সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের চিরবিদায়

বাংলা আধুনিক গান নিয়ে মানুষের ঘরে ঘরে যিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন, একটি প্রজন্ম যার গান এখনও গুনগুনিয়ে গেয়ে ওঠে, সেই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় আর নেই।

গ্লিটজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Feb 2022, 02:44 PM
Updated : 15 Feb 2022, 06:56 PM

কিংবদন্তি লতা মঙ্গেশকরের বিদায় শোক কাটতে না কাটতেই মঙ্গলবার চিরবিদায় নিলেন ভারতের বাংলা গানের প্রবাদপ্রতিম এই শিল্পী, ৯০ বছর বয়সে।

বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন সন্ধ্যা, গত ২৬ জানুয়ারি জ্বর নিয়ে কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর কোভিড সংক্রমণও ধরা পড়েছিল।

চিকিৎসাধীন অবস্থায় মঙ্গলবার সন্ধ্যায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা পিটিআই।

কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার জানিয়েছে, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শৌচাগারে পড়ে গিয়ে চোট পান সন্ধ্যা। এর পর বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সেইসঙ্গে যোগ হয়েছিল শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা। তার দুটি ফুসফুসেই সংক্রমণ দেখা দেয়। সন্ধ্যার হৃদযন্ত্রে সমস্যার কথা জানান চিকিৎসকরা।

হাসপাতালে ভর্তির একদিন আগেই ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্মান পদ্মশ্রী খেতাব প্রত্যাখ্যান করে আলোচনায় এসেছিলেন কিংবদন্তি এ সঙ্গীতশিল্পী।

ছবি: আনন্দবাজার প্রত্রিকা

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে কলকাতায় নেমেছে শোকের ছায়া। শোক জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

শোক জানিয়ে মমতা বলেন, “উনি স্বর্ণালি সময়ের শিল্পী। সেই যুগের সকলেই চলে গিয়েছেন। উনি ছিলেন। উনিই শেষ সুরের ঝঙ্কার, সুরের স্পন্দন, গানের ইন্দ্রধনু। একটা শতাব্দীর আর কেউ রইলেন না। এ ক্ষতি অপূরণীয়। আমি মনে করি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ভারতরত্ন।”

মুখ্যমন্ত্রী জানান, বুধবার দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত সন্ধ্যার কফিন কলকাতার রবীন্দ্র সদনে রাখা হবে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। এর পর রাজ্যের সর্বোচ্চ সম্মান ‘গান স্যালুট’ দিয়ে শেষকৃত্য হবে।

জনপ্রিয় অনেক গানের জন্য বাংলাদেশেও পরিচিত সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের নাম জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের ইতিহাসেও।

একাত্তরে শরণার্থী বাঙালিদের জন্য অর্থ তুলেছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে তাকে নিয়ে একটি গান গেয়েছিলেন তিনি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় পল্টন ময়দানে একটি উন্মুক্ত কনসার্টে গাইতে এসেছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।

সেই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।  

শোকবার্তায় শেখ হাসিনা বলেছেন, “উপমহাদেশে গানের মুগ্ধতা ছড়ানোর পাশাপাশি মহান মুক্তিযুদ্ধে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে।”

ছবি: আনন্দবাজার প্রত্রিকা

 শাস্ত্রীয় সংগীত, রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল গীতি, হিন্দি গানসহ উপমহাদেশের সংগীতের প্রায় সবকটি জায়গায় স্বাক্ষর রেখেছেন ‘গীতশ্রী’ উপাধি পাওয়া সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।

তবে কলকাতার বাংলা সিনেমায় মহানায়িকা সুচিত্রা সেনকে যে গানগুলো গা্ইতে দেখা যেত, সেসব গানের জন্যই সন্ধ্যা জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠেছিলেন।

পর্দার উত্তম কুমার-সুচিত্রা জুটির অনেক রোমান্টিক গানের নেপথ্যে সন্ধ্যার সঙ্গে ছিলেন প্রবাদপ্রতিম আরেক কণ্ঠশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।

এর মধ্যে রয়েছে ‘এ শুধু গানের দিন', ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’, ‘এই মধুরাত’, ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’, ‘কে তুমি আমারে ডাক’, ‘মায়াবতী মেঘে এল যে তন্দ্রা’ এর মতো গান।

১৯৫৫ সালে মুপ্তি পাওয়া অগ্নিপরীক্ষায় ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’ নিয়ে সন্ধ্যা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমাদের (সুচিত্রা সেন ঠোঁট মিলিয়েছিলেন) প্রথম হিট গান ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’। পর্দায় ওর (সুচিত্রা) লিপ দেওয়া দেখে আমি হাঁ হয়ে গেছিলাম। এত নির্ভুল! অমর হয়ে গিয়েছিল ওই গানটা।”

অনুপম ঘটকের সুরে এই গান প্রকাশ পাওয়ার পরপরই সাড়া পড়েছিল শ্রোতার হৃদয়ে। এই গানের ‘মিতা মোর কাকলী কুহু…’ লাইনে ‘কুহু’ শব্দটা সন্ধ্যা যেভাবে গেয়েছেন, তাও সাড়া ফেলেছিল।

১৯৬৬ সালে কবি, গীতিকার শ্যামল গুপ্তের সঙ্গে বিয়ে হয় সন্ধ্যার। সন্ধ্যার বহু গানের গীতিকারও ছিলেন তিনি।

ছবি: আনন্দবাজার প্রত্রিকা

সন্ধ্যার জন্ম ১৯৩১ সালে কলকাতার ঢাকুরিয়ায়। নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এবং হেমপ্রভা দেবীর ছয় সন্তানের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন তিনি। বাবার কাছে ভক্তিমূলক গানের মাধ্যমে তার গানের রেওয়াজ শুরু, তার মা-ও গান গাইতেন।

সন্ধ্যা ১২ বছর বয়সে কলকাতা আকাশবাণীর ‘গল্পদাদুর আসর’-এ প্রথম গেয়েছিলেন গীতিকার অজয় ভট্টাচার্যের লেখা একটি গান।

১৩ বছর ১০ মাস বয়সে প্রথম বেসিক রেকর্ড করেন গিরিন চক্রবর্তীর কথা ও সুরে। এইচএমভি থেকে প্রকাশিত হয় সেই রেকর্ড।

এর এক পিঠে ছিল ‘তুমি ফিরায়ে দিয়ে যারে’, উল্টো পিঠে ‘তোমারো আকাশে ঝিলমিল করে চাঁদের আলো।’

এর বছর দুয়েক পরে কিংবদন্তি সুরকার রাইচাঁদ বড়ালের সুরে ‘অঞ্জনগড়’ ছবিতে এবং রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে ‘সমাপিকা’ সিনেমায় গান রেকর্ড করেন।

সন্ধ্যা গান শিখেছেন যামিনী গঙ্গোপাধ্যায়, ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি, চিন্ময় লাহিড়ী, এ কানন, ডিটি যোগী, গণপত রাও, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, এবং সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তীর কাছে।

শচীন দেব বর্মন, অনুপম ঘটক, রবীন চট্টোপাধ্যায়, নচিকেতা ঘোষ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরীর মতো দিকপালদের সুরে যেমন গলা দিয়েছেন সন্ধ্যা, আবার নতুন প্রজন্মের সংগীতকার কবীর সুমনের কথা ও সুরেও গেয়েছেন।

সন্ধ্যা-হেমন্ত জুটি। ছবি: এইসময়

১৯৫০ সালে শচীন দেব বর্মনের আহ্বানে মুম্বাইয়ে যাত্রা করেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়; গিয়ে ওঠেন শচীনদেবের আস্তানা এভারগ্রিন হোটেলে।

শচীনদেব নিয়ে গেলেও মুম্বইয়ে প্রথম প্লেব্যাকের সুযোগ হল অনিল বিশ্বাসের সুরে। ‘তারানা’ সিনেমায়। সেখানে গাইতে গিয়েই লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। গানটা ছিল লতার সঙ্গে দ্বৈত কণ্ঠে— ‘বোল পাপিহে বোল রে, তু বোল পাপিহে বোল’।

সব মিলিয়ে ১৭টি হিন্দি চলচ্চিত্রের গানে নেপথ্যে কণ্ঠ দিয়েছেন সন্ধ্যা। তবে বলিউডে বেশিদিনের জন্য থিতু হননি তিনি। ব্যক্তিগত কারণে ১৯৫২ সালে তিনি কলকাতায় ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন।

আনন্দবাজার লিখেছে, সন্ধ্যার শিল্পী জীবনের অন্যতম মাইলফলক ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’-তে অংশগ্রহণ। পঙ্কজকুমার মল্লিক, বাণীকুমার, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র আর একঝাঁক শিল্পীর সঙ্গে সন্ধ্যাও ছিলেন।

‘বিমানে বিমানে আলোকের গানে জাগিল ধ্বনি’ গানটি এখনও সন্ধ্যার গলায় শোনা যায়। এই গানটি অবশ্য পরবর্তীকালে রেকর্ড করা হয়।

মান্না দের সঙ্গে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। ছবি: আনন্দবাজার প্রত্রিকা

‘স্বর্ণযুগের’ এই গায়িকার হাতে উঠেছিল ভারতের ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড, বিএফজেএ অ্যাওয়ার্ড-সহ বহু সম্মান। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাকে ২০১১ সালে ‘বঙ্গবিভূষণ’, ২০১২ সালে ‘সঙ্গীত মহাসম্মান’ ও ২০১৫ সালে ‘উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি বিশেষ সঙ্গীতসম্মান’দিয়েছিল। আমৃত্যু পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সঙ্গীত আকাদেমির সভাপতিও ছিলেন তিনি।

তবে গান গেয়েই সন্ধ্যা পেয়েছেন মানুষের অফুরান ভালোবাসা। সেই শক্তিতেই চলে যাওয়ার কয়েক দিন আগে পাওয়া জাতীয় পুরস্কার পদ্মশ্রী প্রত্যাখ্যান করেছেন; শিল্পীর সম্মানের খাতিরে।

দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিলেন, “কনিষ্ঠ শিল্পীদের এই পুরস্কার দেওয়া হোক। আমার দেশ আমাকে যেভাবে ভালবাসে, সেখানে আমার পদ্মশ্রী কিংবা কোনও শ্রীর-ই প্রয়োজন নেই।”