বিভেদের চিত্র প্রকাশ্যে আনছে ‘দ্য কাশ্মির ফাইলস’

নব্বইয়ের দশকে হিন্দুদের গণহারে কাশ্মির ছাড়ার ঘটনা নিয়ে পর্দায় হাজির হয়েছে ‘দ্য কাশ্মির ফাইলস’; মুক্তির পর থেকেই সিনেপাড়া থেকে সোশাল মিডিয়ায় উত্তাপ ছড়াচ্ছে এ সিনেমা।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 March 2022, 02:46 PM
Updated : 18 March 2022, 02:46 PM

এমনকি ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপিও ওই সিনেমার প্লটকে পূর্ণ সমর্থন দেখাচ্ছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বিবিসি।

গত ১১ মার্চ ভারতের বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাওয়া ‘দ্য কাশ্মির ফাইলস’ ১৯৯০ সালের ওই সময়ের ঘটনাপ্রবাহকে একটি কাল্পনিক গল্পের মধ্যে দিয়ে তুলে ধরতে চেয়েছে।

কাহিনীর কেন্দ্রীয় চরিত্র এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী, যিনি হঠাৎ জানতে পারেন, তার বাবা-মায়ের দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার যে কথা তার দাদা বলে এসেছেন এতদিন, তা প্রকৃত সত্য নয়। বরং তার কাশ্মিরের বাসিন্দা হিন্দু বাবা-মাকে খুন করেছে মুসলমান জঙ্গিরা।            

বিবিসি লিখেছে, মূলধারার সমালোচকরা এ সিনেমা নিয়ে ’মাঝারি’ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন; একাধিক সমালোচকের কাছে এ সিনেমা ’পক্ষপাতদুষ্ট’ মনে হয়েছে। তবে সিনেমাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তীব্র বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

একপক্ষ বলছে, কাশ্মীরের যে রক্তাক্ত ইতিহাসকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে এতদিন, সেই ঘটনাবলীর ওপর আলো ফেলেছে এ সিনেমা। আর অন্যপক্ষ বলছে, এই সিনেমা বস্তুনিষ্ঠতার ধার ধারেনি, বরং ইসলামভীতি উস্কে দিচ্ছে।

এসব আলোচনা-সমালোচনা চলার মধ্যেই বিজেপি সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রশংসা কুড়িয়েছে ‘দ্য কাশ্মির ফাইলস’। বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলো ওই সিনেমার ওপর ধার্য করে ছাড় দিয়েছে। মধ্যপ্রদেশে পুলিশ সদস্যদের এক দিনের ছুটি দেওয়া হয়েছে সিনেমাটি দেখার জন্য।

নরেন্দ্র মোদী সব সমালোচনাকে উড়িয়ে দিয়েছেন। তার ভাষ্যে, ’উদ্দেশমূলক অপপ্রচার‘ চলছে এ সিনেমার বিরুদ্ধে।

বড় কোনো তারকা নেই, বাজেটও কম, এই সিনেমা নিয়ে তাহলে কেন এত শোরগোল?  

কাশ্মিরের ইতিহাস আর পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের অশান্ত সীমান্ত বরারবরই স্পর্শকাতর বিষয়।

মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ ওই উপত্যকা ১৯৮০ সালের শেষ ভাগে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সশস্ত্র আন্দোলন দেখেছে। ১৯৯০ সালে কাশ্মিরি হিন্দু, বিশেষ করে সংখ্যালঘিষ্ঠ উঁচু গোত্রের পণ্ডিতরা ছিলেন মুসলমান স্বাধীনতাকামীদের নিশানা। সে সময় অনেকেই খুন হয়েছেন; ধারণা করা হয়, হাজার হাজার হিন্দু সেসময় ভিটে ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন; যাদের বেশিরভাগেই আর ফিরে যাননি।

 

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এই অঞ্চলে সেনাবাহিনী নামায়। যে কাউকে বিনা পরোয়ানায় আটক ও জেরা করার ক্ষমতা দেওয়া হয় তাদের। পরের বছরগুলোতে স্থানীয়দের নিপীড়নের অভিযোগ ওঠে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। নিরাপত্তা বাহিনী সেসব অভিযোগ অস্বীকর করে এলেও সে সময় কাশ্মিরে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে প্রায়ই বড় বড় বিক্ষোভ দেখা যেত, যার পরিণতি গড়াত সাধারণ মানুষের মৃত্যুতে।

ভারতের সংবিধানে কাশ্মিররকে যে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল, ২০১৯ সালে মোদীর বিজেপি সরকার সেটি রদ করে। এরপর এ অঞ্চলের টানাপড়েন আরো বেড়েছে।

জাতীয়তাবাদী এই দলটি ভোটের রাজনীতিতে কাশ্মির সঙ্কটকে কাজে লাগিয়েছিল। বিশেষ করে হিন্দুদের কাশ্মির ছাড়ার ঘটনায় কংগ্রেসকে দোষারোপ করেছিল তারা। কাশ্মিরের পণ্ডিতদের বাস্তুচ্যুত করার আগে ও পরে ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস; সে সময় তারা ঘটনাটিকে উপেক্ষা করেছিল বলে বিজেপির অভিযোগ।

তবে স্থানীয়দের ভাষ্য, কোনো রাজনৈতিক দলই কাশ্মিরের পণ্ডিতদের পুনর্বাসনে কোনো ভূমিকা রাখেনি।

সাংবাদিক ও লেখক রাহুল পণ্ডিত বলছেন, কাশ্মিরের নিপড়িত অতীত নিয়ে অসংখ্য বই আর সিনেমা হয়েছে, কিন্তু হিন্দু পণ্ডিতদের বাস্তুচ্যুতি ও এর পরিণতি তুলে ধরা হয়েছে খুব কম। 

বিবিসিকে তিনি বলেন, ”হিন্দু পণ্ডিতরা সবসময় অনুভব করেছেন তাদের ইতিহাসের কণ্ঠরোধ করে রাখা হয়েছে। দ্য কাশ্মির ফাইলস নিয়ে এ কারণেই এত কড়া প্রতিক্রিয়া আসছে।

”হয়ত এমনটা বলতে পারি, এই সিনেমার মধ্যে দিয়ে নিজেদের ভাবাবেগের বহিঃপ্রকাশ করছেন তারা।”

এক কিশোরের শ্রীনগর ছেড়ে পালিয়ে আসার স্মৃতি নিয়ে রাহুল পণ্ডিতের বই রয়েছে– ‘আওয়ার মুন হ্যাজ ব্লাড ক্লটস: আ মেমোয়ার অব আ লস্ট হোম।

তিনি বলেন, “আমার এখনও অবাক লাগে, দেশের মানুষ কাশ্মিরের ইতিহাস নিয়ে এত কম জানে। আমার বই প্রকাশের ১০ বছর হয়ে গেছে। আমি এখনও প্রতিদিন তিন-চারটা ইমেইল পাই ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। কেউ কেউ ভারতের বাইরে থেকেও লিখছেন আমাকে। তারা সবাই আমাকে জানাচ্ছেন, এর আগে এমন মর্মান্তিক ঘটনার ব্যপ্তি নিয়ে তাদের কোনো ধারণাই ছিল না।”

অনেকেই অবশ্য বলছেন, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই; কারণ ভারতের সাম্প্রতিক ইতিহাসের অসংখ্য অধ্যায় রয়েছে।

দলিতদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ, উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ অথবা মাওবাদী তৎপরতা – এসব নিয়ে মূলধারার সিনেমা কমই কথা বলে। 

কাশ্মিরি পণ্ডিত ও তথ্যচিত্র নির্মাতা সঞ্জয় কাক বলেন, “এই গল্পটা বলা হয়নি – এমন অভিমত আমাকে খানিকটা বিভ্রান্ত করছে। এটা বলিউড সিনেমায় বলা হয়নি এবং বলিউড সিনেমা এসব বলেও না।

”শেষ কখন বলিউড ১৯৮৪ সালের দিল্লিতে হওয়া দাঙ্গা নিয়ে অথবা ২০০২ সালে গুজরাটের দাঙ্গা নিয়ে বলেছিল? এমন হাজারো গল্প রয়েছে এদেশে যা কখনও মূলধারার মনোযোগ টানতে পারেনি।”

বিবেক অগ্নিহোত্রী পরিচালিত এই সিনেমা নিয়ে বিতর্কের ডালপালা অবশ্য কাশ্মির থেকে হিন্দুদের বাস্তুচ্যুত করা নিয়ে ছড়াচ্ছে না; কারণ কেউ অস্বীকার করতে পারছে না এমন ঘটেছিল। চলচ্চিত্রের পর্দায় ওই ঘটনা যেভাবে বলা হচ্ছে এবং যিনি তা বলছেন, সেসব ঘিরেই এ বিতর্ক।

রাজনীতির মেরুকরণ

কাশ্মিরি পণ্ডিতদের আবেগকে স্পর্শ করতে পেরেছে এই সিনেমা; যদিও এমন ‘জটিল ইতিহাস’ পর্দায় তুলে ধরায় সূক্ষ্ণতায় অভাব দেখতে পাচ্ছেন সমালোচকরা।

অভিনয় দক্ষতা নিয়ে অনেকের প্রশংসা জুটলেও তাতে এ সিনেমায় ’মুসলমানদের হেয় করার চেষ্টা’ ঢাকা যাবে না- এমন নিন্দাও জুটছে সিমেটির ঝুলিতে।

বিবিসি লিখেছে, দর্শকরা আসলে দুই ভাগে বিভক্ত, কেউ কেউ আপ্লুত হয়ে ভাবছেন এই সিনেমা ক্ষত সারিয়ে দেবে। আর কেউ কেউ কাশ্মীরের মুসলমানদের নিয়ে ‘একপেশে আচরণ’ দেখছেন এ সিনেমায়।

তবে সিনেমাটিকে একেবারে খারিজ করে দিতে চান না অনেকেই।

তাদের ভাষ্যে, কখনোই কোনো বিভেদ পুরোপুরি মেটানো যায় না, যতক্ষণ না দুর্ভোগের শিকার মানুষের যন্ত্রণার কথা প্রকাশ পাচ্ছে।

বিজেপি সরকারের নারী ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি অবশ্য জোরেশোরে সমর্থন দিয়ে চলেছেন এ সিনেমাকে।

সাবেক এই অভিনেত্রী সবাইকে সিনেমাটি দেখার অনুরোধ করছেন যেন ‘নিরপরাধ মানুষের রক্ত শুষে নেওয়া ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না ঘটে’।

নির্মাতা বিবেক অগ্নিহোত্রী এরইমধ্যে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করেছেন। দেখা করেছেন তার পক্ষে টুইট করা বলিউড তারকাদের সঙ্গেও। অক্ষয় কুমার, কঙ্গনা রানাউতের মত তারকারা বিজেপি সরকারকে বেশ সমর্থন দিয়ে আসছেন।

শুধু কি বিজেপি সরকারের আমলেই এমন চলচ্চিত্র নির্মাণ করা সম্ভব?

বিবিসিকে অভিনয় শিল্পী অনুপম খের বলেন, “একদমই তাই... প্রত্যেক সিনেমার জন্যই একটি সময় রয়েছে।”

অনুপম খেরের পাশাপাশি মিঠুন চক্রবর্তী ও পল্লবী জোশীকেও দেখা গেছে এ সিনেমায়।

বিজেপিকে সমর্থন দিয়ে আসা বিবেক অগ্নিহোত্রীকে এরমধ্যে আইনি ঝামেলার মুখেও পড়তে হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ- এ সিনেমায় ‘তথ্য বিকৃতি’ রয়েছে।

বিমান বাহিনীর একজন স্কোয়াড্রন লিডারের চরিত্রায়ন ও মৃত্যু দৃশ্যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল আদালাত।

সিনেমাতে তার স্বামীর চরিত্রটি সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয়নি এবং তাকে হেয় করা হয়েছে অভিযোগ তুলে মামলা করেন ওই কর্মকর্তার স্ত্রী।

অগ্নিহোত্রীর আগের চলচ্চিত্র ‘দ্য তাসখন্দ ফাইলস’ নিয়েও অভিযোগ উঠেছিল। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুর পেছনে ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে দেখানো হয় তাতে। ওই সিনেমার বিরুদ্ধেও ইতিহাস বিকৃতির গুঞ্জন উঠেছিল।   

লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর নাতি উকিল নোটিস পাঠান সিনেমার পরিচালক অগ্নিহোত্রীর নামে।

অভিযোগে তিনি বলেন, ”এ সিনেমা অপ্রত্যাশিত ও অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক উসকে দিতে চাইছে।”

অগ্নিহোত্রী অবশ্য দ্য কাশ্মির ফাইলস সিনেমার বেলায় আত্মপক্ষ সমর্থনে বলেছেন, “এটা আসলে হিন্দু অথবা মুসলমান নিয়ে নয়, যেমনটা লোকে বিশ্বাস করতে চায়।”

তবে ফ্যাক্ট-চেকিং প্ল্যাটফর্ম অল্ট নিউজের সহ-প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ জুবায়ের এর ভিন্ন চিত্র তুলে ধরেছেন।

দেখা গেছে, সিনেমাটি প্রদর্শনের পর দর্শকদের অনেককেই মুসলমানবিরোধী স্লোগানে অংশ নিয়েছেন।

এ সিনেমার সূচনা ২০২০ সালের ‘শিকারা’ থেকে একদমই বিপরীত। শিকারা সিনেমাও এমন উত্তাপ ছড়িয়ে ছিল আলোচনা-সমালোচনার।

এর সহ-লেখক রাহুল পণ্ডিত বলেন,“ডানপন্থি দ্য হিন্দু সিনেমার নির্মাতাকে ধুয়ে দিয়েছিল। এমনকি বিশ্বাসঘাতকও বলেছিল ইতিহাস মুছে ফেলার অভিযোগ তুলে।

“আমার মনে হয় সংবেদনশীলতা এড়িয়ে মানুষ এর রুক্ষ দিকটিই দেখতে চেয়েছিল, যা আমরা দেখাইনি।”   

সঞ্জয় কাক বলেন, “এই সিনেমায় (দ্য কাশ্মির ফাইলস) ডানপন্থিরা যা চায়, তেমনটিই দেখানো হয়েছে।

“শিকারা এই প্রত্যাশা মেটাতে পারেনি বলে আক্রমণের মুখে পড়েছিল। কিন্তু এ সিনেমার বেলায় ডানপন্থি দলগুলো একে বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে কাজ করছে।”

‘সব ধরনের সিনেমার জন্য জায়গা থাকা চাই’; রাহুল পণ্ডিত যখন এভাবে ভাবতে চান, তখন কাক অবশ্য অতটা নিশ্চিত হতে পারেন না।

তিনি বলেন, ”এটাই সত্যি- এমন একটা জোর কাজ করে। তবে কাশ্মীরের ৩০ বছরের ইতিহাসকে অব্যক্ত রেখে শুধু কাশ্মীরের পণ্ডিতদের নিয়ে বললেই হবে না।

“সম্ভবত এ কারণেই বলিউড কখনও এই ইতিহাস নিয়ে সিনেমা করেনি আগে। কারণ এই জটিলতাকে তুলে ধরার মত কোনো জায়গা তো নেই।”