‘ক্ষমা করো আব্বু, আমি হাবিব ওয়াহিদ হতে পারিনি!’

একাত্তরের কণ্ঠযোদ্ধা, গণসংগীত শিল্পী প্রয়াত ফকির আলমগীরকে উদ্দেশ করে লেখা এক চিঠিতে বাবার অপূর্ণ স্বপ্ন, বাবার জন্য হৃদয়ের শূন্যতা, মর্মবেদনা আর আকুতি তুলে ধরেছেন ছেলে ফকির মাশুক আলমগীর রাজীব।

গ্লিটজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Sept 2021, 09:14 AM
Updated : 11 Sept 2021, 09:47 AM

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ২৩ জুলাই মারা গেছেন ফকির আলমগীর।

ব্যক্তিজীবনে আড্ডাপ্রিয় এ শিল্পীকে পরিবারের সদস্যরা তো বটেই ‘ও সখিনা’ কিংবা ‘মায়ের একধার দুধের নাম’ গানগুলোর জন্য এ দেশের মানুষের কাছে অমর হয়ে আছেন তিনি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পাঠকদের জন্য রাজীবের লেখা চিঠি হুবহু তুলে ধরা হল-

প্রিয় আব্বু আমার,

আজ তুমি পাশে নেই। জানো, আমার এখনো বিশ্বাস হয় না। টগবগে তরুণদের মতই ছিল তোমার চলাফেরা, আত্মবিশ্বাস। তোমার তারুণ্য যে এমন হুট করে অস্ত যাবে, আমি বুঝতেই পারিনি। না না, ভুল ভাবছি। তোমার তারুণ্য কখনো অস্তমিত হতেই পারে না। তোমার সমস্ত তারুণ্যকে বাক্সবন্দি করে তুমি অন্য ভুবনে বেড়াতে গেছো। সেই অন্য ভুবনে তুমি নিশ্চয়ই হারমোনিয়াম নিয়ে বসে এখন গান গাইছো! নিশ্চয়ই সকলকে মাতিয়ে রাখছো তোমার দরাজ কণ্ঠে!

তুমি যেই ভুবনে আছো, সেখান থেকে তুমি ফোন করতে পারছো না কেন? জানো, কিছুতেই বিশ্বাস হয় না তুমি আর উইকিপিডিয়া থেকে কারও তথ্যের জন্য কখনো ফোন করবে না! মনে হচ্ছে, তুমি বোধহয় বিদেশে কোনো কনসার্টে গিয়েছ। কনসার্ট শেষেই তুমি ফিরে আসবে। ফিরে এসে গল্প শোনাবে, তোমার অভিজ্ঞতার গল্প। তুমি যখন গল্প শোনাতে বসতে, তোমার উচ্ছ্বাস, আগ্রহ দেখে মনে হত, তুমি এক ছোট্ট বালক। রাজ্যের বিস্ময় চোখে নিয়ে তুমি গল্প বলতে। এই বয়সেও মানুষ দেখে তুমি বিস্মিত হতে। কেন বিস্মিত হতে? তুমি কি তবে মানুষের ভেতরের মানুষকে দেখতে পেতে তোমার অন্তর্চক্ষু দিয়ে? এই যে এত এত প্রশ্ন করছি, তুমি উত্তর দেবে না? কথার ফুলঝুড়ি ছোটাবে না? আকাশের ঠিকানা থেকে চিঠির উত্তর দেওয়া যায় না কেন আব্বু? নাকি তুমি ঠিকই উত্তর দিচ্ছো? আমি কেবল শুনতে পাচ্ছি না!

আজ খুব মনে পড়ছে, তুমি সিভি বানিয়ে দিতে বললে, কতোই না বিরক্ত হতাম! আমি যখন ছোট ছিলাম, কতো কিছুই তো বুঝতাম না। তুমি তো বিরক্ত হতে না কখনো। তুমিই তো হাত ধরে হাঁটতে শিখিয়েছিলে। কই কখনো তো বিরক্ত হতে না। তবে আমি কেন বিরক্ত হতাম? তবে কি তোমার মতন আকশ সমান ধৈর্য নিয়ে বড় হতে পারিনি? নাকি বাবারা এমনই হয়! ধৈর্যের সমুদ্র!

তোমাকে আমি তোমার প্রত্যাশা অনুযায়ী ভালোবাসতে পারিনি। তোমার কি প্রত্যাশা ছিল কখনো? বাবাদের কি প্রত্যাশা থাকে? নাকি বাবারা কেবল দিয়েই যায় শুধু দু’হাত ভরে! ভালোবাসার বিনিময়ে কেবল দুঃখই দিয়ে গেছি তোমাকে। এইজন্য বৃদ্ধ বয়সে আমাদের কারও বোঝা হতে চাওনি তুমি। জীবনের সমুদ্র তুমি একা একাই পার হয়েছো আব্বু। একা একাই যুদ্ধ করেছিলে, একা একা প্রতিষ্ঠিত হয়েছ। পরিবারের কারও সাহায্য নাওনি। তুমি কেবল দিয়েই গেছো। নাওনি কিছুই কখনো। এমনকি বিদায়বেলাতেও পরিবারের কারও সাহায্য ছাড়াই, আইসিইউ থেকে চিরবিদায় নিলে। অনন্তের পথে যাবার মুহূর্তে, জীবনের শেষ সময়েও তোমার খেদমত করার সুযোগ দিলে না!

তুমি যখন গান গাইতে, তোমার গানের সঙ্গে গিটার বাজালে, তুমি ভীষণ খুশি হতে। প্রতিটি অনুষ্ঠানে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে তোমার ছেলে হিসেবে। বাবারা এমনই হয়, তাই না? বাইরে কোথাও গেলে, কোনো পাঁচ তারকা হোটেলে গেলে, তুমি হিসেব করে খরচ করতে। জমিয়ে রাখতে আমাদের জন্য, যেন তোমার সন্তানেরা ভালো থাকতে পারে, এসির নিচে ঘুমাতে পারে। তোমার সন্তানেরা যেন ভালো রেজাল্ট করতে পারে, তার জন্য আমাদের যা কিছু প্রয়োজন, তার সমস্তকিছু তুমি দিয়েছিলে আমাদের।

আমি তোমার জীবনে হাবিব ওয়াহিদ হতে পারলাম না। তোমার সঙ্গে মঞ্চ মাতাতে পারলাম না। তোমার উত্তরসূরি হয়ে সঙ্গীতের হাল ধরতে পারলাম না। জানি না তোমার গানগুলো আমার কণ্ঠে কখনো উঠবে কি না। আমার পেশাগত ব্যস্ততা আমাকে কখনো অনুমতি দিবে কি না! তুমি খুব করে চাইতে আমি যেন তোমার গান আমার কণ্ঠে ধারণ করি। কিন্তু তুমি তো জানোই আব্বু, এক জীবনে যে সব ইচ্ছা পূরণ করা হয়ে ওঠে না। সবকিছু বুঝেও তুমি অভিমান করতে। সবচেয়ে ভালোবাসতে বলেই অভিমান করতে। যেখানে আকাশ সমান ভালোবাসা থাকে, সেখানে সমুদ্র সমান অভিমান থাকা অসম্ভব কিছু না। এমন অভিমানেই, জীবনের শেষ কয়েক বছরে আমার প্রতি তোমার প্রত্যাশা ছিলো শূন্যের কোঠায়। তুমি বুঝে গেছিলে, গান-বাজনা হবে না আমাকে দিয়ে!

তোমার প্রতি আমি খেয়াল রাখিনি। নিজ পরিবার আর পেশা নিয়ে স্বার্থপরের মতন চিন্তা করেছি। আত্মকেন্দ্রিকতা পেয়ে বসেছিল আমাকে। তোমার মনের খোঁজটুকু পর্যন্ত রাখতে পারিনি। কেবল আর্থিক সমস্যায় পড়লে কোনোকিছু না ভেবেই তোমার কাছে যেতাম। এই বয়সেও তোমার কাছে পয়সা-কড়ি চাইতে যেতে কোনো সঙ্কোচ হতো না আমার; যেমন সঙ্কোচ হতো না ছেলেবেলায় চকলেট, আইসক্রিম কিংবা খেলনাগাড়ি চাইতে। আমি বড্ড বেহিসেবী। এ নিয়ে আমার প্রতি রাগের অন্ত ছিল না তোমার। বেহিসেবি আমাকে সোজা করে ধরে রাখতে তুমি; শুধুই তুমি।

সমস্ত শৈশব তোমার কাঁধে চড়ে ঘুরে বেড়িয়েছি। অথচ যাবার বেলায় তোমার বুকে একটু মাথা রাখতে পারিনি। প্রতিদিন অফিস যাবার সময়, তুমি আমার কানে কানে দোয়া পড়ে চুমু খেতে। তোমার এই দোয়াই জীবনে সফল হতে আমাকে সাহায্য করেছে। কারণ বাবা-মার দোয়া নাকি স্বয়ং আল্লাহ তা’য়ালা ফিরিয়ে দেন না।

আজ বাসায় সবাই আছে, সবই আছে। কেবল তুমি নেই। নেই তোমার চিরচেনা তেজদ্বীপ্ত কন্ঠস্বর। তুমি এখন আর দরাজ গলায় বলো না, ‘এই রহমান (ড্রাইভার)! গাড়ি বাহির করো।’ তোমার চেয়ার টেবিল পড়ে আছে আব্বু। জায়নামাযটাও সেই একই জায়গায় আছে। কিন্তু তুমি নেই আব্বু। কোথাও তুমি নেই। নাকি তুমি ঠিক আছো? আমি তোমায় দেখতে পাচ্ছি না! তুমি কি দেখতে পাচ্ছো আব্বু? তুমি কি দেখছো আমি তোমাকে চিঠি লিখছি? তুমি কি দেখছো, তোমার কথা মনে পড়তেই আমার চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে? তুমি তবে ঝাপসা চোখ মোছাতে ফিরে আসছো না কেন আব্বু? নাকি তুমি পরীক্ষা নিচ্ছো? তোমায় ছাড়া আমরা কেমন করে বাঁচি, সেই পরীক্ষা!

আব্বু, তোমার লেখার টেবিলে তোমার তিন ছেলের মধ্যে শুধু আমার গ্র্যাজুয়েশানের ছবিটি বহাল তবিয়তে রেখে দিয়েছো। নীরবে আমাকে এতো ভালোবাসতে তুমি! কখনো মুখ ফুটে বলতে না। বলতে, ‘তুই এতো বুঝিস, তুই-ই বল কাকে বেশি ভালোবাসি?’ আকশের ঠিকানায় চলে গিয়ে তুমি কি এখন আমার ভালোবাসার পরীক্ষা নিচ্ছো? দূর আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারকা হয়ে তুমি কি দেখছো আমি কীভাবে বেঁচে আছি?

জীবনের শেষ একটি মাস, পারিবারিক কিছু দুর্ঘটনার জন্য তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি আমি। এইজন্য আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার শেষ নেই আমার। কবরে শোয়ানো পর্যন্ত শুধু ক্ষমাই প্রার্থনা করেছি তোমার কাছে। এখনো রোজ ক্ষমা চাই। আমার মৃত্যু অবধি ক্ষমা চেয়েই যাবো। জানি না, মহান প্রভু আল্লাহ তা’আলা আমাকে ক্ষমা করবেন কি করবে না; কিন্তু তুমি যে ক্ষমা করেছো তা আমি ঠিকই জানি। তুমি তো ছিলে ক্ষমার মতই বড়, ক্ষমার মতই মহান।

তুমি আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতে। তোমার গোটা পৃথিবী ছিলো একদিকে, আর আমি ছিলাম অন্যদিকে। আমাকে তুমি বিদেশে পড়িয়েছিলে, যেন উন্নত শিক্ষালাভ শেষে দেশে ফিরে এসে, তোমার নিজ হাতে স্বাধীন করা দেশকে আরও ভালো রাখতে পারি। দেশকে যেনো শিক্ষায় এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি। তুমি মাঝেমধ্যে চাইতে, আমরা সবাই মিলে বিদেশে অবসর যাপন করতে যাবো। তোমার এই সামান্য ইচ্ছেটুকুও আমি পূরণ করতে পারিনি।

ব্যক্তিজীবনে সফল হলেও, পুত্র হিসেবে আমি ব্যর্থ। সবদিক দিয়ে ব্যর্থ। তবে তোমার ব্যর্থ ছেলে তোমাকে কথা দিচ্ছে, আম্মুকে খুব ভালো রাখবো আমি। তোমার মতো করে ভালো রাখতে পারবো কি না জানি না। তবে আমার সবটুকু সামর্থ্য দিয়ে আমি চেষ্টা করে যাবো।

জন্ম-জন্মান্তর বলে কিছু আছে কি না জানি না। যদি থাকে, তবে পরের জন্মে আমি তোমাকেই আমার বাবা হিসেবে চাই। সেখানে আমরা স্বপ্নের রাজ-প্রাসাদ বানাবো। বাপ-বেটা (ওয়াহিদ পরিবারের মতন) কনসার্ট করবো। যদি পরজন্ম বলে সত্যিই কিছু থাকে, তবে সেই জন্মে  আমি তোমার সব সুপ্তবাসনা পূর্ণ করবো। তুমি শুধু আমার আব্বু হয়ে জন্ম নিও। তোমার কাছে এটুকুই আমার চাওয়া, আমার প্রার্থনা, আমার মিনতি, আমার ফরিয়াদ।

এই জন্মে তুমি আমায় ক্ষমা করো, আব্বু!

ইতি,

তোমার মেজ ছেলে।