে মুগ্ধ হয় এক তরুণ। কিন্তু সে জানে না মেয়েটির চোখে ভাষা থাকলেও তার কণ্ঠ শব্দহীন। মেয়েটিকে বিয়ে করে তরুণ। তারপর যখন জানতে পারে নববধূ বাকপ্রতিবন্ধী তখন সংসারে শুরু হয় চরম অশান্তি। অনেক ঘটনার পর তরুণ উপলব্ধি করে ভালোবাসার ভাষা বুঝতে কথার প্রয়োজন হয় না, প্রকৃতির মতোই ভালোবাসা প্রকাশিত হয় স্বতঃস্ফূর্তভাবে এবং নীরবে।

শান্তা মারিয়া, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 June 2014, 08:30 AM
Updated : 6 June 2014, 11:24 AM

এমনি এক ব্যতিক্রমী কাহিনি নিয়ে ১৯৭০ সালে মুক্তি পায় চলচ্চিত্র ‘বিনিময়’। সুভাষ দত্ত পরিচালিত এই সিনেমায় তরুণের চরিত্রে উজ্জ্বল এবং বাকপ্রতিবন্ধী তরুণীর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন কবরী। নিঃসন্দেহে চরিত্রটি ছিল চ্যালেঞ্জিং। তবে সেই চ্যালেঞ্জ সাফল্যের সঙ্গেই মোকাবেলা করেন কবরী। ছবিটি দারুণ ব্যবসা সফল হয় এবং ক্ল্যাসিকে পরিণত হয়। ছবির মূল সম্পদ ছিল কবরীর অসাধারণ অভিনয়। কোনো সংলাপ ছাড়া এই চরিত্র ফুটিয়ে তোলার জন্য প্রয়োজন যে অভিনয় দক্ষতার তা কবরীর আয়ত্তাধীন ছিল। এই সিনেমা তাকে  এনে দেয় বিপুল খ্যাতি ও সাফল্য।

সাফল্য অবশ্য এর আগেই পেয়েছিলেন তিনি। বলতে গেলে তার শুরুটাই হয়েছিল সাফল্যের হাত ধরে।

১৯৬৪ সালে চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে তার। প্রথম অভিনীত সিনেমা ‘সুতরাং’। সুভাষ দত্ত পরিচালিত এই সিনেমা তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের প্রথম ছবি, যা আন্তজার্তিক সম্মাননা পায়। ১৯৬৫ সালে ফ্রাংকফুর্ট চলচ্চিত্র উৎসবে দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে পুরস্কার পায় ‘সুতরাং’। আর সেই সঙ্গেই কবরীর ইনিংস শুরু হয় সাফল্যের সঙ্গে। এরপর  একের পর এক সিনেমা মুক্তির সঙ্গে তার স্কোরবোর্ডে যোগ হতে থাকে সাফল্য।

সুভাষ দত্তের পরিচালনায় ১৯৬৭ সালে মুক্তি পায় ‘আবির্ভাব’। এর মাধ্যমে রূপালি পর্দায় আবির্ভাব ঘটে নতুন জুটির। রাজ্জাক-কবরী জুটি দর্শকের প্রিয় হয়ে ওঠে। পরপর মুক্তি পায় এ জুটির ব্যবসা সফল ছবি ‘নীল আকাশের নিচে’, ‘ময়নামতি’। সে সময় এ দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তাল। একদিকে পাকিস্তানি শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় উর্দু সিনেমার রমরমা বাজার। অন্যদিকে পূর্ববাংলার জনগণের মধ্যে জেগে উঠছে বাংলাভাষার প্রতি ভালোবাসা ও দেশপ্রেম। বাঙালির মধ্যে বিকশিত হচ্ছে অসাম্প্রদায়িক জাতীয় চেতনা। এই পরিস্থিতিতে উর্দু সিনেমার জনপ্রিয় জুটি শবনম-রহমান ও শাবানা-নাদিমের বিপরীতে বাংলা সিনেমার রাজ্জাক-কবরী জুটির সিনেমা পাল্লা দিয়ে এগুতে থাকে।

স্বাধীনতার পরে রাজ্জাক-কবরী জুটির যে ছবিটিকে বলা হয় ‘ট্রেন্ড সেটার’ তার নাম ‘রংবাজ’। এ সিনেমায় লাস্যময়ী কবরীর দেখা পায় দর্শক। সুপার হিট হয় সিনেমাটি। এ ছবির ‘সে যে কেন এল না, কিছু ভালো লাগে না’ গানটি দর্শকের মুখে মুখে ফেরে। এ গানের সঙ্গে কবরীর চটুল অভিব্যক্তি দর্শক হৃদয়ে আলোড়ন তোলে। রাজ্জাক-কবরী প্রায় ষাট-সত্তরটি সিনেমায় এক সঙ্গে অভিনয় করেন। এর মধ্যে ‘ঢেউয়ের পর ঢেউ’, ‘পরিচয়’, ‘অধিকার’, ‘বেঈমান’, ‘অবাক পৃথিবী’, ‘সোনালি আকাশ’, ‘অনির্বাণ’, ‘দীপ নেভে নাই’-সহ বিভিন্ন সিনেমা এখনও সে যুগের দর্শকের মনের কোঠায় জমা হয়ে আছে। পরবর্তীতে ‘আমাদের সন্তান’ ছবিতে রাজ্জাক-কবরীকে দেখা গেছে বয়স্ক বাবা মায়ের ভূমিকায়।

দুয়েকটি ছবিতে লাস্যময়ী হিসেবে দেখা গেলেও ষাট ও সত্তরের দশকের দর্শকের কাছে কবরীর মূল আবেদন ছিল বাড়ির পাশের মিষ্টি মেয়ে রূপে। যে নারী ঘরের, যে নারী অতি আপন, যে নারী বাংলার প্রকৃতির মতোই কোমল ও স্নিগ্ধ, সে রূপেই দর্শক হৃদয়ে চিরস্থায়ী কবরী। 

ধরা যাক ‘সারেং বউ’ চলচ্চিত্রের কথা। শহীদুল্লাহ কায়সারের ক্ল্যাসিক উপন্যাস অবলম্বনে আবদুল্লাহ আল মামুন পরিচালিত এ সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন কবরী। সে সময় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে দাপটের সঙ্গে অভিনয় করছেন গ্ল্যামারাস ববিতা এবং সুন্দরী শাবানা। কিন্তু প্রবাসী নিখোঁজ স্বামীর জন্য প্রতীক্ষাকাতর সারেং বাড়ির বউ নবিতুনের চরিত্রে কবরীর বিকল্প কেউ ছিলেন না। কবরী অসাধারণ অভিনয় করেন এ চলচ্চিত্রে। বিশেষ করে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে সংগ্রাম এবং জলোচ্ছ্বাসের পর বেঁচে যাওয়া মৃতপ্রায় স্বামীকে (ফারুক) জীবনদানের জন্য ধর্মবিরুদ্ধ সিদ্ধান্তে তার অভিনয় ছিল অনবদ্য। কাদামাখা কবরী সে দৃশ্যে নিজের গ্ল্যামার নিয়ে একটু ভাবেননি, ভেবেছিলেন শুধু চরিত্রটিকে যথাযথভাবে রূপায়িত করার কথা।

কবরী যেমন ‘সারেং বউ’ হিসেবে সার্থক তেমনি সার্থক ‘পার্বতী’ চরিত্রে। চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘দেবদাস’ সিনেমায় বুলবুল আহমেদের বিপরীতে ‘পার্বতী’ বা ‘পারু’ চরিত্রে তার বিকল্প কাউকে আজও ভাবা যায় না। ‘দেবদা… নদীতে এত জল, এত জলেও কি আমার কলংক ঢাকা পড়বে না’-- পারুর এই বিখ্যাত সংলাপ অনবদ্যভাবে উচ্চারিত হয় কবরীর মুখে। এ ছবির শেষ দৃশ্যেও তার অভিনয় ছিল অসাধারণ।

কবরী অভিনীত আরেকটি ক্ল্যাসিক সিনেমা ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত ১৯৭৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এ সিনেমায় ‘রাজার ঝি’ চরিত্রে অভিনয় করেন কবরী। এ সিনেমায় তার সহশিল্পী ছিলেন গোলাম মুস্তাফা, রওশন জামিল, রোজী সামাদ, প্রবীর মিত্র প্রমুখ। তিতাস নদীর তীরবর্তী গ্রামের জনজীবন নিয়ে অদ্বৈত মল্লবর্মণের অসামান্য সৃষ্টি ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের এই চিত্ররূপ এখন পর্যন্ত নির্মিত বাংলা সিনেমার মধ্যে অন্যতম সেরা হিসেবে গণ্য।

সৈয়দ হাসান ইমাম পরিচালিত বিকল্পধারার সিনেমা ‘লাল সবুজের পালা’য় কবরী অভিনয় করেন তারিক আনামের বিপরীতে। এখানেও তিনি ছিলেন গ্রামীণ পটভূমিকায় সম্পূর্ণ মানানসই। 

কবরী দর্শকের কাছে যৌনাবেদনময়ী নন বরং সহজ সরল মিষ্টি মেয়েরূপেই বেশি গ্রহণযোগ্য ছিলেন। এর প্রমাণ পাওয়া যায় ‘সুজন-সখী’ সিনেমার ব্যাপক সাফল্যে। খান আতাউর রহমান পরিচালিত সত্তর দশকের এ সিনেমাটি ছিল গ্রামীণ পটভূমিতে নির্মিত। কাহিনিও তেমন জটিল নয়। পারিবারিক দ্বন্দ্ব এবং শৈশবে বিচ্ছিন্ন চাচাতো ভাইবোন সুজন (ফারুক) ও সখীর (কবরী) প্রেম এই সিনেমার মূল উপজীব্য। গ্রামীণ তরুণ তরুণীর ভূমিকায় ফারুক ও কবরী দুজনেই ছিলেন অনবদ্য। ‘সব সখীরে পার করিতে নেব আনা আনা…’ গানের সঙ্গে দুজনের অভিব্যক্তি দর্শক হৃদয়ে চির জাগরুক। গানটির জনপ্রিয়তাও ছিল আকাশচুম্বী। সিনেমাটি এখন পর্যন্ত সর্বাধিক ব্যবসাসফল ঢাকাই ছবির অন্যতম। 

ফারুক-কবরী জুটির আরেকটি ব্যবসাসফল ছবি ‘দিন যায় কথা থাকে’। ফারুক-কবরীর অভিনয়ে ছবিটি সমৃদ্ধ। শিরোনামের গানটিও ছিল জনপ্রিয়।

কবরী-বুলবুল আহমেদ-শাবানা অভিনীত ত্রিভূজ প্রেমের ছবি ‘বধূ-বিদায়’ বাণিজ্যিকভাবে দারুণ সফল হয়। কাজী জহির পরিচালিত এ সিনেমাতেও কবরী স্বামীর জন্য প্রতীক্ষাকাতর এক গ্রাম্যবধূর চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকপ্রিয়তা পান।

লোককাহিনিভিত্তিক সিনেমা ‘সাত ভাই চম্পা’ এবং ‘পারুলের সংসার’-এর রাজকন্যা রূপেও কবরী দর্শক নন্দিত হয়েছিলেন। দুটি ছবিই বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়েছিল। বাংলাদেশের লোকজ কাহিনির নায়িকা হিসেবে তার মধ্যে দর্শক লাবণ্যময়ী শ্যামবর্ণা চিরায়ত বাঙালি নারীকেই প্রত্যক্ষ করেছিল।

কবরী বিভিন্ন সময় রাজ্জাক, ফারুক, উজ্জ্বল, আলমগীর, বুলবুল আহমেদ, সোহেল রানা, ওয়াসিম ও জাফর ইকবালের মতো দর্শদপ্রিয় নায়কদের বিপরীতে অভিনয় করেছেন। স্বাধীনতার আগে অভিনয় করেছেন জহির রায়হানের উর্দু ছবি ‘বাহানা’-তে। তার অভিনীত ‘আগন্তুক’, ‘হীরামন’, ‘চোরাবালি’, ‘আপন-পর’, ‘দর্পচূর্ণ’ ছবিও ব্যবসাসফল।

আশির দশকে নির্মিত টিভি নাটক ‘যেখানে তারার আলো’-তে চিত্রনায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। নোবেলজয়ী লেখক পার্ল এস বার্কের ‘গুড আর্থ’ অবলম্বনে আশির দশকে নির্মিত বিটিভির  ধারাবাহিক নাটক ‘মাটির কোলে’-তে কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রে অভিনয় করে দর্শক সমালোচকের প্রশংসা পান কবরী। স্বাধীনতার আগে ‘সংশপ্তক’ নাটকের যে সাতটি পর্ব নির্মিত হয়েছিল তাতে ‘রাবু’ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন কবরী। পরবর্তীকালে আশির দশকে নাটকটি নতুনভাবে নির্মিত হলে অবশ্য তিনি আর তাতে অভিনয় করেননি। ২০০৪ সালে ‘আয়না’ নামে একটি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন তিনি। 

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় কবরীর ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয় ও সাহসী। তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠসৈনিক।

পঞ্চাশের দশকে চট্টগ্রামে জন্ম গ্রহণকারী মীনা পাল (কবরীর পারিবারিক নাম) এবং পরবর্তীকালের চিত্রনায়িকা কবরীর পারিবারিক ও রাজনৈতিক জীবন এ লেখার বিষয়বস্তু নয়। সমাজসেবামূলক কাজের সঙ্গেও জড়িত রয়েছেন তিনি।

কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে তার পরিচয় রূপালি পর্দায় বাঙালি নারীর চিরন্তন রূপকার হিসেবে। ‘দর্পচূর্ণ’ সিনেমায় নায়ক রাজ্জাক নায়িকা কবরীর উদ্দেশ্যে বলেছিলেন-- ‘তুমি যে আমার কবিতা’ (গানটির প্লেব্যাকে ছিলেন মাহমুদ-উন নবী)। সত্যিই রূপালি পর্দায় বাংলার জনজীবনের প্রেমের কাব্যের নায়িকা হিসেবে বাংলাছবির দর্শকের মনে চিরদিন বেঁচে থাকবেন কবরী। চলতি বছরে তার অভিনয় জীবনের ৫০ বর্ষ পূর্তি  হল। ক্যারিয়ারের এই ‘হাফ সেঞ্চুরি’-তে তার অভিনীত ক্ল্যাসিক ছবিগুলোর কথা দর্শকের মনে ফিরে আসে বারবার।