লাল মোরগের ঝুঁটি: একাত্তরের আরেক আখ্যান

মুক্তিযুদ্ধের গল্প একই সঙ্গে বাঙালির আনন্দ ও বেদনার গল্প। মার খেতে খেতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া বাঙালির ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। সাড়ে সাত কোটি বাঙালিরে ‘দাবায়ে রাখবার পারবা না’র গল্প। ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ তেমন গল্পের চলচ্চিত্র।

>> আহসান কবিরবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Dec 2021, 07:46 AM
Updated : 11 Dec 2021, 08:26 AM

তাজমহল নির্মাণের পেছনে হাজারো শ্রমিকের যেমন শোষণের ঘাম আছে, ঠিক তেমনি পাকিস্তানিদের সৈয়দপুর এয়ারপোর্ট নির্মাণের পেছনে শ্রমিক নিষ্পেষণ আর লাগোয়া গ্রামের মানুষদের আত্মত্যাগের কাহিনী এই ছবির ‘সাদাকালো’ প্রতিফলন।

১৯৭১ এর অগাস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বরের গল্প ‘লাল মোরগের ঝুটি’। রঙিন ক্যামেরায় ধারণ করা হলেও এক ঘণ্টা ৪৬ মিনিটের এই ছবির রঙ ‘সাদাকালো’।

সৈয়দপুরে বিমানবন্দর নির্মাণের জন্য এখানে ঘাঁটি গাঁড়ে দুই পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন ও কয়েক জন সেনা। লাগোয়া গ্রামের রাজাকারদের ওপর (জয়রাজ ও তার সাঙ্গপাঙ্গ) ভর করে পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন (দুই ক্যাপ্টেন আছে ছবিতে। একজন আর্টিলারি ও একজন ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সম্ভবত। আদৌ পরিষ্কার নয় বিষয়টা) । রাজাকারদের সহায়তায় নির্মাণ শ্রমিকদের আটকে রেখে মানবেতর ভাবে কাজ করানো হয়।

এই গ্রামের প্রান্তিক মানুষ যাদের রেডিও ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানার আর কোনো মাধ্যম নেই, তারা প্রগাঢ়ভাবে উপস্থিত এই সিনেমায়। পরোক্ষভাবে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রও খুব শক্তভাবে আছে যার প্রতীক রেডিও নির্ভরতা।

ছবির ‘বুদ্ধ’ (আশীষ খন্দকার) ও তার কন্যা পদ্ম (আশনা হাবীব ভাবনা) যে কিনা মোরগ লড়াইয়ের জন্য ‘যোদ্ধা মোরগ’ পালে, তাদের নিয়ে গল্প শুরু। বুদ্ধ ‘লাশ’ আনা-নেওয়ার কাজ করে আর মদ খায়। পদ্ম বাবার দেখভালের সঙ্গে সঙ্গে মানুষকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে।

আহমেদ রুবেলদের ‘নুন খাওয়া’ শামসু চোরা পাকিস্তানী ক্যাপ্টেনদের সঙ্গে মেশার পর হয়ে যায় ‘শামসুদ্দিন খান’! রুবেলদের প্রতিবেশী কাম বন্ধু এক হিন্দু পরিবার (অশোক ব্যাপারি, শিল্পী সরকার অপু ও তাদের পুত্রবধু জ্যোতিকা জ্যোতি) এর ওপর নজর পড়ে শামসু চোরার। তাদের ইন্ধনে জ্যোতিকা জ্যোতির ঠাঁই হয় পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে, আর আশোক ও শিল্পী সরকারকে পুড়িয়ে মারে শামসু চোরা। তাদের ভিটার ওপর ওড়ানো হয় পাকিস্তানি পতাকা আর গড়ে তোলা হয় রাজাকার ক্যাম্প। আহমেদ রুবেল এই মানুষ পোড়ানোর দৃশ্য দেখে পাগল হয় যায়, জয় বাংলার ঘোর তবু তার কাটে না।

শেষে মোরগ লড়াইয়ের দৃশ্যের পর বুদ্ধ পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের গুলিতে নিহত হলে দা দিয়ে তাকে কুপিয়ে মারে পদ্ম ওরফে ভাবনা।

রাষ্ট্রীয় অনুদানে নির্মিত এই সিনেমার কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৫-১৬ সালে। চিত্রনাট্য ও পরিচালনা করেছেন গুণী ও খ্যাতিমান পরিচালক নুরুল আলম আতিক। সংলাপ লিখেছেন মাতিয়া বানু শুকু। ছবির শুটিং হয়েছে কুষ্টিয়া, টাঙ্গাইল ও গৌরীপুরে।

২০১৬ সালের পর প্রায় দু-বছর শুটিং বন্ধ ছিল। ২০২১ এর মার্চে মুক্তি দেওয়ার কথা থাকলেও এটা মুক্তি পায় ২০২১ এর ১০ ডিসেম্বর।

সৈয়দপুর বিমানবন্দরের রানওয়ের আশপাশে শৈশব কেটেছে নুরুল আলম আতিকের। পরিবারের কাছ থেকে শোনা গল্পের সঙ্গে তথ্য মেলাতে সাহায্য নিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক লেফটেনন্যান্ট কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীক এবং মুক্তিযোদ্ধা নাট্যজন নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুর।

ছবি ও ক্যামেরার ভাষা অসাধারণ। প্রান্তিক মানুষের বেদনা, টেনশান আর যুদ্ধকে ঘিরে তাদের বাঁচার আকুতি সার্থক ভাবে ফুটে উঠেছে ছবিতে। পাকিস্তানি ক্যাম্পে বন্দি অবস্থার নাচ, শিং মাছের ছটফটানি, গাছের কাণ্ডে পরগাছা সহ সব মেটাফোর আর থিয়েট্রিকাল শটগুলো দুর্দান্ত। সিনেমাটিতে কোনো গান নেই।

ধরে নিলাম, সিনোমার সবচেয়ে দুর্বল দিক ‘বাজেট’। তারপরও শুটিং শুরু করে ফেলে রাখার একটা প্রভাব আছে ছবিতে। লাল মোরগ আছে ছবির শুরুতে গ্রাফিক্সে, সাদাকালো টোনের জন্য সারা ছবিতে মোরগের লাল ঝুটি খুঁজে পাওয়া যায়নি! সবচেয়ে দৃষ্টিকটূ ‘সাউন্ড’, যা কানে পীড়া দিতে পারে। পাশাপাশি চার পরিবার (রুবেল, অশোক, জয়রাজ ও আশীষ খন্দকার এর পরিবার) এর গল্পের ধারাবাহিকতা নেই, যেটা দিয়ে গল্পের পরিপূর্ণতা বুঝতে পারবে সাধারণ দর্শক। ছবিতে সবচেয়ে ‘বড়’ চরিত্র রুবেলের চরিত্রের কোনো ধারাবাহিকতা নেই। তার মনোজগত পরিবর্তনটা বাস্তব মনে হয়নি। অশোক ও শিল্পী সরকারকে পুড়িয়ে মারার দৃশ্যে তার অতিনাটকীয় অভিনয়, ঘোরের ভেতর জয়বাংলা বলা, মেজর যখন রুবেলের গলা বুট দিয়ে পাড়া দেয়, তখন রাজাকার জয়রাজের আকুতি ঠিক গল্পের সঙ্গে মেলে না।

ছবির শেষে মেজরকে পদ্মর (ভাবনার) কুপিয়ে মারার দৃশ্যও অতি নাটকীয় যা প্রচলিত ‘ফর্মুলা’ ফিল্মের গল্প মনে করিয়ে দেয়। পুরো ছবিতে গ্রাম বা বিমানবন্দর নির্মাণের বিশাল ক্যানভাস নেই, আছে কেমন একটা জনশূন্য অনুভূতি! আছে ছবি জুড়ে ‘নিরানন্দ’, যা ছবিকে দর্শক বিমুখ করতে পারে।

তবু নুরুল আলম আতিক এর ছবি নাড়া দিয়ে যায় হৃদয়কে। জয় হোক বাংলা ছবির।