বিরূপ পরিস্থিতিতে যেভাবে সৃষ্টি হল ‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই’

আশির দশকের শেষভাগে সামরিক শাসনামলে যখন বেতার-টিভিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম নিলে রাজনৈতিক নেতাদেরও রোষানলে পড়তে হত, সেই চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে সুরকার মলয় কুমার গাঙ্গুলী ও গীতিকার হাসান মতিউর রহমানের হাত ধরে সৃষ্টি হল ‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই ...’ গানটি।

সাইমুম সাদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 August 2021, 02:09 AM
Updated : 15 August 2021, 05:52 AM

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে গানের দুই স্রষ্টা জানালেন ১৯৮৯ সালের দিকে রচিত এ গানের পটভূমি, সুর করার পর রেকর্ডিং নিয়ে নানা চড়াই-উৎরাই এবং গানটি প্রকাশের পর সুরকারের জীবনে নেমে আসা নিপীড়নের কথা।

গানটি নিয়ে কথা বলেছেন শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিনও; মলয় কুমার গাঙ্গুলী প্রথমে গাওয়ার পর নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝির দিকে সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে গানটি মানুষের মুখ থেকে মুখে ছড়িয়েছে।

গানের পটভূমি নিয়ে বঙ্গবন্ধুভক্ত মলয় কুমার গাঙ্গুলী জানান, পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের যাতনা থেকেই তিনি এমন একটি গান করার পরিকল্পনা করেন।

তখন তিনি মতিঝিলের গভর্নমেন্ট কলোনিতে থাকতেন। সেই সময়ের জনপ্রিয় গীতিকার হাসান মতিউর রহমানকে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এ গান লেখার প্রস্তাব দেন, গানের কথায় কোন পরিস্থিতি তুলে আনতে হবে সেই ধারণাও দেন এ সুরকার।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গান লেখার প্রস্তাব পাওয়ার পর হাসান মতিউর রহমান ভেবেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর মতো এত বড় মাপের একজন নেতাকে নিয়ে গান লেখা সহজ কথা না। সংশয় ঝেড়ে গানটি লিখে মলয় কুমার গাঙ্গুলীকে দিলে তিনি প্রশংসা করেন, সুরও করে ফেলেন।

ততদিনে গীতিকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন হাসান মতিউর; তার লেখা গান কণ্ঠে তুলে আলোচনায় এসেছিলেন দিলরুবা খান, মুজিব পরদেশী। তবে জাতির পিতাকে নিয়ে এটিই ছিল তার লেখা প্রথম গান।

৭৬ বছর বয়সী শিল্পী ও সুরকার মলয় কুমার গাঙ্গুলীর ভাষ্যে, “তখনকার পরিস্থিতি ছিল এমন যে, আওয়ামী লীগের কথা বলা যাবে না, বললেই বিপদ। রাজনৈতিক নেতারাও কথা বলতে সাহস পেতেন না। ওই সিচুয়েশনে আমরা গানটা করেছি।”

সেই পরিস্থিতির কথা উঠে এল হাসান মতিউর রহমানের বক্তব্যেও, “তখন রেডিও-টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সাবলীলভাবে কোনো কাজ করা সম্ভবপর ছিল না। বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করা যেত না। খুব চাপ ছিল।”

মলয় কুমার জানান, গানে বঙ্গবন্ধুর কথা থাকায় সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসনামলে রাষ্ট্রীয় বাহিনির নির্যাতনের ভয়ে ঢাকার কোনো স্টুডিওই গানটি রেকর্ড করতে চায়নি। পরে ফ্রান্সে গিয়ে নিজের সুরে নিজের কণ্ঠেই গানটি রেকর্ড করেন মলয় কুমার গাঙ্গুলী।

“রেকর্ডিংয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা হয়েছে, গানটি শুনে তার চোখের পানি পড়েছে। উনি আমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। বলেছিলেন, ‘খুবই ভালো হয়েছে’। পরে বহুবার বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে; গানটি পরিবেশন করেছি। জনগণ গানটি নিয়েছে; এটাই আমার স্বার্থকতা।”

বাঁ থেকে: মলয় কুমার গাঙ্গুলী, হাসান মতিউর রহমান ও সাবিনা ইয়াসমিন

পরবর্তীতে শাসকদের রোষাগ্নির মুখেও পড়েছিলেন বলে জানিয়ে মলয় কুমার গাঙ্গুলী বলেন, “আমার উপর নিয়ে অনেক ঝড় গেছে। আমাকে কোয়ার্টার ছাড়তে হল। চাকরিও গেল সেই গানটার জন্য।

“প্রেস ক্লাবের সামনে জনতার মঞ্চ আমার গান দিয়ে ওপেন হয়েছিল। সেখানে শেখ হাসিনা ছিলেন, তার পাশেই আমি ছিলাম। ওই সময় পুলিশ সতর্ক করেছিল, ‘দাদা, আমরা কিন্তু বাধ্য হচ্ছি; বাসায় থাকবেন না’। আমাকে পালিয়ে থাকতে হয়েছিল।”

নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রচারণার জন্য হাসান মতিউর রহমানের অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান চেনা সুর থেকে মলয় কুমার গাঙ্গুলীর কণ্ঠে ‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই’সহ কয়েকটি গান নিয়ে একটি ক্যাসেট প্রকাশের পর গানটি ছড়িয়ে যায়।

সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরেছিল। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগে ক্ষমতায় আসার শেখ হাসিনার পরামর্শে শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন দিয়ে গানটি গাওয়ানো হয় বলে জানান হাসান মতিউর রহমান। গানের সংগীতায়োজন করেন প্রয়াত সুরকার ফরিদ আহমেদ।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গানটি গাইতে পেরে গর্ববোধ করেন সাবিনা ইয়াসমিন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গানটি রেকর্ডিংয়ে পর বিটিভিতে চালানোর পর পুরো বাংলাদেশে ছড়িয়ে গেল। আমার খুব ভালো লাগল। এমন সুন্দর একটি গান গাইতে পেরেছি বলে আমি গর্ববোধ করি।”

“গানটি শুনে অনেকে কেঁদে ফেলেন। চীন-মৈত্রী (বঙ্গবন্ধু) সম্মেলন কেন্দ্রে একবার গানটি গাইছিলাম, এক দর্শক কেঁদে ফেলেছিলেন। পরে তাকে ডেকে বললাম, আপনার কান্না দেখে আমারও গলা ধরে আসছে। গাইতেই পারছি না। গানটি নিয়ে এমন অনেক স্মৃতি আছে,” বলেন সাবিনা।