‘শোনো একটি মুজিবরের থেকে’ গানটি যেভাবে এল

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল সময়ে কলকাতার গড়িয়ার এক গলির মোড়ে চায়ের আড্ডা থেকে সৃষ্টি হয়েছিল ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে’ গানের; সেই আড্ডায় গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারে লেখা গানে সুর বেঁধে কণ্ঠে তোলেন লোকসংগীত শিল্পী অংশুমান রায়।

সাইমুম সাদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 March 2022, 05:43 PM
Updated : 16 March 2022, 06:27 PM

একাত্তরের এপ্রিলে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে ‘সংবাদ পরিক্রমা’ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ফাঁকে গানটি প্রচারের পর গানটি দুই বাংলার শ্রোতাদের হৃদয়ে নাড়া দিয়েছিল। অর্ধশত বছর পরও গানটি মানুষের মুখে মুখে ফেরে।

অমলিন সেই গান কীভাবে সৃষ্টি হলো- ২০১৫ সালে কলকাতার দৈনিক স্টেটসম্যানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অংশুমান রায়ের ছেলে লোকসংগীত শিল্পী ভাস্কর রায় জানান, বাজার করতে বেরিয়ে ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিলের সেই চায়ের আড্ডার ফাঁকে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার টুকরো কাগজে গানটি লিখেছিলেন।

আড্ডায় ছিলেন অংশুমান রায়, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকসংগীতের অধ্যাপক দিনেন্দ্র চৌধুরীর সঙ্গে দমদম থেকে আড্ডায় যোগ দেন আকাশবাণীর প্রযোজক উপেন তরফদার; তার কাছে থাকা টেপরেকর্ডারে বাজছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ।

গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার।

ভাস্করের ভাষ্যে, “উপেন জেঠু বললেন, এটি (ভাষণ) সংবাদ-বিচিত্রায় শোনানো হবে, কিন্তু ভাষণটি একটু ছোট। যদি একটা গান দিয়ে তার মাঝে মাঝে এই ভাষণটি চালানো হয়, তাহলে ঠিক হবে।

“যেমন চিন্তা তেমন কাজ। গৌরী (গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার) জেঠুর কলম থেকে বেরিয়ে এল কথার মালা। সেই কথার উপর সুর বসালেন বাবা (অংশুমান রায়)। তৈরি হয়ে গেল একটি নতুন গান। উপেন জেঠু সেইদিনই গানটি রেকর্ড করেছেন, শুধু হারমোনিয়াম বাজিয়ে গানটি গাইলেন বাবা।

“রাত্রে সংবাদ-বিচিত্রায় গানটি বাজানো হল। তখনও কেউ জানে না কী ঘটতে চলেছে। পরের দিন চারদিকে হৈ চৈ। কার কণ্ঠস্বরে এই গান! অংশুমান রায় প্রথম নিজের লোকগানের গণ্ডি ছাড়িয়ে এমন একটি গান গাইলেন, যা দুই বাংলার ইতিহাসে লেখা হয়ে গেল।“

বাংলাদেশের প্রতি শেকড়ের টান অনুভব করতেন গৌরীপ্রসন্ন ও অংশুমান রায়; গানটিতে হৃদয় দিয়ে যেন কথা-সুর করেছিলেন তারা। গৌরীপ্রসন্নের জন্ম পাবনায়, আর অংশুমানের রায়ের পূর্বপুরুষদের ভিটা ছিল রাজশাহীতে।

গানটি আকাশবাণীকে প্রচারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন উপেন তরফদার; মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে সম্মাননা দিয়েছে।

 

নিজের লেখা ‘রক্তের মৈত্রী-বন্ধনে ভারত-বাংলাদেশ’ বইয়ে গানটি নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন উপেন তরফদার।

আকাশবাণী ও দূরদর্শনে চার দশকেরও বেশি সময় কাজ করেছেন বাংলাদেশের মানিকগঞ্জ জেলার নালি গ্রামে জন্ম নেওয়া এ অনুষ্ঠান প্রযোজক।

বইয়ে তিনি লিখেছেন, “সেদিনের ‘সংবাদ-বিচিত্রা’ অংশুমানের গান আর বঙ্গবন্ধু মুজিবুরের রক্ত গরম করা সেই ঐতিহাসিক ভাষণের কিছু অংশ নিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। সেদিনের ভাষণে বাংলাদেশের মানুষের প্রতি আগামী দিনের লড়াইতে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘মনে রাখবা-রক্ত যখন দিয়েছ- রক্ত আরও দেব-এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব- ইনশাল্লাহ- এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম-এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”

বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণের সঙ্গে তাকে নিয়ে লেখা গানের সুবাদে ‘সংবাদ-বিচিত্রা’ র সেই অনুষ্ঠানটি শ্রোতাদের মাঝে আলাদা আবেদন তৈরি করেছিল।

কারণ হিসেবে উপেন লিখেছেন, “গানের হৃদয়স্পর্শী ভাষা, মন মাতানো সুর, দরদি কণ্ঠ আর বঙ্গবন্ধুর রক্ত গরম করা ভাষণ এবং সর্বোপরি দুই বাংলার মানুষের আবেগ আর উত্তেজনায় ভরা সে-সময়ের পরিবেশ, সব মিলিয়েই অনুষ্ঠানটি শ্রোতাদের মনে গভীরভাবে নাড়া দিতে পেরেছিল।”

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, গানের সঙ্গে সেই অনুষ্ঠানের উপস্থাপক দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের দরাজ কণ্ঠের মায়াজালে অনুষ্ঠানটি আলাদা আবেদন তৈরি করেছিল।

পরদিন ১৪ এপ্রিল উপেন তরফদার আকাশবাণী ভবনে গিয়ে উপেন তরফদার দেখেন, আড্ডার ঘুরেফিরে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আর সেই গানের বন্দনা চলছে। স্টুডিওতে ঢুকতে গিয়েই আকাশবাণীর কেন্দ্র প্রধান দিলীপকুমার সেনগুপ্তের ধমক খেতে হয়েছিল তাকে।

“তিনি আমাকে বেশ ধমকেই বললেন, ‘কাল রাতে সংবাদ-বিচিত্রায় কী করেছ? তোমায় আমি মেমো দেব।’ আমি তো অবাক। উনি তো কখনো এভাবে আমার সঙ্গে কথা বলেন না! কী এমন ভুল করলাম, যাতে উনি এতটা উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। কিন্তু কয়েকটি মুহূর্তের জন্যই আমাকে উদ্বিগ্ন থাকতে হয়েছিল। কেন্দ্র-অধিকর্তা হঠাৎ আমায় বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘শুধু খারাপ কাজের জন্যে নয়;  ভাল কাজের জন্যেও ‘মেমো’ দেওয়া হয়। কাল তোমার ‘সংবাদ-বিচিত্রা’ শুনে আমি কেঁদেছি।’

“সত্যিই সেদিনের সংবাদ-বিচিত্রার প্রশংসা করে এক ঘণ্টার মধ্যেই তিনি আমায় মেমো পাঠিয়েছিলেন। সেই সময় নিচু থেকে উঁচু পর্যায়ের প্রতিটি কর্মী কেমনভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন; আমাদের কেন্দ্র-অধিকর্তার কান্না তারই এক উজ্জ্বল নিদর্শন।”

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনুষ্ঠান প্রচারের পাশাপাশি উপেন তরফদার মুক্তিযুদ্ধের খবর সংগ্রহে তিনি বারবার ছুটে গিয়েছেন রণাঙ্গনে।

মুজিবনগরে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানেও উপস্থিত ছিলেন তিনি। যশোর ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের দিনও উপস্থিত থেকে খবর সংগ্রহ করেছেন।

রেডিওতে প্রচারের পর ২২ এপ্রিল গানটি ‘হিন্দুস্তান রেকর্ড'-এর স্টুডিওতে রেকর্ড করা হয়। সংগীত পরিচালনা করেছিলেন দিনেন্দ্র চৌধুরী। সেই রেকর্ডের ‘আ মিলিয়ন মুজিবুর’র সিঙ্গিং’ শিরোনামে ইংরেজি গানও যুক্ত করা হয়েছিল। ইংরেজি গানে অংশুমানের সঙ্গে কণ্ঠ দেন করবী নাথ।