একজন প্লেব্যাক সিঙ্গার লতা মঙ্গেশকরই ভারতের চলচ্চিত্রের অঙ্গন শাসন করেছেন বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ; হয়ে উঠেছেন বলিউডের ‘নাইটিঙ্গেল’।
সেসব দিনে নামি-দামি সব নায়িকাই চাইতেন, পর্দায় তাকে যে গানটি গাইতে দেখা যাবে, তাতে যেন লতাজির কণ্ঠ থাকে। তিনি যে কোকিলকণ্ঠী, ভারতের সুরসম্রাজ্ঞী!
তার কণ্ঠের জাদু ছাড়িয়ে গেছে দেশের সীমানা, ঘুচিয়ে দিয়েছে ভাষার ব্যবধান। দীর্ঘ সাতটি দশক ভারতীয় উপমহাদেশের সংগীতভক্তদের তিনি বেঁধে রেখেছেন সুরের মায়ায়।
সে কি কেবলই কণ্ঠের জাদু? অনেকের বিচারে লতা মঙ্গেশকর ভারতের সেরা সংগীত শিল্পীদের একজন। আসলে তিনি ছিলেন তার চেয়েও বেশি কিছু। ভারতের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে প্রথম সারির আইনকনদের একজন।
ঊনিশশ চল্লিশের দশকের শুরুতে ভারতীয় কোনো পরিবারে ধ্রুপদ সংগীতের চর্চা থাকলে সেই পরিবারের কর্তা চাইতেন না, সে বাড়িতে সিনেমার গান ঢুকুক। লতার বাবা দীনানাথ মঙ্গেশকরও চাননি। তিনি ছিলেন মারাঠি থিয়েটারের অন্যতম পুরোধা একজন ‘ক্লাসিক্যাল’ শিল্পী। তার কাছেই লতা মঙ্গেশকরের গান শেখার শুরু।
তবে কঠিন সময় এসেছিল শৈশবেই। টাকা খুইয়ে নিঃস্ব হয়ে থিয়েটার কোম্পানি বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিলেন দীনানাথ মঙ্গেশকর। ইন্দোরের পারিবারিক বাড়িও নিলামে ওঠে। পরিবার নিয়ে তিনি চলে যান পশ্চিমের শহর পুনেতে।
কিছুদিন পর দীনানাথের মৃত্যু হলে পাঁচ ভাইবোনের সংসার নিয়ে বিপাকে পড়েন কিশোরী লতা। পরে পরিবার নিয়ে চলে যান মুম্বাইয়ে।
বিবিসি এক প্রতিবেদনে লিখেছে, ৪০ এর দশকের শুরুতে সেই সময় চলচ্চিত্রে গান খুব বেশি ছিল না। জীবিকার জন্য লতা অভিনয় শুরু করেন। আটটি মারাঠি এবং হিন্দি সিনেমায় অভিনয়ও করেন।
সেসব দিনে ওস্তাদ আমান আলী খানের কাছে ক্লাসিকাল শিখতেন লতা। ১৯৪৩ সালে মারাঠি সিনেমা গাজাভাউতে তার আত্মপ্রকাশ ঘটে গায়ক হিসেবে। তবে সেই গান ছিল শুধু কয়েক লাইনের।
তখন কেএল সায়গল, শামশাদ বেগম ও নুরজাহানদের যুগ। শুরুর দিকে লতা মঙ্গেশকরকে শুনতে হয়েছিল, তার কণ্ঠস্বর একটু বেশিই পাতলা।
অনেক পরে প্রযোজক, পরিচালক ও লেখক নাসরিন মুন্নি কবিরকে এক সাক্ষাৎকারে লতা বলেছিলেন, “আমি কখনোই ওই কাজটা পছন্দ করতে পারিনি। ওই মেইক-আপ, লাইট। তারা এসে আমাকে আদেশ করবে- বলবে ‘এই সংলাপটি বলুন, সেই সংলাপটি বলুন’, আমি খুব অস্বস্তিতে ছিলাম।”
লতা খুব অবাক হয়েছিলেন, যখন একজন পরিচালক বলেছিলেন, তার ভ্রু খুব চওড়া, সেগুলো ছেঁটে ফেলতে হবে। অবাক হলেও পরে রাজি হতে হয়েছিল তাকে।
গায়ক হয়ে ওঠার জন্য লতাকে প্রথম বড় সুযোগটি দেন মাস্টার গুলাম হায়দার। ১৯৪৯ সালে আসে ‘মহল’ সিনেমার সেই বিখ্যাত গান ‘আয়েগা আনেওয়ালা’। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
সেই সিনেমা ১৬ বছরের মধুবালা ও ২০ বছরের লতা, দুজনের জন্যই ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। নায়িকা ও গায়িকার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে ওই সিনেমার পর। সেই পথ ধরেই লতার কণ্ঠ হয়ে ওঠে বলিউডের ‘গোল্ডেন ভয়েস’।
বিবিসি লিখেছে, দীর্ঘ ক্যারিয়ারে লতার ঝুলিতে জমেছে ৩৬ ভাষায় অসংখ্য ঘরানার অন্তত ৩০ হাজার গান। কণ্ঠ দিয়েছেন এক হাজারের বেশি সিনেমায়। ভারতে ‘সবচেয়ে দামি শিল্পী’ও তিনি।
লতা মঙ্গেশকরের জন্ম ১৯২৯ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর, ভারতের ইন্দোরে। আগে নাম ছিল হেমা। তবে মৃত বড় বোনের নাম লতিকা হওয়ায় তার নাম হয়ে যায় লতা।
ভারতীয় সাংস্কৃতিক জগতের এই আইকন কখনোই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না। এক গৃহপরিচারিকা তাকে মারাঠি বর্ণমালা শিখিয়েছিলেন। স্থানীয় এক পুরোহিতের কাছে সংস্কৃত শিখেছিলেন। আত্মীয়স্বজন আর শিক্ষকরা তাকে বাড়িতে অন্যান্য বিষয় শিখিয়েছিলেন।
বলিউডে তখন স্বর্ণযুগের সবে শুরু, একই সময়ে লতা মঙ্গেশকরের ক্যারিয়ারের সূচনা। পরের চার দশকে পাকিজা, মজবুর, আওয়ারা, মুঘল ই জাম, শ্রী ৪২০, আরাধনা এবং দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে, এ রোম-কম এর মতো ২০ বছর ধরে চলা চলচ্চিত্রগুলোতে জনপ্রিয় সব গান গেয়েছেন।
১৯৬২ সালে চীনের সঙ্গে যুদ্ধে ভারতের নিহত সেনাদের স্মরণে একটি জনসভায় ‘ইয়ে মেরে ওয়াতান কে লগন’ গানটি গেয়েছিলেন কিংবদন্তি এই শিল্পী। সেই গান শুনে চোখ ভিজে আসে অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর ।
১৯৪০ এর দশকের মধু বালা থেকে ১৯৯০ সালের কাজল পর্যন্ত সকল শীর্ষ নায়িকাদের জন্য গান করেছেন লতা। মহম্মদ রাফি এবং কিশোর কুমারসহ বহু পুরুষ গায়কদের সঙ্গে তার ডুয়েট রয়েছে।
রাজ কাপুর এবং গুরু দত্ত থেকে শুরু করে মণি রত্নম ও করণ জোহর পর্যন্ত শীর্ষস্থানীয় প্রত্যেক বলিউড পরিচালক কাজ করেছেন এই গুণী শিল্পীর সঙ্গে।
নিজের বোন আশা ভোঁসলের সঙ্গেও প্লেব্যাকে গেয়েছেন লতা মঙ্গেশকর। একটা পর্যায়ে তাদের ক্যারিয়ার চলেছে প্রায় সমান্তরালে। তবে তাদের মধ্যে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না।
মোহাম্মান্দ রাফির মতো শীর্ষস্থানীয় পুরুষ গায়কদের চ্যালেঞ্জ করার মত সাহসের অভাব ছিল না লতার। তিনি দাবি করেছিলেন, ভারতীয় চলচ্চিত্রে সবচে বেশি গান গাওয়ার কৃতিত্ব তার এবং তিনিই প্রথম নারী গায়ক, যিনি ভাল বেতন ও রয়্যালটি দাবি করতে পারেন।
“আমি নিজে নিজে তৈরি হওয়া একজন মানুষ। কীভাবে লড়াই করতে হয় তা আমি শিখেছি। আমি কখনো কাউকে ভয় পাইনি। আমি নির্ভীক। কিন্তু আমি কখনও কল্পনাও করিনি, আমি আমার মত করে এতটা পাব।”
লতা তার নিজের মত করে ‘অনেকটা’ পেয়েছেন। আর বলিউড পেয়েছে লতাকে। গীতিকার ও চিত্রনাট্যকার জাভেদ আখতার বলেছিলেন, “মাইকেল অ্যাঞ্জেলো মানেই যেমন চিত্রকলা, শেক্সপিয়ার মানেই যেমন ইংরেজি সাহিত্য, তেমনই ভারতীয় সিনেমার গান মানেই লতা মঙ্গেশকর।”
তার সুরেলা কণ্ঠ এবং প্রাণবন্ত গান জাভেদ আখতারের ভাষায় ‘ঝিনুকের সেরা মুক্তার মত খাঁটি এবং নির্মিল।’
বলিউডে কোন গানগুলো সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়? এই প্রশ্নে লাতা মঙ্গেশকর একবার বলেছিলেন, “প্রেমের গানগুলো সবচেয়ে জনপ্রিয়। নায়িকা দৌড়াচ্ছে, আর নায়ক তার পিছনে ছুটছে।”
লতা মঙ্গেশকর মোজার্ট, বিটোভেন, শোপাঁ, ন্যাট কিং কোল, বিটলস এবং হ্যারি বেলাফন্টের অনুরাগী ছিলেন। স্টেজে মারলিন দিয়েত্রিচের গান গাওয়া দেখতে গিয়েছিলেন, পছন্দ করতেন বার্গম্যানের থিয়েটার।
সিনেমাও দেখতে পছন্দ করতেন লতা। তার প্রিয় হলিউডি সিনেমা ছিল- দ্য কিং অ্যান্ড আই। সিনেমাটি তিনি ১৫ বার দেখেছিলেন। জেমস বন্ড সিরিজের ফিল্মগুলো, বা অন্ততপক্ষে শন কনারি বা রজার মুরের অভিনীত সিনেমা তার পছন্দ ছিল। তবে বন্ডই কেবল তাকে তার নজর কাড়েনি, শার্লক হোমস সিরিজের উপন্যাসেরও তিনি ভক্ত ছিলেন।
আর ছিল গাড়ির প্রতি ভালোবাসা। জীবনের বিভিন্ন সময়ে তিনি একটি ধূসর হিলম্যান এবং নীল শেভ্রোলে, ক্রাইসলার এবং একটি মার্সিডিজ ব্যবহার করেছেন। বাড়িতে নয়টি কুকুর পুষতেন।
ক্রিকেটের প্রতিও তার ভালোবাসা ছিল অনেক। প্রায়ই রেকর্ডিংয়ে বিরতি দিয়ে ছুটতেন টেস্ট ম্যাচ দেখতে। ডন ব্র্যাডম্যানের স্বাক্ষরিত ছবি নিয়ে গর্ব করতেন।
লতা রান্না করতে পছন্দ করতেন। একটি রোলিফ্লেক্স ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলতেন। যুক্তরাষ্ট্রে ছুটির দিনে লাস ভেগাসে সারারাত স্লট মেশিনে জুয়া খেলতেন।
বিবিসিকে এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন “একটু অদ্ভুত শোনাতে পারে, তবে আমি যখন ছুটিতে আমেরিকায় বেড়াতে যেতাম, লাস ভেগাসে সময় কাটাতে পছন্দ করতাম।”
“দারুণ মজার এক শহর। স্লট মেশিনে খেলাটা আমি সত্যিই উপভোগ করেছি। রুলেট বা কার্ড কখনো খেলিনি, তবে আমি একটি স্লট মেশিনে সারা রাত কাটাতে পারতাম। আর আমি খুব ভাগ্যবান, অনেকবার জিতেছিলাম।”
কোভিডে আক্রান্ত হয়ে প্রায় চার সপ্তাহ মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন কোকিলকণ্ঠী এই শিল্পী। রোববার সকালে ৯২ বছর বয়সে সেখানেই তার মৃত্যু হয়।
ভারত ছাড়া বাংলাদেশের একাধিক প্রজন্মের কাছেও লতার কণ্ঠ স্বপ্নের মত। বাংলা সিনেমাতেও প্রায় ২০০ গান রয়েছে লতার। তার কণ্ঠের ‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে’, ‘রঙ্গিলা বাঁশিতে’, ‘নিঝুম সন্ধ্যায়’, ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’, ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘যা রে উড়ে যারে পাখি’, ‘বলছি তোমার কানে’, ‘চলে যেতে যেতে দিন বলে যায়’ এর মত বহু গান এ দেশের মানুষ মনে রাখবে আরও বহু দিন।
আকাশছোঁয়া খ্যাতির পথে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন লতা মঙ্গেশকর। ২০০১ সালে লতা মঙ্গেশকর ভারতের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ভারতরত্ন অর্জন করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার লাভ করেন।
একই বছর পদ্মভূষণও পান। ১৯৯৯ সালে পদ্মবিভূষণ এবং ২০০১ সালে সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ভারতরত্ন দেওয়া হয় তাকে।
সংসারে না জড়িয়ে আজীবন একাকি কাটিয়ে দেওয়া লতা মঙ্গেশকর একবার বলেছিলেন, “আমি সবসময় মনে করি, সুখ বিশ্বের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার জন্য, আর দুঃখ নিজের মধ্যে রাখতে হয়।”
আরও পড়ুন