ববি-বাপ্পির যুগলবন্দি ‘ইঞ্চি ইঞ্চি প্রেম’

‘ইঞ্চি ইঞ্চি প্রেম’ ববি-বাপ্পির প্রথম যুগলবন্দি। নতুন হলেও দুজনই ইতোমধ্যে ঢালিউডে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছেন।

নাবীল অনুসূর্যবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Jan 2014, 12:05 PM
Updated : 6 Jan 2014, 12:32 PM

অনন্ত জলিলের সিনেমা দিয়ে অভিষেক ঘটে ববির। শাকিব খানের বিপরীতেও তার সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। অন্যদিকে বাপ্পির বিপরীতে এ পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নায়িকা মাহিয়া মাহী।

তাদের যুগলবন্দি ‘ইঞ্চি ইঞ্চি প্রেম’-এর কাহিনির স্পষ্ট চারটা পর্যায় আছে। নীলা-আকাশের প্রেমের উপকাহিনি, সেই উপকাহিনিকে অনুঘটক হিসেবে ব্যবহার করে মেঘা-শুভর তথা ববি-বাপ্পির মূল প্রেমকাহিনি, সেই প্রেমের পথে পারিবারিক বাধা ও শুভ-গুম এবং মূল খলনায়ক ডলারের আবির্ভাব ও মূল ক্লাইমেক্স।

মূল প্রেমকাহিনির অনুঘটক হিসেবে আরেকটা উপ-প্রেমকাহিনির ব্যবহার কাহিনিকে একটু অন্যরকম করেছে বটে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাহিনিটি পরিণত হয়েছে বাংলা সিনেমার প্রথাগত গল্পে। এমনকি কয়েক জনের অভিনয়ও অতিনাটকীয় দোষে রীতিমতো দুষ্ট। আর বরাবরের মতোই প্রেমের ভিত্তি অত্যন্ত দুর্বল। ‘প্রেম হওয়া’র বিষয়টা কেন যেন আমাদের সিনেমায় গুরুত্ব পায় না, হঠাৎ করেই প্রেম হয়ে যায়। সে ধারা অক্ষুন্ন রেখে ববি-বাপ্পির ‘ইঞ্চি ইঞ্চি প্রেম’-ও হঠাৎ করেই হয়ে গেছে।

মেঘা ও শুভ দুজনই ভয়ংকরভাবে প্রেমে অবিশ্বাসী। তবে বাংলায় দুর্বলতা ও ভাঙা হাতের কারণে যথাক্রমে নীলা ও আকাশের হয়ে এক রকম বাধ্য হয়েই চিঠি লিখতে থাকে মেঘা ও শুভ ওরফে ববি ও বাপ্পি। আর সেই চিঠি পড়তেও থাকে দুজন। এক দফা চিঠি চালাচালিতেই ‘সুপ্ত প্রেম’ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় দুজনের মনে। তবে পরিস্থিতি নির্মাণ করে চিঠির ব্যবহার করাটা ভালো হয়েছে; চিঠির ভাষাও মন্দ নয়। তবে বাপ্পির বোনের পাঠ্যক্রমে লুতুপুতু প্রেমের কবিতা অন্তর্ভুক্ত না করলেও চলত।

ববি-বাপ্পির প্রেম হয়ে যাওয়ার পর, নীলা-আকাশ ট্রেনে চড়ে পালিয়ে গেলে, উপকাহিনির যৌক্তিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যায়নি। কিছুক্ষণ পরেই আকাশ এসে উপস্থিত হয়, যদিও নীলার মামা ও ববির বাপি ‘এনায়েত সাহেব’-এর দাপটের সামনে দাঁড়ানোর মতো ব্যক্তিত্ব আকাশ কখনও দেখায়নি। বরাবরই ‘এনায়েত সাহেব’কে পেটানোর কাজটি করে গেছে শুভ। কাজেই, নীলা যখন সিনেমার একদম শেষ দৃশ্যে পুনরাগমন করে, সেই পুনরাগমন নীলা-আকাশ একত্রে করলেই ভালো হত; মাঝের দৃশ্যগুলোতে আকাশকে না দেখালেও শুভর বন্ধুর কোনো অভাব হত না।

আবার একবার মেঘার ফুপি সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে দেখলেন, আরেক সিঁড়ি দিয়ে শুভ মেঘাকে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। তিনি সিঁড়ি দিয়ে না নেমে দুই সিঁড়ির মাঝে এসে চিৎকার করতে শুরু করলেন! কাহিনিতে এমন ত্রুটির পাশাপাশি ছোটবড় কন্টিনিউয়িটি ব্রেকও ছিল অনেক। সিনেমার ট্রানজিশন সিকোয়েন্সগুলোও তেমন উল্লেখযোগ্য হয়নি। কাহিনির এইসব খুঁটিনাটি নিয়ে প্রচুর কাজ করার জায়গা ছিল।

লম্বা সময় পর্যন্ত নায়ক শুভ ‘এনায়েত সাহেব’ তথা নায়িকা মেঘার বাবাকে পিটিয়ে গেলেও, শেষে তাদের মিল হয়। তখন তারা দুজন মিলে প্রাগৈতিহাসিক স্টাইলে পালা করে ডলারকে মারধোরও করেন। সিনেমার সমাপ্তিও একেবারেই প্রথাগত মিলনাত্মক সমাপ্তি-- সকল ইতিবাচক কুশীলবদের উপস্থিতিতে, অর্ধগোলাকৃতি চক্র নির্মাণ করে, দুই যুগলকে পাশাপাশি রেখে, পুরনো শত্রুতা ভুলে গিয়ে, সর্বাঙ্গীন মিলন।

মেঘা চরিত্রে ববি ভালো অভিনয় করেছেন, যদিও কয়েকটি সিকোয়েন্সে আবেগের বেশ ঘাটতি ছিল। বিপরীতে বাপ্পি নিজেকে ছাড়িয়ে গেছেন ভালোভাবেই; তার অভিনয়ের, বিশেষ করে সংলাপের বেশ উন্নতি হয়েছে। যদিও এখনও ব্যাপক উন্নতি প্রয়োজন। বাপ্পির বাবার চরিত্রে ভালো অভিনয় করেছেন সোহেল খান। মূলত বিনোদনদায়ী চরিত্র হিসেবে কাজ করলেও, অল্প পরিসরেও অভিনয় দেখিয়েছেন তিনি। নীলা চরিত্রে সাথী, আকাশ চরিত্রে শ্রাবণ, মেঘার বাবার চরিত্রে গাংগুয়া এবং ববির ফুপির চরিত্রে রীনা খান একেবারে এফডিসির প্রথাগত অভিনয় করেছেন; কখনও কখনও বিরক্তির উদ্রেক করলেও, প্রায়ই চরিত্রগুলোর আবেগি সংলাপ উল্টো বিনোদন জুগিয়েছে।

খলনায়ক ডলার চরিত্রে ডিজে সোহেলের অভিনয় মন্দ হয়নি। অনেক জায়গাতে অবশ্য অভিনয়ের মানে বিশাল পতনও ঘটেছে, তবে শেষ পর্যন্ত নতুন খলনায়ক হিসেবে তিনি উৎরে গেছেন। অন্যদিকে শিউর আলী চরিত্রে আফজাল শরীফ বেশ ভালোই করেছেন। বিশেষ করে তার ‘হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর’ হওয়াবিষয়ক সংলাপগুলো দর্শকদের ভালো বিনোদন দিয়েছে। শুভর বন্ধুদের মধ্যে একটি কমেডি চরিত্রও ছিল, সে চরিত্রে অভিনেতার অভিনয় বেশ ভালোই হয়েছে।

চরিত্রটির অবশ্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিকও আছে। তার সংলাপের মাধ্যমেই সিনেমার নামকরণের সার্থকতা প্রমাণ করা হয়েছে। ইঞ্চি ইঞ্চি করে তারা অর্থাৎ বন্ধুরা নীলা-আকাশের প্রেমের সার্থক পরিণতি তথা তাদের পালিয়ে যেতে সহায়তা করার পর, তারা মেঘা-শুভর ‘সুপ্ত প্রেম’ও ইঞ্চি ইঞ্চি করে বাস্তবায়ন করে; যদিও একেক বারে এক ইঞ্চি ধরলে, দুপাশ থেকে এক ইঞ্চি চেষ্টার পরই তাদের প্রেম হয়ে যায়। তারপরও যদি কোনো সন্দেহ থেকে যায়, তা ভঞ্জনের জন্য, সিনেমার শেষ দৃশ্যেও সে আরেক বার ইঞ্চি ইঞ্চি প্রেমের কথা মনে করিয়ে দেয়।

সব মিলিয়ে সিনেমার সংলাপ একেবারে গড়পরতা মানের। নায়ক কিংবা খলনায়কের চটকদার অন্ত্যমিলওয়ালা ‘আইডেন্টিকাল’ সংলাপের বালাই অবশ্য রাখা হয়নি। আইডেন্টিকাল সংলাপ তাই বলে একেবারে বাদও পড়েনি; শিউর আলীর হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওরের আইডেন্টিকাল ডায়লগগুলো অবশ্য প্রতিবারে রূপ বদলে ব্যবহৃত হয়েছে।

আবহসংগীত প্রায়শই দুর্বল। অনেক জায়গায় আবহসংগীতের কাজ সারা হয়েছে ব্যাকগ্রাউন্ড-কাকুতি দিয়ে; যেমন মেঘা-শুভকে তাড়া করার সময় গাড়ি-বাইকের শব্দের চেয়ে মুখ্য হয়ে দেখা দেয় মেঘার ফুপির ‘এই মেঘা... যাস নে... থাম...’ ইত্যাদি কাকুতি। সব মিলিয়ে সিনেমার সাউন্ড ডিজাইনিং দুর্বল।

সিনেমাটিতে গান আছে চারটি; একটি নীলা-আকাশের; বাকি তিনটিতেই আছেন ববি। দুটি ববি-বাপ্পির-- ‘সাজনা’ ও ‘ইঞ্চি ইঞ্চি প্রেম’, আরেকটি আইটেম সং-- ‘আমি বনফুল গো’, তাতেও ববির আকর্ষণীয় উপস্থিতি। গানগুলো মন্দ নয়; মনে গেঁথে না থাকলেও শুনতে খারাপ লাগে না। আর সবগুলোরই কোরিওগ্রাফি ভালো। তবে একটি গানে এশিয়ান টিভির একটি অনুষ্ঠানের স্টেজ ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে; ব্যবহারটি বিজ্ঞাপন-উদ্দেশ্যে করা হলে বিজ্ঞাপন খারাপ হয়নি।

সিনেমাটির অ্যাকশন দৃশ্যগুলো মন্দ নয়; গতি ও মাধ্যাকর্ষণের সূত্রগুলোর ব্যতিক্রম তুলনামূলক কম ঘটেছে। ওড়াউড়িও কম, তবে প্রায়ই অপ্রয়োজনীয়। তবে শেষ মারামারিতে শুভর উড়ে গিয়ে ডলারের হাত থেকে বন্দুক ছিনিয়ে নেওয়ার দৃশ্যটির দৃশ্যায়ন ভালো হয়েছে। আর শেষ মারামারির দৃশ্যে প্লাইউড ব্যবহারের আইডিয়াটি দারুণ, কিন্তু প্রয়োগ তেমন ভালো হয়নি। তবু পুরো বিষয়টা মেনে নেওয়া যেত, যদি মানুষের ধাক্কায় আস্ত পিলার ভেঙে না পড়ত। বিশেষত যখন পিলার-ভাঙা দৃশ্যগুলো অতিমানবীয়ও করা যায়নি, বিশ্বাসযোগ্যও করা যায়নি। আর নির্মাণাধীন বহুতল ভবনে চলতে থাকা সেই মারামারিতে পরিচালক ডল ব্যবহারের উত্তম চিন্তা করলেও, সেই ডলের ব্যবহার অত্যন্ত দুর্বল হয়েছে।

সিনেমার প্রথমার্ধে অবশ্য গুণগত ব্যতিক্রমধর্মী একটা মারামারির দৃশ্য আছে-- নায়িকাকে যে তুলে নিতে আসে, আর যে বাধা দিতে গিয়ে মার খায়, তারা যথাক্রমে খলনায়ক ও নায়ক নয়, বরং বিপরীত!

সিনেমার সিংহভাগ শুটিং করা হয়েছে এফডিসির অভ্যন্তরে। কিছু শুটিং এর আশপাশে, বাকিটুকু করা হয়েছে সম্ভবত সাভারে আর সাভারের গলফ ক্লাবে। আর খানিকটা শুটিং করা হয়েছে নিউ মডেল ডিগ্রি কলেজে। কলেজ ক্যাম্পাসের অনেকগুলো সিকোয়েন্সই এফডিসিতে যেভাবে কৌশলে ধারণ করা হয়েছে, তার প্রয়োগ বুদ্ধিদীপ্ত। তবে শুভ গুম হওয়ার পর, ‘ছাত্রসমাজ’-এর আন্দোলন কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ার দৃশ্যগুলো আরেকটু বিশ্বাসযোগ্য করা যেত।

তবে যেটা নিতান্ত হাস্যকর হয়েছে, (শুধু এই ছবিতেই নয়, এর আগেও অনেক ছবিতে হয়েছে) বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত হিসেবে কার্জন হল দেখানো, যেখানে মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ক্লাস হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন-পদার্থবিজ্ঞান-ইত্যাদি ক্লাসের সঙ্গে মামলা-মোকদ্দমা-বিচারাদির কোনো যোগসূত্র স্থাপন করা গেলেও তা থেকে এমন উপসংহারে আসা নিতান্ত হাস্যকর। আর মুদ্রার উল্টোপিঠ বিবেচনা করলে, তা আদালতের জন্যও রীতিমতো মানহানিকর। সব মিলিয়ে, দর্শকদের এ হেন ‘হাইকোর্ট’ দেখানো অত্যন্ত গর্হিত কাজই বটে।

সিনেমাটোগ্রাফিও গড়পরতা। সিনেমাটোগ্রাফার কিছু জায়গায় ঝলক দেখিয়েছেন বটে, কিছু জায়গায় তার স্খলন ঘটেছে। ডিফোকাসের সমস্যা ছিল বেশ কিছু দৃশ্যে। লাইটিংয়েও সমস্যা ছিল বেশ। এমনকি ‘ইঞ্চি ইঞ্চি প্রেম’ গানের দৃশ্যায়নে ববি-বাপ্পি দুজনের হলুদ রংয়ের দুটি জামার রং তিনবারে তিন রকম হলুদ মনে হয়েছে; অবশ্য ব্যাপারটা ঐচ্ছিক হয়ে থাকলে কৃতিত্বেরই বটে।

পোশাক-ভাবনা তথা কস্টিউম ডিজাইন ভালো হয়েছে। বিশেষ করে ববির পোশাক সজ্জা ছিল দারুণ। মন্দ ছিল না বাপ্পির পোশাকও। পুরো সিনেমায় কারও পোশাকই পীড়া দেয়নি, কেবল আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের, বিশেষ করে ছাত্রীদের পোশাক ব্যতীত।

‘ইঞ্চি ইঞ্চি প্রেম’ পরিচালনা করেছেন রাজু চৌধুরী। প্রযোজনা করেছে তিতাস কথাচিত্র, প্রযোজক আবুল কালাম। কাহিনি ও চিত্রনাট্য লিখেছেন রাজু চৌধুরী ও আব্দুল্লাহ জহীর বাবু। চিত্রগ্রাহক ছিলেন এম এ কাইয়ুম, সম্পাদক তৌহিদ হোসেন চৌধুরী, আবহ সংগীত পরিচালক আহমেদ হুমায়ুন এবং অ্যাকশন পরিচালক ডি এইচ চুন্নু।