ডাবিংয়ের সিস্টেম ছিল না, টেপ রেকর্ডারে ‘মুখ ও মুখোশ’র শব্দধারণ করা হয়েছিল: ফজলে হক
সাইমুম সাদ, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published: 03 Aug 2021 05:39 PM BdST Updated: 03 Aug 2021 05:39 PM BdST
বাংলাদেশের প্রথম বাংলা সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’র মুক্তির ৬৫ বছর পূর্তিতে এতে কাজের অভিজ্ঞতা জানালেন সেই সিনেমার চিত্রসম্পাদকের সহকারী ফজলে হক; পরবর্তীতে যিনি চিত্রসম্পাদকের পাশাপাশি চিত্রপরিচালক হিসেবেও পরিচিতি পান।
আবদুল জব্বার খান পরিচালিত ‘মুখ ও মুখোশ’ মুক্তি পায় ১৯৫৬ সালের ৩ অগাস্ট। এর আগে এই ভূখণ্ডে বাংলা ভাষায় আর কোনো পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক চলচ্চিত্র হয়নি।
পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাঙালিদের ক্ষোভ তখন ধীরে ধীরে বাড়ছিলো। তখনকার পাকিস্তানি চলচ্চিত্র শিল্পে বাঙালি টেকনিশিয়ান ও কর্মীরাও হতাশ হয়ে পড়েছিলেন, দেশভাগের কারণে বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল কলকাতা, সিনেমা নির্মাণে তারা এগিয়ে যাচ্ছিল।
সেই প্রেক্ষাপটেই যাত্রা শুরু বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের। বাংলা ভাষায় সিনেমা বানানোর জন্যই ইকবাল ফিল্মসের প্রযোজনায় ১৯৫৩ সালে ‘মুখ ও মুখোশ’ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ১৯৫৫ সালের ৩০ অক্টোবর সিনেমার দৃশ্যধারণ শেষ হওয়ার পর ঢাকায় কোনো স্টুডিও না থাকায় শুটিং পরবর্তী কাজ পাকিস্তানের লাহোরে করেছিলেন পরিচালক জব্বার খান।
১৯৫৫ সালে লাহোরের জ্যেষ্ঠ চিত্রসম্পাদকদের একজন আব্দুল লতিফ সিনেমাটি সম্পাদনা করেছেন; লতিফের প্রধান সহকারী আবু দাউদ খানের ব্যস্ততার কারণে তা জায়গায় মুখ ও মুখোশ সিনেমায় কাজের সুযোগ পান ১৫ বছর বয়সী ফজলে হক। একজন শিক্ষানবীশ কর্মী হিসেবে মুখ ও মুখোশের নেগেটিভ কর্তনের দায়িত্ব সামলেছিলেন তিনি।
সাক্ষাৎকারে ফজলে হক বলেন, “ক্যামেরা রিপোর্ট থেকে ফিল্মের সর্টিং করে লাইন আপ করে প্রিন্ট করতাম। ওই সময় ডাবিং সিস্টেম ছিল না। টেপ রেকর্ডার দিয়ে সরাসরি সাউন্ড রেকর্ড করা হত। প্রচুর নয়েজ ছিল, ট্রাকের শব্দসহ চারপাশের অতিরিক্ত শব্দধারণ এসে গিয়েছিল। …সেই সময় তাদের অভিজ্ঞতা ছিল না। ফলে পারিপার্শ্বিক শব্দগুলো বেশি এসে গিয়েছিল।
“ওটাকে ঠিক করতে গিয়ে ডায়লগ ছাড়া বাকি যতগুলো অংশগুলো কেটে কেটে সাইলেন্স সাউন্ড ট্রাক (এসএসটি) জোড়া দেওয়া হয়েছিল। এইসব কাজ জুনিয়র হিসেবে আমাদের করতে হত।”
১৯৪৩ সালে ব্রিটিশ ভারতের হরিয়ানার আমবালায় জন্ম নেওয়া ফজলে হক ১৯৬৩ সালে ঢাকার এসে বাংলা চলচ্চিত্রের প্রতি ভালোলাগার টানে পরে আর লাহোরে না ফিরে ঢাকায় থিতু হয়েছেন তিনি। ঢাকায় পরিচালক সালাউদ্দিনের সহকারী হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন ফজলে; চিত্রপরিচালনায়ও যুক্ত ছিলেন তিনি।
“আমি যখন ঢাকায় আসি তখন লাহোরের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে সাকুল্যে দুইজন এম এ পাশ লোক ছিল। ঢাকায় যখন কাজ করি তখন দেখলাম, এখানে প্রচুর এম এ পাস মানুষ কাজ করছেন। আব্দুল জব্বার খান, সালাউদ্দিন সাহেব কলেজের প্রফেসর ছিলেন, রকিবউদ্দিন সাহেব, ওবায়দুল হক, মহিউদ্দিন, জহির রায়হান, এহতেশাম, খান আতাউর রহমান-এরা সবাই এক একটা জায়ান্ট। একেকজন একেকটা ইনস্টিটিউট।
“তাদের সঙ্গে কথা বললে মনে হচ্ছে, তাদের কাছে সিনেমার ক্লাস করছি। জায়গাটা এত বেশি ভালো লাগল, পরে লাহোরে আর ফেরত গেলাম না। ঢাকায় থেকে গেলাম।”
১৯৬৪ সালে উর্দু সিনেমা ‘মালন’ এর মধ্য দিয়ে চিত্রসম্পাদক হিসেবে অভিষেকের পর ঢাকার সর্বাধিক ব্যবসাসফল সিনেমা ‘বেদের মেয়ে জোসনা’সহ ‘নিশান’, ‘নিষ্পাপ’, ‘বউ মা’র মতো সিনেমার চিত্রসম্পাদনা করেছেন তিনি।
১৯৫৬ সালের অগাস্টে পূর্ব পাকিস্তানের তখনকার গভর্নর শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে ‘মুখ ও মুখোশ’ সিনেমার উদ্বোধন করেছিলেন। ছবিটি মুক্তির পর দেশজুড়ে হইচই পড়ে যায়।

“সেটা এখন দেখা যায় না। কারণ সিনেপ্লেক্সগুলো এতো ব্যয়বহুল হয়ে গেছে যেখানে কোনো মিডলক্লাস পরিবারের লোক পরিবারের সঙ্গে মাসে একবার সিনেমা দেখার কথা চিন্তাই করতে পারেন না। দ্বিতীয়ত রাত ১২টা-১টায় পরিবার নিয়ে যাওয়া-আসা নিরাপদ মনে করে না। ফলে সিনেমা থেকে নারী দর্শকদের আমরা হারিয়ে ফেলেছি।”
পত্রিকায় প্রকাশিত একটি ডাকাতির খবরকে উপজীব্য করে ‘ডাকাত’ নামে একটি নাটক লিখেছিলেন আবদুল জব্বার খান। সেই কাহিনীকেই ‘মুখ ও মুখোশ’ চলচ্চিত্রে রূপ দেন তিনি।
সিনেমার চিত্রনাট্য ছিল এরকম- গ্রামের এক জোতদারের দুই ছেলে। তাদের একজন ঘটনা-পরম্পরায় ডাকাতদলের খপ্পরে পড়ে। তাদের সঙ্গেই বেড়ে ওঠে। আরেক ছেলে পড়ালেখা করে, পুলিশ হয়।
কিন্তু ডাকাতদলের সঙ্গে অসৎ পুলিশের যোগাযোগ ছিল। পরিচয় না জানলেও ডাকাত-পুলিশ যোগাযোগের সূত্রে ভাই-ভাই যোগাযোগ তৈরি হয়। এক পর্যায়ে ডাকাত ভাই তার সর্দারকে খুন করে। অসৎ পুলিশ ভাই গ্রেপ্তার হয়। কাহিনী শেষ হয় জোতদার বাবার দুই ছেলেকে ফিরে পাওয়ার মধ্য দিয়ে।
কিন্তু পঞ্চাশের দশকে মঞ্চ নাটকে অভিনয়ের জন্যও নারী শিল্পী পাওয়া ছিল কঠিন। পরিচালক আব্দুল জব্বার শুরুতে ভেবেছিলেন, কোনো পুরুষকেই নারী সাজিয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড় করিয়ে দেবেন। তখন মঞ্চ নাটকে নারী চরিত্রে পুরুষদের অভিনয়ের চল ছিল।
পরে মুখ ও মুখোশের অভিনেত্রী খুঁজতে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেন আবদুল জব্বার খান। চিত্রালী ম্যাগাজিনে সেই বিজ্ঞাপন দেখেই নায়িকা কুলসুমের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য এগিয়ে এলেন চট্টগ্রামের মেয়ে কলকাতার অভিনেত্রী পূর্ণিমা সেনগুপ্ত। নায়ক আফজালের চরিত্রে আব্দুল জব্বার খান নিজেই অভিনয় করেন। পিয়ারী অভিনয় করেন নায়ক আফজালের বোন রাশিদার চরিত্রে।
অসৎ পুলিশ কর্মকর্তার চরিত্রে ছিলেন অভিনেতা আলী মনসুর। তার স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করেন জহরত আরা। ডাকাতসর্দারের ভূমিকায় ছিলেন ইনাম আহমেদ।
১৯৫৪ সালে ৬ অগাস্ট শাহবাগ হোটেলে মুখ ও মুখোশ সিনেমার মহরত হয়।
কালীগঞ্জ, সিদ্ধেশ্বরী, কমলাপুর (বাসাবো) বৌদ্ধ বিহারের পুকুরপাড়, মিরপুর ও তেজগাঁওয়ের জঙ্গল, রাজারবাগ ও লালমাটিয়ার ধান ক্ষেত এবং টঙ্গীতে সিনেমার শুটিং হয়।
সর্বাধিক পঠিত
- সাঁতরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কী কথা বললেন তরুণী?
- প্রথম টোল দিয়ে বাইক নিয়ে পদ্মা সেতু পার হলেন যিনি
- পুলিশের সামনে শিক্ষকের গলায় জুতার মালা: চলছে প্রতিবাদ
- পদ্মা সেতু দিয়ে গাবতলীর বাস কবে চলবে?
- প্রাথমিকে ছুটি ২৮ জুন থেকে, মাধ্যমিকে ৩ জুলাই
- উৎসবের মাহেন্দ্রক্ষণে মেয়ের সঙ্গে ফ্রেমবন্দি প্রধানমন্ত্রী
- দৌড়েই পদ্মা সেতুতে উঠে পড়লেন তারা
- পাকিস্তানের শেহজাদের অদ্ভুত দাবি
- টোল দিয়ে পদ্মা সেতুর প্রথম যাত্রী শেখ হাসিনা
- রোববার থেকে পদ্মা সেতুতে যানবাহন চলাচল