দেশে জনপ্রিয় হচ্ছে ওটিটি, কেন?

নিজের সময় অনুযায়ী ছবি দেখছি, যখন মন চাইছে তখন দেখছি, অন্য কারও ঠিক করে দেওয়া সময়ের জন্য বসে থাকতে হচ্ছে না- এমন স্বাধীনতার কথাই বলছিলেন একজন দর্শক।

সাজিদুল হক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 May 2022, 03:27 AM
Updated : 4 May 2022, 03:27 AM

বাঁধাধরা সময়ের হাত থেকে মুক্তি দেওয়া ওভার দ্য টপ (ওটিটি) প্ল্যাটফর্মের এই সুবিধার কথা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সোজা সাপ্টাই জানিয়েছেন মোক্তাদির কাদির ইসলাম।      

মহামারীর দাপটে ঘরবন্দি জীবনে ফেইসবুকে একটি বিজ্ঞাপন দেখে নেটফ্লিক্স এবং অ্যামাজন প্রাইম মুভির গ্রাহক হয়েছিলেন ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করা মোক্তাদির।

ঘরে বসে কাজের ফাঁকে তখন ওটিটিই হয়ে ওঠে তার কাছে বিনোদনের প্রধান মাধ্যম। নিজের ক্রেডিট কার্ড না থাকলেও অন্যের মাধ্যমে সাবস্ক্রিপশন ভাগ করে মাসে নির্দিষ্ট অংকের টাকা দিয়ে গ্রাহক হন তিনি।

মোক্তাদির বলেন, “ক্রেডিট কার্ড না থাকায় ওটিটি প্ল্যাটফর্ম সাবস্ক্রিপশন করতে পারতাম না। ফেইসবুকে একটি গ্রুপে দেখি একটি স্ক্রিন পাওয়া যাচ্ছে ২৫০ টাকায়। তখনই নিয়ে ফেললাম। এখনও চলছে।”

মহামারীর সময়ে অনেকেই নিজের অ্যাকাউটন্ট অন্যের সঙ্গে টাকার বিনিময়ে ভাগ করেন। এটাকে কেন্দ্র করে একটা ব্যবসাও গড়ে উঠেছে।

লকডাউনে মানুষের ঘরবন্দি থাকার সময় বিশ্বব্যাপী ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোর গ্রাহক বেড়েছে। তেমনি বেড়েছে এর কন্টেন্ট। নিত্য নতুন কন্টেনের কারণে গ্রাহক দিন দিন বাড়ছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

মার্কিন নিউজ কন্টেন্ট পাবলিশার কোম্পানি বিজনেসওয়্যারের হিসাবে, ২০১৯ সালে ওটিটি বাজারের মূল্য ছিল ৮ হাজার ৫১৬ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২৫ সালের মধ্যে তা ১৯ হাজার ৪০০ কোটি ছাড়িয়ে যেতে পারে।

ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্ট প্রতিষ্ঠান ‘পাই স্ট্র্যাটেজি’ এর হিসাবে ২০১৯ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশে নেটফ্লিক্সের গ্রাহক ছিল দুই লাখ।

বর্তমানে এর সংখ্যা কত সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ঢাকার বাসিন্দা আরিফুল ইসলাম জানালেন, দিন দিন গ্রাহক বাড়ছে।

নিজের একটি ফেইসবুক গ্রুপে নেটফ্লিক্সসহ অন্যান্য বিদেশি ওটিটিতে সাবস্ক্রিপশন বিক্রি করেন আরিফুল। তার মত অনেকেই নেটফ্লিক্সের একটি চার স্ক্রিনের আইডি চারজনের মধ্যে ভাগাভাগি করে দেন।

জনপ্রতি ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায় সেগুলো একটি ডিভাইসে দেখা যায়। আরিফের প্রতি মাসে শুধু নেটফ্লিক্সের এমন গ্রাহক আছেন তিনশর মত। অনেকে এক বা দুই মাসের জন্য গ্রাহক হন।

অনেকেই আছেন অ্যামাজন প্রাইম, ডিজনি, হটস্টারসহ বিভিন্ন বিদেশি ওটিটির অ্যাকাউন্ট ভাগাভাগি করেন।

বাংলাদেশে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মের গ্রাহক বাড়তে থাকায় নতুন দেশি প্ল্যাটফর্ম যেমন চালু হয়েছে, তেমনি বিদেশি অনেক প্রতিষ্ঠানই বাংলাদেশে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ করছে।

সেই সাথে তৈরি হচ্ছে বাংলা কন্টেন্ট। যা একই সঙ্গে বিশ্ববাজারের পণ্য হিসেবে ছড়িয়ে পড়ছে।

ওটিটি কী?

ওভার-দ্য-টপ (ওটিটি) হল ইন্টারনেটের মাধ্যমে দর্শকদের সরাসরি সেবা দেওয়ার একটি মিডিয়া। ক্যাবল সম্প্রচার এবং স্যাটেলাইট টেলিভিশন প্ল্যাটফর্মগুলোকে পাশ কাটিয়ে যা পরিবেশক হিসেবে কাজ করে।

অর্থাৎ টেলিভিশন বা সিনেমা হলের মত মাধ্যমগুলোকে পাশ কাটিয়ে ওটিটি দর্শকের কাছে সরাসরি সেবা নিয়ে যায়। এজন্য একটি প্ল্যাটফর্মের গ্রাহক হতে হয়। যেখানে বিজ্ঞাপন ছাড়াই পছন্দের কন্টেন্ট দেখা যায়।

বাংলাদেশে ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোর বিস্তারের কারণে এখানে বিনিয়োগ যেমন হচ্ছে, তেমনি উঠে আসছে নতুন নতুন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান, পরিচালক, অভিনয় শিল্পী।

‘তকদির’, ‘কন্ট্রাক্ট’, ‘মানি হানি’, ‘মহানগর’, ‘ইতি, তোমারই ঢাকা’, ‘ঊণলৌকিক’, ‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলমেন’ এর মতো আরও কিছু ওয়েব সিরিজ পেয়েছে দর্শক।

বাংলাভাষী ভারতীয় বিনোদন মাধ্যম ‘হইচই’ চালু হয় ২০১৭ সালে। কলকাতা ভিত্তিক এই ভিডিও স্ট্রিমিং সাইটটি বাংলাদেশে কাজ শুরু করে ২০১৯ সাল থেকে।

বিনোদন বাণিজ্য বিষয়ক মার্কিন প্রতিষ্ঠান ভ্যারাইটি জানিয়েছে, ‘হইচই’ আশা করছে বাংলাদেশে তাদের প্রবৃদ্ধি প্রতি বছর ৭৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। তাদের মোট আয়ের ৩০ শতাংশই আসে ভারতের বাইরে থেকে।

‘হইচই’ বাংলাদেশের কান্ট্রি হেড সাকিব আর খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “২০১৯ সালে বাংলাদেশে হইচই কাজ শুরু করার পর থেকে এখন পর্যন্ত গ্রোথ বাড়ছে।

“আমরা এই সময়ে সব মিলিয়ে ১২-১৩টা কন্টেন্ট তৈরি করেছি। তার মানে মানুষ দেখছে।” 

কেন আগ্রহ বাড়ছে?

নতুন এই মাধ্যমের প্রতি মানুষের আগ্রহ কেন বাড়ছে তা জানতে কথা হয় এই খাতে জড়িত পরিচালক, প্রযোজক ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে। তারা বলছেন, নতুন এই মাধ্যমে অনেকটাই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন নির্মাতা। নতুন বিনিয়োগ আসায় আর্থিক সংস্থান নিয়েও কলাকুশলীদের চিন্তা কম।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম ও টেলিভিশন বিভাগের শিক্ষক আবু শাহেদ ইমন মনে করছেন, নতুন মাধ্যম এবং কাজের স্বাধীনতার কারণে নির্মাতারা তাদের গল্প স্বাধীনভাবে বলতে পারছেন।

তিনি বলেন, “এই মাধ্যমটা বাংলাদেশে নতুন। আর এর কন্টেন্ট শুধু দেশেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। বিশ্ববাজারে ছড়িয়ে পড়ছে। নতুন শিল্পীরা কাজের সুযোগ পাচ্ছেন।

“আর ওটিটির হিরো হচ্ছে গল্প। তাই যে ভালোভাবে গল্পটা তুলে ধরতে পারছেন তার কাজ দর্শক নিচ্ছেন।”

নির্মাতারা আগের চেয়ে আর্থিক নিশ্চয়তা পাওয়ায় ভালো কাজ হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে ইমন বলেন, “নতুন জায়গায় সবসময় বিনিয়োগ হয়। টেলিভিশনেও হয়েছিল।

“এই জায়গাটার কথা ভবিষ্যৎ বলবে। এখন আমরা ওটিটির ফার্স্ট ফেইজে আছি। সময় গেলে এ বিষয়ে বলা যাবে। তবে দর্শক চাহিদার কথাটা মাথায় রাখতে হবে।”

ওটিটি সেবা প্রদান ও পরিচালনার বিষয়ে একটি নীতিমালা তৈরির জন্য সম্প্রতি নেওয়া উদ্যোগের বিষয়ে তিনি বলেন, “একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, সেন্সরশিপটা যাতে আধুনিক হয়।”

দেশীয় ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ‘বঙ্গবিডি’র হেড অব কন্টেন্ট মাসুদ জামান মনে করছেন এই মাধ্যমের কন্টেন্টগুলো বিশ্বের সামনে উন্মুক্ত হওয়ায় নির্মাতার ওটিটিতে আগ্রহী হচ্ছেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এখন তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে ভিডিও প্ল্যাটফর্মগুলোর কন্টেন্ট বিশ্ববাজারে চলে যাচ্ছে। নির্মাতা এজন্য এক ধরনের উৎসাহ পান।

“আরেকটা বিষয়, এক সময়ে টেলিভিশনে যে ধারা ছিল, সেখানে বাজেটের কিছু সমস্যা ছিল। এখানে সেটা অনেকটাই নেই। নির্মাতা নিজেদের মত করে কাজ করতে পারছেন। সে কারণে আমরা অনেক নতুন নতুন ভালো নির্মাতা এবং শিল্পী পাচ্ছি।”

এছাড়া ওটিটির প্রযুক্তিগত অনেক কিছু বিদেশ থেকে করতে হয় উল্লেখ করে মাসুদ বলেন, “এক্ষেত্রে পেমেন্ট সিস্টেমটা আধুনিক করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে বিষয়গুলো সহজ করতে হবে।”

‘হইচই’ বাংলাদেশের কন্টেন্ট লিড সৌভিক দাসগুপ্ত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নতুন একটা ব্যবসায় বিনিয়োগ হয়। এখানে দর্শক বিনোদন পাচ্ছে। সেজন্য নতুন নতুন কন্টেন্ট তৈরি হচ্ছে।

“নতুন নির্মাতা, অভিনেতা যেমন তৈরি হচ্ছে তেমনি পুরনো অনেকে নতুন করে শুরু করছে। এর একটা কারণ হচ্ছে, এই মাধ্যমের ভাষাটা নতুন। টেলিভিশন বা বড় পর্দার মত নয়। তাই প্রচুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে।”

বাংলাদেশে এই মাধ্যমের ভবিষ্যৎ খুব ভালো বলে মনে করছেন সৌভিক। নিজের অভিমত তুলে ধরে তিনি বলেন, “বাংলাদেশে প্রচুর গল্প আছে। সেই গল্প নিত্য-নতুনভাবে তুলে ধরার মত মেধাবী নির্মাতা আছে।”

পরিচালক কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায় মনে করছেন, গল্প বলার স্বাধীনতার কারণে নির্মাতারা এই মাধ্যমে কাজ করার ক্ষেত্রে আগ্রহ পাচ্ছেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “টেলিভিশন বা অন্য ট্র্যাডিশনাল মাধ্যমগুলো অনেকটাই পারিবারিক। ওটিটি সেখানে ব্যক্তিগত। সে কারণে এখানে গল্প বলার স্বাধীনতা পাওয়া যায়।

“আরেকটা বিষয় হচ্ছে, এখানে, আপনি সিরিজ এবং সিনেমা দুটোই বানাতে পারছেন। টেলিভিশন নাটকের সময়ের সীমার একটা বিষয় থাকে। এখানে সেই বাধ্যবাধকতা কম।

“আমাকে এক ঘণ্টার মধ্যেই সব দেখাতে হবে এমন নয়। আমি খণ্ড খণ্ড করে গল্পটা বলতে পারছি।” 

‘মানি হানি’ ওয়েব সিরিজের এই পরিচালক বলেন, “টেলিভিশন বা অন্য মাধ্যমগুলোর বাজেট নিয়ে সমস্যা ছিল। ওটিটি নতুন জায়গা। এখানে অনেকেই কাজ করছেন। বিনিয়োগ করছেন। সেটাও একটা কারণ।

“নতুন নতুন মেধা আমরা পাচ্ছি। এই প্ল্যাটফর্মটা শুধুমাত্র তারকা নির্ভর নয়। এখানে একটা চরিত্রকে মানুষ দেখছে। আর দর্শকের প্রতিক্রিয়াটা বোঝা যাচ্ছে।

“কে কতটুক দেখল, ফিরল না চলে গেল, এগুলো বোঝা যায়। জরিপটা অথেনটিক। আপনি বুঝতে পারছেন আপনার কাজ দর্শক কীভাবে নিল। সুতরাং পরের কাজের জন্য আপনি চ্যালেঞ্জটা বুঝে যাবেন।”   

প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ফিল্ম সিন্ডিকেটের প্রযোজক মীর মোকাররম হোসেন মনে করেন, দর্শকের স্বাধীনতার কারণে এই মাধ্যম জনপ্রিয় হচ্ছে। তবে এর বিকাশের জন্য আইনি কাঠামো সুষ্ঠু হওয়া উচিত বলে তার মত।

“ওটিটির নীতি নির্ধারক হচ্ছে দর্শক। দর্শক তার পছন্দমতো কন্টেন্ট এখানে দেখছে। টেলিভিশন বা সিনেমা হলে দর্শক তার সময়মত দেখতে পারে না। এখানে সে পারছে। ওটিটি জনপ্রিয় হওয়ার এটা অন্যতম কারণ।”

“বাংলাদেশে আমরা এখানে সূচনাপর্বে আছি। এক সময় টেলিভিশনে ৪০ মিনিটের একটা নাটক দুই-আড়াই লাখ টাকায় করা হত। অনেক টিভি ছিল। যে কারণে হয়ত বাজেটও কম ছিল।

“আর ছিল বিজ্ঞাপন। বলাই হত বিজ্ঞাপনের ফাঁকে নাটক দেখানো হয়। আর সিনেমা হলগুলোর অবস্থা আমরা সবাই জানি।”

ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ঘিরে সব পক্ষের অবস্থান তুলে ধরে তিনি বলেন, “এই নতুন মাধ্যম আসায় দর্শক, নির্মাতা, অভিনয় শিল্পী প্রত্যেকেই আগের চেয়ে নতুন উদ্যমে কাজ করছেন।

“নতুন গল্পকার আসছেন, পরিচালক আসছেন, অভিনয় শিল্পী আসছেন। পুরনো অনেক অভিনয় শিল্পী নতুনভাবে নিজেদের উপস্থাপন করছেন।”

প্রযোজক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কোনো চ্যালেঞ্চ মোকাবেলা করতে হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, “কপিরাইট আইন একটা সমস্যা। এখানে বিনিয়োগকারীকে প্রযোজক বলা হয়েছে।

কিন্তু প্রযোজনা একটি সৃজনশীল কাজ। বিনিয়োগকারী সবসময় প্রযোজক নন। এই জায়গাটা দেখতে হবে। সর্বোপরি নতুন এই মাধ্যমের বিকাশের জন্য উপযোগী আইন, বিধিমালা এসব করতে হবে।

“কারণ এখানে যারা কাজ করছেন, তারা যদি বিদেশি ওটিটিতে কাজ করেন তাহলে কিন্তু দেশে টাকা আসছে। সেটা বিবেচনা করতে হবে।”