মহাগায়কের মহাপ্রয়াণ

তাকে কিংবদন্তি বললেও বোধহয় কম বলা হবে। আধুনিক সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশের হাতে গোনা কয়েকজন সংগীতশিল্পী, যারা নিজের প্রতিভা দিয়ে জয় করেছিলেন বিশ্বকে, তাদের অন্যতম মান্না দে। তার গানের বুলিতে ছিল সারল্য, সুরে ছিল স্নিগ্ধতা।

জেনিফার ডি প্যারিসবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Oct 2013, 11:34 AM
Updated : 25 Oct 2013, 11:36 AM

উপমহাদেশের সংগীতের ইতিহাসে ঐতিহ্য এবং আধুনিকতার এক অদ্ভুত মিশেল তৈরি করেছেন যিনি, সেই মান্না দে পাড়ি দিয়েছেন অজানা দেশের পথে। পেছনে ফেলে গেছেন অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা। 

মান্না দের পোশাকী নাম প্রবোধচন্দ্র দে। কলকাতার ছেলে প্রবোধের জন্ম ১৯১৯ সালে। সংগীতের প্রতি ভালোবাসা অনেকটা জন্মসূত্রে পাওয়া। ছোটবেলা থেকে সংগীতাচার্য কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দের সঙ্গে গাইতে গাইতে বেড়ে উঠেছেন।

ব্রিটিশ ভারতের সেই দিনগুলোতে কলেজে পড়ার সময় বন্ধুদের সবসময় গানে গানে মাতিয়ে রাখাই ছিল তার স্বভাব। এরই মধ্যে কাকা এবং ওস্তাদ দবির খানের কাছ থেকে সংগীতের তালিম নিলেন। আন্তঃকলেজ প্রতিযোগিতায় তিনবার তিনটি আলাদা বিভাগে সংগীতে প্রথম হলেন হন তিনি। প্রবোধচন্দ্র দে থেকে মান্না দে হয়ে ওঠার শুরুটা হল এভাবেই।

২৩ বছর বয়সে কাকার হাত ধরে মুম্বাই দেখতে আসেন মান্না দে। ওখানে প্রথমে কাকার অধীনে সহকারী হিসেবে, পরবর্তীতে শচীনদেব বর্মণের সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। ওখান থেকেই শুরু হয় তার খ্যাতির পথে চলা। ১৯৪৩ সালে ‘তামান্না’ সিনেমায় প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসেবে অভিষেক ঘটে মান্না দের, এরপর ধীরে ধীরে শুরু হয় বিভিন্ন হিন্দি সিনেমার তার সংগীত পরিচালনা। কিন্তু ক্যারিয়ার গড়ার পরেও থেমে থাকেনি নতুন কিছু শেখার নেশা। আর তাই ওস্তাদ আমান আলী খান এবং ওস্তাদ আবদুর রহমান খানের কাছ থেকে ভারতের শাস্ত্রীয়সংগীতের উপর শিক্ষা নিতে থাকেন নিয়মিতভাবে।

মান্না দের ক্যারিয়ারে প্রায় সব গানই হয়েছে বিখ্যাত। ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’, ‘যদি হিমালয়’, ‘শাওনও রাতে’, ‘সবাই তো সুখী হতে চায়’, ‘সে আমার ছোট বোন’, ‘মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে যায়’। মান্না দের অসাধারণ গানগুলোর তালিকার কোনো শেষ নেই।

ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই তিনি হয়েছিলেন সফল। ‘তামান্না’ সিনেমায় সে সময়ের গায়িকা সুরাইয়ার সঙ্গে দ্বৈত গান ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৫০ সালে শচীনদেব বর্মণের লেখায় ‘ওপার গগন বিশাল’ গানটি গান। ১৯৫২ সালে গাওয়া তার গান ‘আমার ভূপালি’ তাকে পরিচিত করে তোলে উপমহাদেশে। গানটি মারাঠি এবং বাংলা দুই সিনেমাতেই গেয়েছিলেন মান্না দে।

হিন্দি সিনেমার অনেক ক্ল্যাসিক গানে কণ্ঠ দিয়েছেন মান্না দে। কিশোর কুমারের সঙ্গে ‘শোলে’ সিনেমার গান ‘ইয়ে দোস্তি হাম নেহি তোরেঙ্গে’ আজও মানুষের মুখে শোনা যায়। ‘পড়োসান’ সিনেমায় গাওয়া তার গান ‘এক চতুরানার বড়ি হোশিয়ার’, হিন্দি সিনেমা যারা দেখেন তাদের কাছে গানটির পরিচিতি নতুন করে দেওয়া বাহুল্য।

ভিন্নধর্মী কণ্ঠের জন্য বরাবরই সমাদৃত মান্না দে আরও গেয়েছেন ‘অ্যায় মেরি জোহরাজাবিন’, ‘লাগা চুনরি মে দাগ’-এর মতো গান। মোহাম্মদ রফি, মুকেশ এবং কিশোর কুমারের পাশাপাশি মান্না দেকে ধরা হয় পঞ্চাশ থেকে সত্তরের দশকে উপমহাদেশে রাজত্ব করে বেড়ানো হাতেগোনা কয়েকজন শিল্পী হিসেবে।  

প্রায় পাঁচ দশকের ক্যারিয়ারে এই গুণী শিল্পী গান গেয়েছেন সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি। নব্বইয়ের দশকে সিনেমায় গান গাওয়া ছেড়ে দেওয়ার আগ পর্যন্ত মান্না দে কণ্ঠ দিয়েছেন বাংলা, হিন্দি, গুজরাটি, মারাঠি, মালায়াম, কানাড়া এবং অহমিয়া ভাষার সিনেমায়। ১৯৯১ সালের সিনেমা ‘প্রহার’-এ শেষবারের মতো প্লেব্যাক করেন মান্না দে, সেই গানটি ছিল ‘হামারি হি মুঠি মে’।

আর যদি বলতে হয় রবীন্দ্রসংগীতের কথা, বহু গুণে গুণবান এই গায়ক সংগীতের এই বিশেষ ক্ষেত্রেও ছিলেন দারুণ জনপ্রিয়। মান্না দের গাওয়া রবীন্দ্রসংগীত আজও শ্রোতাদের মধ্যে বিশেষভাবে জনপ্রিয়।

৯৪ বছরের জীবনে তিনি যেমন পেয়েছেন মানুষের ভালোবাসা, তেমনই পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার এবং সম্মাননা। ভারত সরকারের সর্বোচ্চ দুই পদক, পদ্মশ্রী এবং পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত হয়েছেন মান্না দে। সেরা প্লেব্যাক গায়ক হিসেবে দুবার জিতেছেন ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড এবং দাদাসাহেব ফালকে অ্যাওয়ার্ডসহ ঝুলিতে জমেছে আরও অনেক পুরস্কার।

ব্যক্তিগত জীবনে মান্না দে বিয়ে করেন কেরালার মেয়ে সুলোচনা কুমারানকে, ১৯৫৩ সালে। পরিবারে রয়েছে দুই মেয়ে সুরমা এবং সুমিতা। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০১২ সালে মারা যান মান্না দের স্ত্রী, এরপর একাকী বোধ করতেন তিনি।

২০১৩ সালের ৮ জুন ফুসফুসে জটিলতা দেখা দেওয়ায় তাকে ব্যাঙ্গালুরুর এক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর কিছুটা সুস্থ হলে বাড়ি ফিরে যান তিনি। ২৪ অক্টোবর মৃত্যু ঘটে এই প্রতিভাবান গায়কের।

ক্যারিয়ার এবং ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ২০০৫ সালে একটি আত্মজীবনী প্রকাশ করেছিলেন মান্না দে। কলকাতার আনন্দ প্রকাশনীর সেই বইটির নাম ছিল ‘জীবনের জলসাঘরে’। বইটি ইংরেজি, হিন্দি এবং মারাঠি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এই নামে ২০০৮ সালে প্রকাশিত হয়েছে একটি তথ্যচিত্র।

মান্না দের গানের শ্রোতাদের নির্দিষ্ট কোনো বয়স নেই। সব বয়সের মানুষ তার গান শুনে  মন ভালো করেছেন। তার মতো ভিন্নধর্মী কণ্ঠ এবং পশ্চিমা ধাঁচের সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী দেশীয় ভাবনার চমৎকার মিশ্রণ হয়তো আর কেউ করতে পারবেন না। আর তাই এই গুণী শিল্পীর সব গান সংরক্ষণের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়।  

মান্না দের ভক্তদের জন্য এবার থাকছে প্রিয় শিল্পীর ব্যাপারে অজানা কিছু তথ্য :

১. যুব বয়সে রেসলিং এবং বক্সিং খুবই পছন্দ করতেন মান্না দে। এই দুই খেলায় বিশেষ পারদর্শী ছিলেন তিনি।

২. স্কুল-কলেজে শুধু গানের জন্যই নয়, দুষ্টুমির জন্যও আলাদাভাবে বিখ্যাত ছিলেন মান্না দে।

৩. পড়াশোনার পাশাপাশি গানবাজনায় সাবলীল অংশগ্রহণের কারণে বন্ধুমহলে নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি।

বিখ্যাত শিল্পীরা তাদের কাজের মাধ্যমে বরাবরই আমাদের কিছু না কিছু শিখিয়ে যান। শুধুমাত্র নিজের প্রতিভার প্রতি ভালোবাসা এবং বিশ্বাস থাকলে একদিন সফল হওয়া সম্ভব,মান্না দে আমাদের তাই শিখিয়েছেন।