‘নাইটিংগেলের’ জন্য শোকগাথা

ভারতবাসীর কাছে তিনি ছিলেন গানের পাখি নাইটিংগেল, কেউবা বলতেন ‘স্বরা কোকিল’। কিংবদন্তি শিল্পী লতা মঙ্গেশকরের প্রয়াণে শোকে স্তব্ধ ভারতীয় সংগীত জগত।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Feb 2022, 10:25 AM
Updated : 6 Feb 2022, 10:57 AM

মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোববার সকালে মারা যান লতা মঙ্গেশকর। কোভিডে আক্রান্ত হয়ে প্রায় চার সপ্তাহ সেখানে ভর্তি ছিলেন তিনি।

তার মৃত্যুতে ভারতে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। সর্বকালের অন্যতম সেরা এই সংগীত শিল্পীর সম্মানে ভারতের জাতীয় পতাকা দুই দিন অর্ধনমিত রাখা হবে।

শোক প্রকাশ করে সোমবার অর্ধদিবস ছুটি ঘোষণা করেছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার। আগামী ১৫ দিন রাজ্যে বাজবে লতার গাওয়া গান।

দীর্ঘ ক্যারিয়ারে হাজারের বেশি সিনেমায় গান করেছেন লতা। ভারতের ৩৬টি আঞ্চলিক ভাষার পাশাপাশি বিদেশি ভাষাতেও তিনি গান করেছেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার ছবি দিয়ে, তার সঙ্গে স্মৃতির কথা লিখে, কিংবা তার কাছে অনুপ্রেরণা পাওয়ার কথা জানিয়ে শোক প্রকাশ করছেন ভারতের বিভিন্ন অঙ্গনের প্রতিনিধিরা।

শিল্পী হৈমন্তী শুক্লা আনন্দবাজারকে বলেছেন, “লতা দিদির বাংলা গান আমার কণ্ঠস্থ, সেই শুনেই হেমন্তদা গাইতে ডেকেছিলেন।”

লতার সঙ্গে প্রথম দেখার স্মৃতিচারণ করেন হৈমন্তী, “…লতা দিদির প্রথম মুখোমুখি হওয়া আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা। একবার উনি কলকাতায় এসেছেন অনুষ্ঠান করতে। গ্র্যান্ড হোটেলে উঠেছেন। সেই সময়ে সুপ্রকাশ গড়গড়ি ফোন করে জানালেন, লতাজি আমায় ডেকেছেন। উনি কিছু বাংলা গানের কথা ভুলে গিয়েছেন। আমার সব গান মুখস্থ থাকে জেনে সহযোগিতার জন্য ডেকেছেন।

“সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়েছিলাম তার কাছে। তখনই দেখেছিলাম, ওর একটি ব্রিফকেস ভর্তি গানের মোটা মোটা খাতা! সেখানে সব গান যত্নে লেখা। তার মধ্যে কয়েকটি বাংলা গান হারিয়ে ফেলেছেন। আমাকে বসিয়ে সে সব শুনে নতুন করে তুলে নিলেন খাতায়।”

টুইটারে লতার সঙ্গে নিজের একটি ছবি প্রকাশ করে সুরকার এ আর রহমান লিখেছেন, “ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং প্রার্থনা।”

পশ্চিমবাংলার আনন্দবাজার পত্রিকার কাছে শোক প্রকাশ করে গায়ক-সুরকার রূপঙ্কর বাগচী বলেছেন, “যেন সদ্য মাতৃহারা হলাম। যে কোনও সন্তান সদ্য মাকে হারালে যে ভাবে যন্ত্রণায় ছটফটিয়ে ওঠে, আমার সেই অবস্থা। ভাষায় বোঝাতে পারছি না।”

শিল্পী মনোময় ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘‘ছোট থেকে গুনগুন করতাম সলিল চৌধুরীর সুরে ওর ‘আজ নয় গুনগুন গুঞ্জন প্রেমে’ গানটি। হিন্দির পাশাপাশি তার বাংলা গানগুলোও আমার বড় প্রিয়। হারমোনিয়াম বাজিয়ে প্রায়ই গেয়েছি, ‘কী লিখি তোমায়, প্রিয়তমা’।”

সংগীতকার দেবজ্যোতি মিশ্র আনন্দবজারে লিখেছেন, “এই পৃথিবীর মায়া-স্মৃতি-প্রেম-প্রণয়, এই পৃথিবীর অভিমান-আদর-বিতৃষ্ণা-রাগ সব ফেলে চলে যাচ্ছেন আমাদের সম্রাজ্ঞী, না কি ভালবেসে আমরা তাকে বরণ করে নিচ্ছি মহাকালে। সুরের ভারতবর্ষ সঙ্গীতের ভারতবর্ষ সাধারণ ও অসাধারণ সমস্ত ভারতবর্ষ আজ নতমুখে দাঁড়িয়ে...।”

ভারতের জাতীয় পুরস্কারজয়ী শিল্পী অনুপম রায় আক্ষেপ করে বলেছেন, “ওর সময়ে জন্মালে ওর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেতাম। আমাদের দুর্ভাগ্য, এ জন্মে সেই সাধ পূরণ হল না। লতাজিকে তাই তার গানেই বিদায় জানানো ছাড়া উপায় নেই। অনেকটাই গঙ্গাজলে গঙ্গা পুজোর মতো।”

লোপামুদ্রা মিত্রের কাছে যেন জীবন্ত দেবীর বিসর্জন ঘটল।

তিনি বলেছেন, “বরাবরের আফসোস, কোনও দিন সামনে থেকে কিশোর কুমারকে দেখতে পাইনি। লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে মঞ্চ ভাগ করে নেওয়ার অভিজ্ঞতা সেই আক্ষেপ যেন কিছুটা মিটিয়েছিল।”

ইমন চক্রবর্তী বলেছেন, “লতা মঙ্গেশকরের শরীরের বিনাশ হল। আত্মা পাড়ি দিল সুরলোকে। সুর সম্রাজ্ঞী বিদায় নিয়েছেন। বদলে রেখে গিয়েছেন তার অসংখ্য গান। ৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে অবিস্মরণীয় কাজ করেছেন। আজ তাকে, তার গানকে, তার কাজকে নতুন ভাবে ফিরে দেখার দিন। তার অবদান উদযাপনের দিন।”

লতার সঙ্গে নিজের জীবনের নানা ঘটনা আনন্দবাজারে লিখেছেন ওস্তাদ রশিদ খান। শোক প্রকাশ করে এই শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পী বলেছেন, “কালের নিয়মে লতাজি প্রয়াত হলেন ঠিকই। কিন্তু লতাজির মতো শিল্পীর তো প্রয়াণ হয় না। তিনি থেকে যাবেন তার সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে।

“আমার তখন ২৭-২৮ বছর বয়স। ‘বৈষ্ণব জন তো’ ভজনটি রেকর্ড করা হবে। সরকারি অনুষ্ঠানের জন্য। কে শেখাবেন গানটি? লতা মঙ্গেশকর। ফোনে সেই গানটি আমাকে তুলিয়ে দেন লতাদিদি। সেই স্মৃতি আমি কখনওই ভুলতে পারব না। ওর কাছে অন্তত একটা তো শিখেছি!”

এই প্রজন্মের জনপ্রিয় শিল্পী শ্রেয়া ঘোষাল ইন্সটাগ্রামে লিখেছেন, “অসাড় বোধ করছি। বিধ্বস্ত। গতকাল সরস্বতী পূজা ছিল এবং আজ মা তার আশীর্বাদকে সঙ্গে নিয়ে গেছেন। মনে হচ্ছে পাখি,গাছ,বাতাসও আজ নীরব। লতা মঙ্গেশকরজি আপনার ঐশ্বরিক কণ্ঠ চিরকাল প্রতিধ্বনিত হবে। শান্তিতে বিশ্রাম করুন। ওম শান্তি।”

 

শিল্পী আদনান সামি লিখেছেন, সংগীত আজ এতিম হয়ে গেল। আমাদের ‘নাইটিঙ্গেল’ উড়ে গেছে। আমরা কণ্ঠহীন হয়ে পড়েছি। আমরা তার জীবদ্দশায় বেঁচে ছিলাম এবং সেই বাতাসে শ্বাস বাতাসে শ্বাস নেওয়ার বিশেষ অধিকার পেয়েছি, যাতে তিনি শ্বাস নিয়েছিলেন। সবকিছুর জন্য আপনাকে ধন্যবাদ প্রিয় দিদি।”

 

জনপ্রিয় শিল্পী কুমার সানু আনন্দবাজারকে বলেছেন, “অনেক গান গেয়েছি লতাজির সঙ্গে। মানুষের মন জয় করতে পেরেছে সেই গানগুলি। আমার মতে, ওর মতো অভিজ্ঞতা গোটা বিশ্বে আর কারও নেই। ওর চলে যাওয়ায় শুধু আমাদের ইন্ডাস্ট্রিরই ক্ষতি হল না, গোটা দুনিয়া এক কিংবদন্তি কণ্ঠস্বর হারাল।”