আচার্য্য বাড়ির ছোট মেয়েটি ভীষণ গানপাগল। সারাবেলা গান নিয়ে মেতে থাকে সে। প্রতি সন্ধ্যায় ঘরোয়া আসরে গান গেয়ে মুগ্ধ করে শ্রোতাদের। প্রাতিষ্ঠানিক তালিম ছাড়াই এত ভালো গান করে! শ্রোতাদের ভূয়সী প্রশংসায় সে ঋদ্ধ হয়। মা -ঠাকুরমার উৎসাহে একদিন গান শিখতে শুরু করে সে। মজার ব্যাপার হল, মিষ্টি মেয়েটির তখনও অক্ষরজ্ঞান হয়নি।
আচার্যবাড়ির সেই ছোট্ট মেয়েটি এখন প্রতিষ্ঠিত সোমলতা আচার্য চৌধুরী।
পৈতৃক সূত্রে সোমলতা বাংলাদেশের মেয়ে। আলাপচারিতার শুরুতেই তিনি বলেন, “এ দেশটা আমার। আমি মনে প্রাণে একজন বাঙালি। আমার কাছে এপার বাংলা, ওপার বাংলার কোনো তফাৎ নেই।”
সোমলতা মেলে বসেন তার স্মৃতির ডালি। তিনি বলেন,“আমাদের আদি বাড়ি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায়। আমার দাদু নবাব আচার্য চৌধুরী। তার বিশাল বাড়ি নিয়ে ঠাকুরমা অনেক গল্প করতেন। ছোটবেলায় শোনা সেই গল্প শুনে ভাবতাম, কবে আসব বাংলাদেশে। ২০১১ সালে একটি টিভি চ্যানেল আমন্ত্রণ জানাল আমায়। প্রথমবারের সে সফর ঘিরে কী যে উত্তেজনা আর প্রস্তুতি ! এবার দেশ টিভি যখন আমন্ত্রণ জানাল, সেই একই উত্তেজনা অনুভব করেছি। প্রস্তুতি নিয়ে ফের রাত ভোর করা। সবাই মিলে পরিকল্পনা করেছি, এ দেশে এসে মুখরোচক কোন কোন আইটেমগুলো চেখে দেখব।”
ফিরে আসি গানের প্রসঙ্গে। নয় বছর বয়সে সোমলতার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শুরু। দীর্ঘদিন তালিম নিয়েছেন প-িত বীরেশ রায়ের কাছে।
সোমলতা তার ক্যারিয়ার শুরু করেন ২০০৬ সালে। সুনামি তহবিলের জন্য ‘সুনামি রিলিফ ফান্ড ’ শিরোনামের একটি অ্যালবামে নচিকেতার সংগীতায়োজনের তিনি গাইলেন ‘দিল দরিয়ায় আইল তুফান’।
তারপর ২০০৭ সালে যুক্তরাজ্যের ‘ দ্য পারফেক্ট ওমেন’ সিনেমায় গান করেন।
২০০৯ সালে সোমলতা নিয়ে আসেন তার একক অ্যালবাম ‘চুপকথা’।
অ্যালবাম প্রকাশের পর টালিউডে নিয়মিত হয়ে ওঠেন সোমলতা। সে বছর ‘ ক্রস কানেকশন’ ও ‘বক্স নাম্বার ১৩১৩’ সিনেমায় প্লেব্যাক করেন তিনি। ক্রস কানেকশান সিনেমায় তার ‘ইচ্ছেগুলো’ শিরোনামের গানটির সংগীতায়োজন করেন নীল দত্ত। এই সিনেমায় সোমলতার কণ্ঠের জাদুতে মুগ্ধ হলেন নীল। ঠিক করলেন পরবর্তী সিনেমা ‘রঞ্জনা আমি আর আসব না’ সিনেমাতেও গাইবেন সোমলতা। তখন কে জানত, এই সিনেমাটি বদলে দেবে সোমলতার গল্প! সোমলতার ভাষ্যে, “এই সিনেমার প্লেব্যাক আমার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট।”
‘রঞ্জনা আমি আর আসব না ’ সিনেমার পর আর ফিরে তাকাতে হয়নি সোমলতাকে। এরপর তিনি প্লেব্যাক করেছেন ‘সেভেন ডেজ’, ‘বেডরুম’, ‘এলার চার অধ্যায়’, ‘দত্ত ভার্সেস দত্ত’, ‘মাস মিস্তি অ্যান্ড মোর’, ‘বোঝে না সে বোঝে না’ সিনেমায়। এ বছর তিনি গেয়েছেন ‘বাংলা নাচে ভাংরা’ ও ‘হাফ সিরিয়াস’ সিনেমায়।
‘বেডরুম’ সিনেমায় সোমলতার কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত ‘মায়াবন বিহারিণী’ নিয়ে প্রশংসার পাশাপাশি সমালোচনাও শুনেছেন তিনি। রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে এমন কাটাছেঁড়ায় ক্ষেপে উঠেছিলেন নিন্দুকরা। এ প্রসঙ্গে সোমলতার সাফ জবাব-- “গানটি আসলে একটি সিনেমার জন্য গাওয়া। সে ক্ষেত্রে আমার চেয়ে সিনেমার পরিচালকের উপরই দায় বেশি বর্তায়। এ সিনেমায় গানের প্রেক্ষাপট খেয়াল করলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। একটি পার্টিতে আমন্ত্রিত লোকজন যে যার মতো করে সময়কে উপভোগ করছে। ওদিকে মেয়েটি তার মতো করে গান গাইছে। সে কী গাইছে, কেমন গাইছে ওসব নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। মেয়েটি তার মতো করেই রবীন্দ্রসংগীত গায়। তাই এখানে মেয়েটি একজন দক্ষ শিল্পীর মতো রবীন্দ্রসংগীত গাইবে-- এটা চিত্রনাট্য ‘ডিমান্ড’ করে না। বরং পার্টিতে একজন পার্টি সিঙ্গার পার্টির আমেজে গানটি গাইছে, এটাই ডিমান্ড করে। গানটি আসলে চলচ্চিত্রের জন্য গাওয়া।”
পশ্চিমবঙ্গে বাংলা গানের বর্তমান অবস্থা নিয়ে কথা হয় সোমলতার সঙ্গে। তিনি জানান, বাংলা গানের অবস্থা এখন ভীষণ ভালো। তরুণ শ্রোতারা এখন বাংলা গান শুনছেন।
সোমলতার মতে, বাংলা গানের এই উত্থানের পেছনে সেখানকার চলচ্চিত্রের ভূমিকাই মুখ্য। সোমলতা বলেন, “চলচ্চিত্রের গানগুলোই বেশি জনপ্রিয় হচ্ছে। এমনকি অনেক শিল্পী চলচ্চিত্রের মাধ্যমেই লাইমলাইটে আসছেন।”
গানের রয়্যালিটি ও শিল্পী সম্মানীর ব্যাপারে সোমলতা জানান, পশ্চিমবঙ্গের শিল্পীরা ঠিকভাবে শিল্পী সম্মানী পাচ্ছেন না। এ নিয়ে অনেক প্রতিবাদের পরও লাভ হচ্ছে না। রয়্যালিটি কিংবা কপিরাইটের কোনো ধার ধারছেন না কেউই, বরং এককালীন পেমেন্টের বিনিময়ে গান বিক্রি হচ্ছে। এখন নতুন যারা আছেন, তাঁরা বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবছেন। নিশ্চয়ই অবস্থার পরিবর্তন আসবে।
সোমলতার ব্যান্ডের নাম ‘সোমলতা অ্যান্ড দ্য এসেস’। এ ব্যান্ডের লাইন আপ- অর্ণব রায় (লিড গিটার), অভিষেক ভট্টাচার্য (বেজ গিটার), অর্ণব সেন (কি-বোর্ড), অভিষেক ব্যানার্জি (ড্রামস) ও কিঞ্জল ভট্টাচার্য (ম্যানেজার)।
রুনা লায়লা ও সাবিনা ইয়াসমীনের দারুণ ভক্ত সোমলতা। অর্ণব ও জেমসের গানও শোনেন তিনি। তার মতে, কলকাতা থেকে বাংলাদেশের মিউজিক স্টাইল বেশি পরিপক্ব। এখানকার মিউজিশিয়ানরা অনেক যতœ নিয়ে কাজ করেন। বিশেষ করে বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীত খুবই উচ্চমানের।
সোমলতার কৃতিত্বের ভাগীদার তার পরিবার। তার কণ্ঠে পরিবারের ভূয়সী প্রশংসা “চমৎকার একটা ফ্যামিলি তাদের! আমি থাকি কলকাতায়, পেশাগত কারণে ওখানেই থাকতে হয় আমাকে। আর আমার শ্বশুরবাড়ি আসানসোল, অনেক দূরে। দেখা গেছে, আমি দু-তিন মাসে একবার শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি, তবু তারা আমাকে যেভাবে ভালোবেসে, আদর-স্নেহ দিয়ে আপন করে রাখে, তাতে আমি মুগ্ধ।”
আলাপচারিতা শেষে সোমলতার কণ্ঠে ভেসে ওঠে বাংলাদেশ বন্দনা। তিনি বলেন, “এ দেশের মানুষ সত্যিই অসাধারণ। এখানকার মানুষ অনেক অতিথিপরায়ণ এবং ভীষণ সংগীতানুরাগী। আমি মনে করি, কলকাতা থেকে বাংলাদেশেই বাংলা গানের কদর বেশি। নাড়ির টানে, গানের টানে বারবার আসতে চাই বাংলাদেশে।”
সোমলতার ছবি তুলেছেন নয়ন কুমার।