দিন দ্য ডে: বিশাল বাজেটের ‘ট্রলড’ সিনেমা?

‘খোঁজ দ্য সার্চ’ দিয়ে শুরু মি. অনন্ত জলিলের (এপ্রিল,২০১০)..‘দ্য’ আক্রান্ত সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমার  নাম ‘দিন দ্য ডে’, যা মুক্তি পেয়েছে ১০ জুলাই ২০২২ এ।

>> আহসান কবিরবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 July 2022, 06:01 AM
Updated : 19 July 2022, 07:17 AM

বিশাল বাজেটের সিনেমা দিন দ্য ডে হয়তো কারও কারও কাছে বিশাল প্রত্যাশারও। এই সিনেমার লোকেশান কিংবা মারপিট, আয়োজন কিংবা চিত্রগ্রহণ পুরোটাই ফিল্মি, হয়ত হলিউড বা বলিউড ধাঁচের! কিন্তু দিন দা ডে সিনেমাটা শেষমেষ কেমন? সিনেমা শেষ করার জন্য দর্শকদের ধৈর্য ধরে রাখা কি সম্ভব ছিল? নাকি তারা হাসি, কান্না কিংবা গান দেখে আসলে ‘ট্রল’ করতে গিয়েছিলেন ছবিঘরে?

১৯৮৯-৯০ তে দল বেঁধে মানুষ ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ দেখতে গিয়েছিল। তখন জনপ্রিয় এক সাপ্তাহিক পত্রিকা (সরকারি মালিকানাধীন) শিরোনাম করেছিল-‘রুচির দুর্ভিক্ষ-বেদের মেয়ে জোসনা’! তাহলে দিন দ্য ডে’র জন্য কোন শিরোনাম ব্যবহৃত হবে?

এই সিনেমাতে অনন্ত জলিল নিজ নামে অভিনয় করেছেন। তিনি এবং তার স্ত্রী বর্ষা বাংলাদেশ পুলিশ এর বিশেষ শাখা সোয়াট (স্পেশাল উইপনস অ্যান্ড ট্যাকটিকস) এ কর্মরত। বাংলাদেশ থেকে যারা মানুষের পেটে নেশাকারক দ্রব্যাদি বহন করে নিয়ে যায়, অনন্ত সাহেবের ‘বিশাল যুদ্ধ’ তাদের বিরুদ্ধে! তাও এটা জানা যায় ডায়ালগে, পর্দায় খুব কমই আছে এমন যন্ত্রণা! তবে ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধেও তিনি দারুণ সরব। তিনি উড়ে এসে না হাজির হলে ছিনতাইকারীদের ধরা সম্ভব হয় না বা পুলিশ পারে না। এমনকি কেউ টাকা নিয়ে পালাতে চাইলে অনন্ত জলিলের উপস্থিতি ছাড়া সেই টাকা উদ্ধার করাও সম্ভব হয় না!

যাই হোক, যারা আদম পাচার করে, যারা মানুষের শরীরে নেশাকারক দ্রব্য ভরে বিদেশে পাচার করার চেষ্টা করে, তাদের ধরতে অনন্ত উড়াল দেন তুরস্কে। বিমানবন্দরে নেমেই (ছিনতাইকারীদের ধরা কিংবা টাকা উদ্ধারের মতো) জড়িয়ে পড়েন সংঘর্ষে। উদ্ধার করেন সেই বিদেশিনীকে যিনি কিনা সাংবাদিক, যার ক্যামেরায় আছে ‘ভিলেন’ অর্থাৎ মানব ও মাদক পাচারকারীদের ছবি, যাদের বিরুদ্ধে লড়াই এ নেমেছেন অনন্ত জলিলও।

এরপর পুলিশ এলে অনন্ত জানান, তিনি বাংলাদেশ পুলিশের লোক। কিন্ত তার মাথার চুল অনেক বড় বা লম্বা। মুহূর্তেই তাকে ছেড়ে দেওয়া হয় আর নিয়ে যাওয়া হয় সেই বিদেশি সাংবাদিককে। পরের দৃশ্যে আবার সেই অনন্তকে দেখা যায় ছোট চুলে! বড় বা ছোট চুল যখন যা ছিল তখন সেই চুল নিয়ে পর্দায় হাজির হয়েছেন তিনি!

সারা সিনেমা জুড়ে ফ্ল্যাশব্যাকের পর ফ্ল্যাশব্যাক! কোনটা রিয়েল আর কোনটা ফ্ল্যাশব্যাক, সেটা বুঝতে পারাও বিশাল ধৈর্যের ব্যাপার। এক ভদ্র মহিলা বাচ্চাকে স্কুলে দিয়ে অন্য এক লোকের সঙ্গে কথা বলে, গল্প করে, বাচ্চা কিডন্যাপ হয়। বর্ষা এসে তাদের সেভ করেন, বাচ্চা উদ্ধার করে পরকীয়া খারাপ, এটা ছেলের সামনে ছেলের মাকে বোঝান!

সিনেমাজুড়ে বর্ষা অনন্তর খোঁজ নেওয়া ছাড়া সোয়াটের হয়ে আর কী কী কাজ করেন, তা বোঝা সম্ভব হয় না! অনন্ত তুরস্ক থেকে ইরান হয়ে আফগানিস্তানে যান। তার উদ্দেশ্য ভিলেন আবু খালিদকে ধরা।

অন্যদিকে বাংলাদেশের পুলিশের কর্তাব্যক্তিরাও অনন্তর খোঁজ দিতে পারেন না। বর্ষা সোয়াটে পুলিশের হয়ে কী কাজ করেন, সেটা জানা না গেলেও অনন্তর জন্য তার হাহাকারটা জানা যায়। তবুও গল্প এমন যে- বর্ষা ট্রেস করতে পারেন না অনন্তকে। অনন্তর জন্য তার কান্না পায়। কিন্তু আফগানিস্তানের যে আখড়ায় আবু খালেদের সন্ধানে যান অনন্ত, সেখানে আচমকা হাজির হয়ে যান বর্ষা! শেষমেষ সিনেমার গৎ অনুসারে বর্ষাকে আটকে রাখে ভিলেন, দেশে অনন্ত ও বর্ষার ছেলেকে কিডন্যাপ করা হয়। কারা কিডন্যাপ করেছে, কেন করেছে, সেটা জানা যায় না। এরপর বিমান, হেলিকপ্টার, লরি, কার, মোটর সাইকেল এর সমাহারে যে মারামারি সেখানে জিতে যান অনন্ত আর দেশে অনন্তর ছেলেকে উদ্ধার করে পুলিশ।

দিন দ্য ডে সিনেমার শুটিং হয়েছে মূলত দেশের বাইরে। ইরান, আফগানিস্তান বা তুরস্কের দৃষ্টিনন্দন জায়গা দেখা যাবে পাখির চোখে। পরিচালক মোর্তজা আতশ জমজম। চিত্রনাট্য লিখেছেন ছটকু আহমেদ এবং সংলাপ লিখেছেন অনন্ত জলিল নিজেই। প্রধান প্রযোজকও তিনি। সিনেমার গানগুলোর চিত্রায়ন দৃষ্টি নন্দন। ‘ভেজা চোখে’ গানটি লিখেছেন তারেক আনন্দ এবং গানটির সুরকার ও শিল্পী ইমরান মাহমুদুল। আর শুভাশিষ ঘোষের লেখা ‘তোকে রাখবো খুব আদরে’ গানটির সুর ও সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন ইমরান মাহমুদুল এবং গানটি গেয়েছেন ইমরান ও আতিয়া আনিসা।

কান সৈকতে অনন্ত জলিল ও বর্ষা।

অনন্ত ও বর্ষার ‘বিশ্ব’ মানের অভিনয়ের কথা বাদ দিয়েও বলা যায়, সিনেমার কাহিনীতে বিন্দুমাত্র নতুনত্ব বা দেখবার উত্তেজনা নেই। ইংরেজি বাংলা বা অন্য কোন ভাষার সংলাপ শুনে বিশেষ করে ভুল ইংরেজি উচ্চারণ শুনে দর্শক হাত তালি দিয়ে হেসেছে। ‘আমি তোমার বাবাকে হত্যা করিনি’ এটার ইংরেজি অনন্ত বলেছেন-‘আই অ্যাম নট কিল ইউর ফাদার’! আবু খালেদকে ধরার জন্য মাজদিকে নিয়ে অনন্ত যখন হেলিকপ্টার থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েন, সেটা শিশুতোষ বা কার্টুনাইজড মনে হয়েছে। এছাড়া ভিলেন আবু খালেদ এর কাছ থেকে যখন জানা যায় মাজদিকে মেরে ফেলা হয়েছে, মাজদির মৃত্যু দেখানো হয় তারপরে!

যারা সালমান খানের ‘এক থা টাইগার’ এবং ঋত্বিক রোশানের ‘ব্যাং ব্যাং’ দেখেছেন, তারা এই দুই সিনেমার কিছু কিছু দৃশ্য বা ডায়ালগের অনুকরণ খুঁজে পেতে পারেন ‘দিন দ্য ডে’তে!

সিনেমার শুরুতে ঘটা করে দুজনের নাম দেখানো হয়েছে নায়ক-নায়িকা হিসেবে। এরা দুজন অনন্ত ও বর্ষা। সিনেমাটির নব্বইভাগ অভিনেতা-অভিনেত্রী বিদেশি, বাংলাদেশি অভিনেতা বলতে তিন-চার দৃশ্যে দেখা গেছে মিশা সওদাগরকে। ভারতের সঙ্গে যৌথ প্রযোজনার সিনেমা নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক হয় এদেশে। তাহলে ইরানের সঙ্গে যৌথ প্রযোজনার সিনেমা নিয়েও কি আলোচনা হওয়া উচিৎ?

অনন্ত সাহেবের ইমেজ পজেটিভ বা নেগেটিভ সেই বিচারে না গিয়েও বলা যায়, এই সিনেমার চকচকে দিক হচ্ছে পুলিশকে ‘পজিটিভ’ভাবে উপস্থাপন! অনন্ত সাহেব কয়েকবার বলেছেন-‘আমি এজে। বাংলাদেশ পুলিশ, সোয়াট ডিপার্টমেন্ট’! আর একবারে অভিনব দিক হচ্ছে ভিলেন ও তার আখড়ার সন্ধান পাওয়া। আফগানিস্তানে শুধু মৌলবাদের অনুসারী কিংবা তালেবানই থাকে না, মানব পাচারকারী ও ড্রাগডিলাররাও থাকেন, যারা বাংলার মানুষের বা পুলিশেরও শত্রু। তবু আফগান ক্রিকেটারদের জন্য শুভ কামনা।

জয় হোক বাংলা সিনেমার। ব্যবসা সফল তালিকায় উঠুক ‘দিন দ্য ডে’র নাম!