রূপালি ভুবনের প্রেম-যৌনতা

শুরুটা হয়েছিল ‘দ্য গ্রেট ট্রেন রবারি’র মতো কয়েকটি সিনেমা দিয়ে যেখানে ভালোবাসার তেমন কোনো ভূমিকা ছিল না। আর বলিউডের শুরু হয়েছিল ‘রাজা হরিশচন্দ্র’র মাধ্যমে। বাংলাদেশেও ‘লাইট অফ এশিয়া’র কথাই বলা হোক কিংবা ‘মুখ ও মুখোস’ বা ‘জাগো হুয়া সাবেরা’র কথা। কোনোটাই প্রেমবিষয়ক নয়। কিন্তু তারপরও হলিউড, বলিউড বা বাংলা চলচ্চিত্রের মূল সুর হয়ে দাঁড়ায় প্রেম।

>> শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Feb 2014, 04:57 PM
Updated : 19 Feb 2014, 07:55 AM

হলিউডের কথাই বলা যাক প্রথমে। এক সময় হলিউডে নির্মিত হয়েছে ভালোবাসার অসাধারণ সব ছবি। হলিউডের প্রেমের সিনেমা বললে প্রথমেই মনে পড়ে ‘রোমান হলিডে’র কথা। গ্রেগরি পেক ও অড্রে হেপবার্ন অভিনীত কালজয়ী প্রেমের ছবি রোমান হলিডে। প্রাসাদ থেকে পালিয়ে যাওয়া রাজকন্যা আর মার্কিন সাংবাদিক, দুই ভুবনের দুই বাসিন্দার ভালোবাসা। রোম শহরে তাদের স্বল্প সময়ের রোমান্স। ফলাফল অবশ্যই বিচ্ছেদ। কিন্তু দর্শক হৃদয়ে চির অমলিন তাদের প্রেম।

কিংবা ‘ক্যাসাব্লাংকা’ সিনেমায় নায়ক রিকের ভূমিকায় হামফ্রে বোগার্টের মুখে সেই অসাধারণ সংলাপ, ‘ইউ প্লেইড ইট ফর হার, ইউ ক্যান প্লে ইট ফর মি’। ভালোবাসার মানুষকে সুখী করার জন্য মানুষ নিজের জীবন দিতে পারে হাসি মুখে, তারই কাহিনি হামফ্রে বোগার্ট আর ইনগ্রিড বার্গম্যান অভিনীত ‘ক্যাসাব্লাংকা’।

সেই সঙ্গে আরও মনে পড়ে আমেরিকার গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে অনন্য প্রেমকাহিনি ‘গন উইথ দ্য উইন্ডস’-এর কথা। স্কারলেট ও’হারার ভূমিকায় ভিভিয়ান লেই আর ক্লার্ক গেবলের চুম্বন দৃশ্য যেন প্রেমিক প্রেমিকার শ্বাশত মিলন।

এলিজাবেথ টেইলর আর রিচার্ড বার্টন। যেমন রুপোলি পর্দায় মিসরের রানি ক্লিওপেট্রা আর রোমান সেনাপতি মার্ক এন্টোনির চিরায়ত প্রেমকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তেমনি বাস্তব জীবনেও তারা ছিলেন প্রেমের প্রতিভূ। তাদের প্রেম, বিয়ে, বিচ্ছেদ ঝড় তুলত মিডিয়ার। এলিজাবেথ টেইলর ছিলেন প্রেমিকার প্রতীক। অন্যদিকে মেরিলিন মনরো ছিলেন হলিউডের যৌনতার প্রতীক, প্রেমের নন। ব্যক্তিজীবনেও প্রেম তাকে চিরদিন বঞ্চনাই করেছে। বরং প্রেমের প্রতীক ছিলেন সোফিয়া লোরেন, অড্রে হেপবার্ন, ইনগ্রিড বার্গম্যান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সোফিয়া লোরেন আর মার্সেলো মাস্ত্রিয়ানি অভিনীত ‘সান ফ্লাওয়ার’ এক অসাধারণ প্রেমের গল্প। যুদ্ধে বিচ্ছিন্ন এক দম্পতির প্রেম-বিরহের এই ছবি যুদ্ধের ভয়াল থাবায় ক্ষতবিক্ষত মানুষের প্রেমকে তুলে ধরেছে।

আনা কারনিনা-- লেভ তলস্তয়ের লেখা বিশ্বের সেরা উপন্যাস। মানবমনের জটিল গতিপ্রকৃতি আর প্রেমের এই চিরায়ত উপন্যাসকে বহুবার চলচ্চিত্রের পর্দায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। গ্রেটা গার্বো থেকে কেইরা নাইটলি অনেক অভিনেত্রীই আনার প্রেমকে তুলে ধরেছেন। তবে এদের মধ্যে নিঃসন্দেহে সেরা ছিলেন গ্রেটা গার্বো, তার চোখে যে অভিব্যক্তি ফুটে উঠত তা ছিল শ্বাশত প্রেমিকার। কাউন্ট ভ্রনস্কির প্রতি বিবাহিতা আনার ভালোবাসাকে তুলে ধরার ক্ষমতা বোধহয় একমাত্র গ্রেটা গার্বোর মতো কিংবদন্তি অভিনেত্রীর পক্ষেই সম্ভব ছিল।

জর্জ বার্নার্ড শ’র লেখা মঞ্চসফল নাটক পিগম্যালিয়ন। পুরাণের ভাস্কর পিগম্যালিয়ন আইভরি দিয়ে নির্মাণ করেন নিখুঁত নারীমূর্তি যার নাম গ্যালাতিয়া। সেই গ্যালাতিয়াকে তিনি দেবী ভেনাসের বরে জীবন্ত করে তোলেন নিজের প্রেমের শক্তিতে। বার্নার্ড শ’র পিগম্যালিয়ন নাটকের নায়ক ধ্বনিতত্ত্বের প্রফেসর হেনরি হিগিনস আধুনিক পিগম্যালিয়ন। ধ্বনিতত্ত্বের এই গবেষক বস্তির মেয়ে এলিজা ডুলিটলকে গড়ে তোলেন ইংরেজ সমাজের আদবকায়দাদুরস্ত আর নিখুঁত ভাষায় কথা বলতে পারা অভিজাত লেডি রূপে। চলচ্চিত্রে তাদের প্রেমের দারুণ মজার কাহিনিকে রূপ দিয়েছিলেন রেক্স হ্যারিসন আর অড্রে হেপবার্ন। এই প্রেমকাহিনির নায়ক হিসেবে রেক্স হ্যারিসন জিতেছিলেন অস্কার। আরেকটি মজার রোমান্টিক কমেডি হল রক হাডসন আর জিনা লোলো ব্রিজিতা অভিনীত ‘কাম সেপ্টেম্বর’।

যৌনতা যখন চলচ্চিত্রের পর্দায় শিল্পিতভাবে রূপায়িত হয়েছে তখন প্রেম আরও বাস্তবানুগ ও হৃদয়গ্রাহীভাবে দর্শকের মনে দাগ কেটেছে। কিন্তু যখন তা স্থূলভাবে ব্যবহৃত হয়েছে তখন তা প্রেমের অনুভূতিকে বরং বিনষ্টই করেছে। প্রেমের ছবির অনুষঙ্গ হিসেবে খুব স্বাভাবিকভাবেই এসেছে যৌনতা। যেমন ৯০ সালে মুক্তি পাওয়া ‘ঘোস্ট’ ছবিতে প্যাট্রিক সুয়েজে এবং ডেমি মুরের অসাধারণ শয্যাদৃশ্য।

সত্তর ও আশির দশকে হলিউডের সিনেমায় প্রেমের পরিবর্তে যৌনতাই প্রধান হয়ে ওঠে। সে সময় আধুনিক যৌনতার প্রতীক হয়ে ওঠেন র‌্যাকুয়েল ওয়েলস, বো ডেরেক, শ্যারন স্টোন। তবে নব্বই দশকে আবার কয়েকটি অসাধারণ প্রেমের ছবি উপহার দেয় হলিউড। এর মধ্যে ‘নটিং হিল’ আর ‘প্রেটি ওম্যানে’র কথা না বললেই নয়। দুটিরই নায়িকা জুলিয়া রবার্টস। ‘প্রেটি ওম্যান’ সিনেমায় যৌনকর্মীরূপী জুলিয়া রবার্টসের প্রেমে পড়েন ভালোবাসায় অবিশ্বাসী রিচার্ড গিয়ার। আর ‘নটিং হিল’ সিনেমায় ফুটে ওঠে  চিত্রনায়িকারূপী জুলিয়া আর লন্ডনের এক বইয়ের দোকানদার হিউ গ্র্যান্টের মিষ্টি রোমান্স। দুটি ছবিই মিলনাত্মক।

তবে একুশ শতকে হলিউডের মূল সুর আর প্রেম নয়। হলিউডের মূল ট্রেন্ড এখন সাইফাই, থ্রিলার, ফ্যান্টাসি, অ্যাকশন। যেখানে সুপারহিরো আর স্পেশাল ইফেক্টের জয়জয়কার। এর মধ্যেও ‘নোটবুক’, ‘লাভ একচুয়ালি’,‘ফাইভ হান্ড্রেড ডেইজ অব সামার’, ‘দ্য রিডার’, ‘দ্য আার্টিস্ট’, ‘ত্রিস্তান’, কিংবা ‘টোয়ালাইট’ সিরিজের কথা বলা যায়। ‘টোয়ালাইট’ প্রেমের ছবি হলেও এটা আসলে ফ্যান্টাসিই। সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক প্রেমের ভাষা যেন যেন হারিয়ে ফেলেছে হলিউড।

তবে এর আগে ১৯৯৭ সালে হলিউডই উপহার দিয়েছে বিশ্বের অন্যতম সেরা প্রেমের সিনেমা ‘টাইটানিক’। জ্যাক আর রোজের ভূমিকায় লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও এবং কেইট উইন্সলেট চিরকালের প্রেমিক প্রেমিকার ছবি এঁকেছেন। দর্শকহৃদয়ে চির অমলিন জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে রোজ ও জ্যাকের সেই ভালোবাসায় ভেসে যাওয়ার অনবদ্য দৃশ্য ও গান। টাইটানিকেও যৌনতা ছিল কিন্তু তা বঁতিচেল্লির ভেনাসের মতোই শিল্প-ভাস্বর।

বলিউডে অসংখ্য প্রেমের ছবি নির্মিত হয়েছে। অ্যাকশন বা থ্রিলার ধাঁচের ছবির মধ্যেও থাকে প্রেমকাহিনি। প্রেম ছাড়া বলিউডি মুভি খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে সব সিনেমাতেই প্রেম থাকলেও সব সিনেমাই ক্ল্যাসিক প্রেমের ছবি হয়ে উঠতে পারে না। কারণ অনেক সিনেমারই মূল উপজীব্য থাকে সমাজের অসংগতি, প্রেম নয়। এর মধ্যে ‘বৈজুবাওরা’, ‘অচ্ছুত কন্যা’, ‘দিদার’, ‘উড়ান খাটোলা’ ইত্যাদি প্রেমের ছবি।

তবে এতসব প্রেমকাহিনির ভিড়েও হারিয়ে না গিয়ে দর্শকস্মৃতিতে প্রেমের সিনেমা হিসেবে চির জাগরুক হয়ে আছে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র।

বলিউডের প্রেমিক নায়ক ছিলেন দীলিপ কুমার। দীলিপ কুমার মধুবালার পর্দা রোমান্স যেমন দর্শক হৃদয়ে ঝড় তুলত তেমনি এই জুটির বাস্তব প্রেমকাহিনিও মিডিয়ায় গুঞ্জন তুলেছিল। অনেক সিনেমাতেই দীলিপ-মধুবালা পর্দায় প্রেম করলেও তাদের সেরা ছবি এবং বলিউডের অন্যতম সেরা প্রেমের সিনেমা ‘মোগল-এ- আজম’। মোগল স¤্রাট আকবরের ছেলে যুবরাজ সেলিম আর প্রাসাদ নর্তকী আনারকলির প্রেমকে তুলে ধরা হয়েছে ‘মোগল-এ-আজম’-এ। অভিনয়, দৈহিক সৌন্দর্য এবং ম্যানারিজমে এই দুই চরিত্রে দীলিপ কুমার, মধুবালার বিকল্প সে সময় এবং এখনও বলিউডে নেই।

পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পর্দা এবং ব্যক্তিজীবনে রোমান্টিক জুটি হয়ে উঠেছিলেন দেবানন্দ-সুরাইয়া, রাজকাপুর-নার্গিস, দীলিপ কুমার-মধুবালা, গুরুদত্ত-ওয়াহিদা রহমান। ওয়াহিদা রহমানকে ভালোবেসে বিবাহিত গুরুদত্ত শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করেন। ওয়াহিদা রহমান-দেবানন্দ অভিনীত ‘গাইড’ প্রেমের ছবি হিসেবে দারুণ।

ষাটের শেষ ও সত্তর দশকে নির্মিত হয়েছে অনেক প্রেমের ছবি, যার কয়েকটা টিকে গেছে ক্ল্যাসিক হিসেবে। এর মধ্যে কিশোর প্রেমের ছবি ‘ববি’র কথা বলা যায়। ঋষিকাপুর-ডিম্পল কাপাডিয়ার সেই ছবিটি চিরসবুজ। এখানে যৌনতা রয়েছে তবে তা এসেছে প্রাসঙ্গিকভাবেই। শর্মিলা ঠাকুর রাজেশ খান্নার ‘আরাধনা’, রাজেশ খান্না ও হেমা মালিনীর মেহবুবা, অমিতাভ-জয়া ভাদুরির ‘মিলি’, ফারুখ শেখ-পুনম ধীলনের ‘নূরী’, রাজেশ-মুমতাজ জুটির ‘আপ কি কসম’ পুরোপুরি প্রেমনির্ভর সিনেমা।

রাজকাপুর পরিচালিত শশী কাপুর ও জিনাত আমান অভিনীত ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’ও প্রেম এবং রূপের দ্বন্দ্ব নিয়ে নির্মিত ছবি। তবে এখানে অকারণ যৌনতার আগুনে পুড়ে গেছে প্রেম। আশির দশকে প্রেমের পরিবর্তে স্থূল যৌনতাই হয়ে ওঠে বলিউডের মূল সুর। মারদাঙ্গা, অপরাধ, যৌনতা ও কিছুটা প্রেমের মিশেলে যে ছবিগুলো নির্মিত হতে থাকে তা তাৎক্ষণিকভাবে বাজার ধরতে পারলেও ক্ল্যাসিক প্রেমের ছবির দাবি করতে পারে না কোনোভাবেই।

তবে এর মধ্যেও কয়েকটি ছবির কথা বিশেষভাবে বলা প্রয়োজন। প্রথমেই আসে ‘সিলসিলা’র কথা। অ্যাংরি ইয়ং ম্যান হিসেবে পরিচিত অমিতাভ বচ্চন এখানে পুরোপুরি প্রেমিক। পর্দায় এ সিনেমায় অমিতাভের নাম অমিত আর তার প্রেমিকা রেখার নাম চাঁদনি। সিনেমায় জয়া তার স্ত্রী। প্রেমিকার স্বামীর ভূমিকায় সঞ্জীব কুমার। পরকীয়া প্রেমের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা গল্পে চারজনের মানসিক টানাপড়েন অসামান্য সব সিকোয়েন্সের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন কিং অব রোমান্স ইয়াশ চোপড়া।

শ্রীদেবী, ঋষিকাপুর, বিনোদ খান্না অভিনীত ‘চাঁদনি’ও প্রেমের সিনেমা। অনিল কাপুর-শ্রীদেবী অভিনীত ‘লমহে’ ইয়াশ চোপড়ার অসাধারণ একটি প্রেমের সিনেমা। সিনেমাটির গল্প যেমন অসাধারণ তেমনি অসাধারণ এর দৃশ্যায়ন। কমল হাসান-রতি অগ্নিহোত্রী অভিনীত ‘এক দুজে কে লিয়ে’ পুরোপুরি প্রেমনির্ভর ছবি। ঋষিকাপুর, জেবা বখতিয়ার অভিনীত ‘হেনা’ বিখ্যাত প্রেমের সিনেমা।

নব্বই দশকে আবার হিন্দি সিনেমার মূল সুর হয়ে ওঠে প্রেম। ৮৯ সালে মুক্তি পাওয়া আমির খান জুহি চাওলা অভিনীত ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’ ছবির মাধ্যমে প্রেমের ধারা নতুনভাবে শুরু হয়। সালমান খান, ভাগ্যশ্রী অভিনীত ‘ম্যায়নে পেয়ার কিয়া’ সিনেমাটি প্রেমের সিনেমার ক্ষেত্রে এক মাইলফলক। নিটোল প্রেমের গল্প এটি। একই ধারায় আমির-পূজা ভাট অভিনীত ‘দিল হ্যায় কি মানতা নেহি’, আমির-মাধুরী জুটির ‘দিল’, সালমান-চাঁদনি অভিনীত ‘সনম বেওয়াফা’, আদিত্য পাঞ্চলি-রুখসার অভিনীত ‘ইয়াদ রাখেগি দুনিয়া’ বাণিজ্যিকভাবে সফল প্রেমের ছবি। সালমান, সঞ্জয় দত্ত মাধুরী অভিনীত ‘সাজন’ ত্রিভুজ প্রেমের অমর ছবি। হলিউডের ‘অ্যান এফেয়ার টু রিমেমবার’ অবলম্বনে নির্মিত আমির খান, মণীষা কৈরালা অভিনীত ‘মন’ ছবিটিও প্রেমের সিনেমা হিসেবে দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে।

বলিউডে প্রেমের ছবির কথা বলতে হলে শাহরুখ-কাজল জুটির কথা বলতেই হবে। আজ পর্যন্ত বলিউডের সেরা রোমান্টিক জুটি শাহরুখ-কাজল। এই জুটির ‘দিল ওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’ চিরসবুজ প্রেমের ছবি। একই জুটির ‘কুছ কুছ হোতা হায়’ও চিরসবুজ প্রেমের সিনেমা। এই সিনেমাগুলোও যৌনতাবিহীন বলা চলে। শাহরুখ খান, মাধুরী দীক্ষিত অভিনীত ‘দিল তো পাগল হ্যায়’ মিউজিকাল-রোমান্স হিসেবে খ্যাত। শাহরুখ খান-প্রীতি জিনতা অভিনীত ‘বীরজারা’র মাধ্যমে ভারত-পাকিস্তানের সীমান্ত যে হার মানে প্রেমের কাছে তা প্রমাণ করতে চেয়েছেন ইয়াশ চোপড়া। ইয়াশ চোপড়ার শেষ ছবি ‘যব তক হ্যায় জান’ও প্রেমনির্ভর।

পরকীয়া প্রেমনির্ভর হওয়ায় কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী বলা যায় শাহরুখ খান, রানি মুখার্জি অভিনীত ‘কাভি আল বিদা না কেহনা’কে। সামান্য যৌনতাও রয়েছে এখানে যদিও তা সিনেমাটিকে স্থূল করে তোলেনি।

শাহিদ কাপুর, কারিনা কাপুর অভিনীত ‘যব উই মেট’ বলিউডের আরেকটি আলোচিত প্রেমের ছবি। শাহিদ-কারিনা বাস্তবজীবনেও ছিলেন প্রেমিক-প্রেমিকা। মজার বিষয় হল, এই জুটি যখন সত্যি সত্যি প্রেমিক-প্রেমিকা ছিলেন তখন তাদের সিনেমা হিট করেনি। অথচ ‘যব উই মেট’ যখন নির্মিত হয় তখন তাদের সম্পর্ক ভেঙে গেছে। আর এই ছবিতেই তাদের পর্দা রসায়ন অসাধারণ হয়ে ওঠে।

সঞ্জয় লীলা বনসালি পরিচালিত ‘হাম দিল দে চুকে সনম’ আরেকটি চিরসবুজ প্রেমের ছবি। এই ছবিতে ঐশ্বরিয়া রাই, সালমান খান এবং অজয় দেবগানের অভিনীত চরিত্রগুলোর প্রেম এক ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। সিনেমাটির প্রথম অংশের কাহিনি অনেকটা মৈত্রেয়ী দেবীর ‘ন হন্যতে’ উপন্যাসের আদলে গড়ে উঠলেও শেষ অংশ মৌলিক এবং অসাধারণ।

বলিউডের মূল সুর এখনও প্রেম। এই সেদিনও হিট হয়েছে ‘রানঝানা’,‘শুদ্ধ দেশি রোমান্স’ এবং ‘রাম-লীলা: গোলিও কি রাসলীলা’র মতো প্রেম নির্ভর সিনেমা।

উপমহাদেশের প্রেমের সিনেমার কথা বলতে গেলে ‘দেবদাস’-এর কথা না বললেই নয়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস দেবদাসকে কলকাতা, মুম্বাই ও ঢাকায় বহুবার চলচ্চিত্রায়িত করা হয়েছে। তামিল, তেলেগু, অহমিয়া, উর্দুভাষাও রিমেক হয়েছে। দেবদাসের ভূমিকায় বিভিন্ন সময়ে অভিনয় করেছেন প্রমথেশ বড়–য়া, কে এল সায়গল, দীলিপ কুমার, সৌমিত্র, বুলবুল আহমেদ, শাকিব খান, শাহরুখ খান। পার্বতী হয়েছেন যমুনা, সুচিত্রা সেন, সুপ্রিয়া, কবরী, অপু বিশ্বাস, ঐশ্বরিয়া।

দেবদাস-পার্বতী-চন্দ্রমুখীর ট্র্যাজিক প্রেমকে বলা যায় ক্ল্যাসিক। এ অঞ্চলের মানুষের হৃদয়ে চিরকালই প্রেমিকের প্রতীক চঞ্চল, খেয়ালি, ছন্নছাড়া তরুণ দেবদাস এবং প্রেমিকার প্রতীক তার বাল্যসখী পারু।

বলিউডের মতো কলকাতা ও ঢাকার বাংলা সিনেমার মূল সুরও প্রেম। অ্যাকশন, কমেডি, সমাজবাস্তবতা সিনেমা যে ঘরানারই হোক না কেন ছবিতে প্রেম থাকবেই। এর মধ্যে আলাদা করে প্রেমের সিনেমা বেছে নেওয়া মুশকিল। প্রমথেশ বড়–য়া ও কানন দেবী অভিনীত ‘তুফান মেল’ ছিল ত্রিশ-চল্লিশের দশকে আলোচিত প্রেমের ছবি। কলকাতার বাংলা সিনেমায় প্রথম রোমান্টিক জুটি উত্তম-সুচিত্রা। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেন অভিনীত সিনেমাগুলো বাংলা সিনেমার দর্শককে আধুনিক ভালোবাসার স্বাদ দিয়েছে এ কথা বলা চলে অনায়াসে। উত্তম-সুচিত্রা জুটির প্রেমের সিনেমার মধ্যে অগ্নিপরীক্ষা, ‘সাগরিকা’ ‘হারানো সুর’, ‘সপ্তপদী’, ‘ইন্দ্রানি’, ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’, ‘পথে হল দেরি’ উল্লেখযোগ্য। উত্তম কুমার, সুপ্রিয়া দেবী অভিনীত ‘চিরদিনের’, উত্তম কুমার-সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় অভিনীত ‘নিশিপদ্ম’ চিরসবুজ প্রেমের ছবি।

পরবর্তীতে তাপস পাল দেবশ্রী রায়ের ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’, প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জি ও বিজেতা প-িত অভিনীত ‘অমর সঙ্গী’ আলোচিত প্রেমের ছবি।

ঢাকাই সিনেমায়ও প্রেমের কাহিনির অভাব নেই। এরই মধ্যে কয়েকটি সিনেমাকে ক্ল্যাসিক বলা যায়। ‘অবুঝ মন’, ‘মধু মিলন’, ‘ময়নামতি’, ‘নাচের পুতুল’, ‘সুতরাং’, ‘নীল আকাশের নিচে’, ‘চকোরি’, ‘স্বরলিপি’-- সবই প্রেমের ছবি। এর মধ্যে রাজ্জাক-ববিতা অভিনীত ‘অনন্ত প্রেম’ (১৯৭৭) সিনেমাটিকে প্রথম আধুনিক প্রেমের ছবি বলা যায়। এ সিনেমায় অভিনয়ের পাশাপাশি ববিতার শরীরী আবেদনও সিনেমাটির বাণিজ্যিক সফলতার পিছনের কারণ হিসেবে কাজ করেছে বলা চলে।

ববিতা-রাজ্জাক, ববিতা-ফারুক, শাবানা-আলমগীর জুটি এক সময় জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। রোমান্টিক নায়ক হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিলেন জাফর ইকবাল। সোহেল রানা ও সোমা মুখার্জি অভিনীত ‘এপার ওপার’, সুচরিতা অভিনীত ‘জাদুর বাঁশি’, জাফর ইকবালের ‘নয়নের আলো’ ফারুক ও কবরী অভিনীত ‘সুজন সখী’, রাজ্জাক-শাবানা-ফারুক অভিনীত ‘সখী তুমি কার’, শাবানা অভিনীত ‘কাঁচ কাটা হীরা’ চিরসবুজ প্রেমের ছবি। বাংলাদেশের  প্রেমের ছবিতে যৌনতা প্রথম দেখা যায় অলিভিয়া-ওয়াসিম অভিনীত ‘যখন বৃষ্টি এল-- দি রেইন’ সিনেমায়। হিন্দি সিনেমার মতো বাংলা প্রেমের সিনেমাতেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে গান। সিনেমায় ব্যবহৃত গানগুলো যথেষ্ট পরিমাণে রোমান্টিক ও শ্রুতিমধুর হলে সিনেমাও বাণিজ্যিক সফলতা পেয়েছে। সোজা ভাষায় বলা যায় সিনেমার সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করেছে গানের সফলতার উপর। আবার নায়ক-নায়িকার ব্যক্তিগত রোমান্সের গুঞ্জন ছবির ব্যবসায় ভূমিকা রেখেছে। যেমন, ববিতা জাফর ইকবালের প্রেমের গুঞ্জন এই জুটির ছবির সাফল্যে ভূমিকা রেখেছে।

বাংলাদেশের প্রেমের সিনেমার মধ্যে আলমগীর কবীর পরিচালিত ‘সীমানা পেরিয়ে’ এবং ‘সূর্যকন্যা’ সিনেমা দুটির নাম আলাদাভাবে বলা প্রয়োজন। ‘সীমানা পেরিয়ে’তে ধনিক শ্রেণি ও শ্রমজীবী শ্রেণির মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং সেই দ্বন্দ্ব অতিক্রমের গল্প বলা হয়েছে। সমুদ্র উপকূলে জলোচ্ছ্বাসের পর একটি নির্জন দ্বীপে আটকে পড়া টিনা (জয়শ্রী কবীর) এবং কালু (বুলবুল আহমেদ) কীভাবে নিজেদের শ্রেণিগত সংস্কার ত্যাগ করে পরষ্পরকে ভালোবাসে তার উপাখ্যান ‘সীমানা পেরিয়ে’।

‘সূর্যকন্যা’ সিনেমায় ভাস্কর লেলিন চৌধুরী ( বুলবুল আহমেদ) নিজের সৃষ্টি এক ম্যানিকুইনের প্রেমে পড়ে অনেকটা পিগম্যালিয়নের মতো। সেই মূর্তির জীবন্ত হয়ে ওঠার পরাবাস্তব কাহিনির ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে ‘সূর্যকন্যা’। সেই সঙ্গে পুরুষশাসিত সমাজের বিরুদ্ধে নারীর সংগ্রামও রয়েছে এই ছবিতে।

নব্বই দশকে শাবনাজ-নাঈম অভিনীত এহতেশাম পরিচালিত ‘চাঁদনি’ ছবিটি কিশোর প্রেমের ছবি হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এরপর সালমান শাহ ও মৌসুমী অভিনীত সোহানুর রহমান সোহান পরিচালিত রিমেক ছবি ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ দারুণ ব্যবসাসফল হয়। পরবর্তীতে রোমান্টিক নায়ক হিসেবে সাফল্য পান সালমান শাহ। তার ‘অন্তরে অন্তরে’ সিনেমাটি ব্যবসা সফর হয়। সালমান শাহ-শাবনূর রোমান্টিক জুটি হিসেবে দর্শকপ্রিয়তা পান। এই জুটির পর্দা রোমান্সের পাশাপাশি ব্যক্তিগত রোমান্সের গুজবও তাদের প্রেমের ছবির সাফল্যের পিছনে বড় ভূমিকা রাখে। সালমান শাহর অকাল মৃত্যুর পর বাংলা সিনেমায় প্রেমের পরিবর্তে যৌনতা আসন গেড়ে বসে। প্রেমের সিনেমায় কিছুটা যৌনতা আশির দশকে ছিল কিন্তু নব্বই দশকে বাংলা সিনেমায় যৌনতা ও অশ্লীলতা এতই প্রকট হয়ে ওঠে যে মধ্যবিত্ত সাধারণ দর্শক সপরিবারে হলে যাওয়া ত্যাগ করে। স্থূল যৌনতার এসব ছবিকে প্রেমের ছবি বলে চালানো হলেও এগুলো প্রেমের ছবি হয়ে উঠতে পারেনি কোনোভাবেই।

অসুস্থ যৌনতা ও অশ্লীলতার কারণে অনেক দিন সুস্থ রুচির দর্শক সিনেমাহলের চৌকাঠ মাড়াতেও ভয় পেয়েছেন। প্রেমের গানের নামে চলে আদি রসাত্মক খেউড়ের প্রাদুর্ভাব। এমনকি কৌতুক অভিনেতারাও খিস্তি খেউড়ের মাধ্যমে দর্শককে অসুস্থ বিনোদন দিতে থাকে। নায়কের মুখে চলে অশালীন গালিগালাজ। এর মধ্যে যে কটি হাতে গোনা ছবিকে প্রেমের ছবি বলা যায় তার মধ্যে ফেরদৌস অভিনীত ‘হঠাৎ বৃষ্টি’, রিয়াজ অভিনীত ‘প্রাণের চেয়ে প্রিয়’, হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত ও শাওন অভিনীত ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ উল্লেখযোগ্য।

বাংলা সিনেমায় নতুন দিনের আলো সূচিত হয় যে ছবির মাধ্যমে সেটিও একটি প্রেমের ছবি। গিয়াস উদ্দিন সেলিম নির্মিত ‘মনপুরা’ ছবির মাধ্যমে আবার দর্শক হলমুখী হয়।

বাংলা সিনেমায় এখন যে ট্রেন্ড চলছে তা প্রেমের ছবিরই। গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি প্রেমের ছবি মুক্তি পেয়েছে। এগুলো মোটামুটি ব্যবসা সফলও হয়েছে। দেখা যাক এদের মধ্যে কোনোটি ক্ল্যাসিকে পরিণত হতে পারে কি না।