নিজের জন্য নয়, অন্যকে নিয়ে ভালোভাবে বেঁচে থাকাই আনন্দ: রামেন্দু মজুমদার

মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করতে না পারলে সেই জীবনকে অর্থহীন বলে বিশ্বাস করেন একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার; ৮০ পেরিয়ে ৮১ বছরে পা দিয়ে তিনি বলছেন, বাকিটা জীবন যতটা সম্ভব মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রাখবেন তিনি।

সাইমুম সাদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 August 2021, 03:31 PM
Updated : 9 August 2021, 03:31 PM

সোমবার নিজের জন্মদিনে গ্লিটজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জীবন ভাবনা, করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মঞ্চনাটকের সঙ্কট ও আগামীর পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন এ অভিনেতা, মঞ্চ নির্দেশক ও নির্মাতা।

সদ্য আশি পেরোনো এ নির্দেশকের ভাষ্যে, মানুষের জীবন একটাই। সুতরাং এটাকে যতটা সম্ভব উপভোগ করা ও কাজে লাগানো উচিত।

“আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, যদি মানুষের কল্যাণ না করি তাহলে জীবন অর্থহীন। নিজের জন্য বেঁচে থাকার মধ্যে কোনো আনন্দ নেই। অন্যকে নিয়ে ভালোভাবে বেঁচে থাকাই হচ্ছে আসল আনন্দ।

“সমাজের জন্য কিংবা আশেপাশের মানুষের জন্য কী করতে পারলাম-সেটাই হচ্ছে আসল তৃপ্তি। আমি কত টাকা-পয়সা করলাম, বাড়ি-ঘর করলাম-এটা আমার কাছে কাছে খুবই অর্থহীন মনে হয়। আমি চাই, আমি সচ্ছল জীবনযাপন করব কিন্তু তার বাইরে আমি চাইব, মানুষের যতটা সম্ভব কল্যাণ করা যায়।”

পঞ্চাশের দশক থেকে মঞ্চনাটকে অভিনয় ও নির্দেশনায় যুক্ত রামেন্দু মজুমদারকে ঢাকার মঞ্চনাটক আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ বলা হয়।

পাঁচ দশক ধরে নাট্যবিষয়ক পত্রিকা ‘থিয়েটার’ সম্পাদনা করছেন তিনি। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে নাট্যকার আবদুল্লাহ আল মামুন নাটকের দল থিয়েটার গঠন করলে তার অগ্রভাগে ছিলেন রামেন্দু মজুমদার।

বাংলাদেশের নাটককে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন রামেন্দু মজুমদার। তিনি ১৯৮২ সালে ‘ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট- আইটিআই এর বাংলাদেশ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। এখন তিনি এই সংগঠনের সাম্মানিক সভাপতি।

বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান রামেন্দু মজুমদার সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন। তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পরিষদ সদস্য এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য।

নাট্যচর্চায় অবদানের জন্য তিনি ২০০৯ সালে একুশে পদক পান।

তার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হিসেবে মানুষের ভালোবাসাকেই স্মরণ করলেন রামেন্দু মজুমদার।

“আমি যথেষ্ট সম্মান পেয়েছি। আমার যে যোগ্যতা ও ক্ষমতা তার চেয়েও বেশি প্রাপ্তিযোগ হয়েছে। থিয়েটারের কথা যদি বলি, আমি সাংগঠনিক কাজে বেশি মনোযোগ দিয়েছি। সেখানে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটের সভাপতি হয়েছি। যেটা কোনো দিন কল্পনাও করিনি। তারপর আরেকটা তৃপ্তির জায়গা হল ‘থিয়েটার’ পত্রিকা। ৫০ বছর ধরে কাজটা করছি। এটা বড় গর্বের জায়গা আমার।”

থিয়েটারের সঙ্গে জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটানো এ নির্দেশক আগামীতে একটি থিয়েটার স্কুল তৈরি স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে চলেছেন।

“থিয়েটার স্কুল করতে চাই, সেখানে আলাদা স্টুডিও থিয়েটার স্থাপন করতে চাই। এটা অতৃপ্ত বাসনা আছে। সেটা যদি করতে পারি তাহলে আর আমার জীবনের কোনো আকাঙ্ক্ষা থাকবে না।

“জমি পাওয়াটা খুব কঠিন। আমি টাকা-পয়সার ব্যবস্থা করতে পারব। কিন্তু জমিটা পাওয়ার খুব কঠিন, সেটা যদি সরকারিভাবে না দেওয়া হয় তাহলে কঠিন হবে। বিষয়টি নিয়ে চেষ্টা করছি।”

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে প্রায় দুই বছর ধরে দেশের নাট্যাঙ্গন কার্যত স্থবির হয়ে গেছে। পরিস্থিতি কাটলেরও পুরানো ছন্দে মঞ্চে নাটক ফেরাটা বেশ কঠিন হবে বলে মনে করেন রামেন্দু মজুমদার।

“আগামী দিন খুব কঠিন হবে। সবচেয়ে বড় কথা পৃথিবীই আগের মতো আর ফিরবে না। নাটকের ক্ষেত্রে যদি বলি, মঞ্চে দর্শক ফিরিয়ে আনা ও দলগুলোকে সংগঠিত করা খুব কঠিন হবে। সবমিলিয়ে এটা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করি।

“আগের মতো সবাই নাটকে সময় দিতে পারবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবে আমি মনে করি, সবাই যদি ইচ্ছা নিয়ে এগোতে থাকে তাহলে আবার ফিরবে।”

তিনি জানান, মহামারীর দেড় বছরে তিনি আইটিআইয়ের সঙ্গে চল্লিশ বছরের অধ্যায় নিয়ে ‘মাই লাইফ ইন আইটিআই’ নামে একটি বই রচনা করেছেন। মাস খানেকের মধ্যেই সেটি প্রকাশ হবে।

মঞ্চের পাশাপাশি তিনি টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন রামেন্দু মজুমদার।

তার জন্ম ১৯৪১ সালের ৯ অগাস্ট লক্ষ্মীপুরে। তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর শেষ করে শিক্ষকতাকে বেছে নিয়েছিলেন পেশা হিসেবে। পরে তিনি যোগ দেন বিজ্ঞাপন শিল্পে।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের কয়েকটি অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া এই অভিনয় শিল্পী ১৯৭২ সালে বিটপী অ্যাডভার্টাইজিংয়ে পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। পরে ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বিজ্ঞাপনী সংস্থা এক্সপ্রেশানস। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই তিনি টিভি নাটকে ছিলেন নিয়মিত।

১৯৭০ সালে অভিনেত্রী ফেরদৌসী সঙ্গে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। তাদের একমাত্র মেয়ে ত্রপা মজুমদারও একজন অভিনেত্রী ও নির্মাতা।