মহামারী: রুপালি জগতের আলাউদ্দিনরা এখন ধূসর বাস্তবে

বছরের পর বছর ধুকতে থাকা ঢাকাই চলচ্চিত্রে কাজ কমে আসায় জীবিকার তাগিদে অভিনয়ের পাশাপাশি নৈশ প্রহরীর চাকরি নিয়ে টিকে থাকতে চেয়েছিলেন মোহাম্মদ আলাউদ্দিন; কিন্তু মহামারীর ধাক্কায় সেখানেও ঠিকমতো বেতন না পেয়ে এখন গ্রামে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছেন এই অভিনয়শিল্পী।

সাইমুম সাদ গ্লিটজ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 June 2021, 06:25 PM
Updated : 29 June 2021, 02:58 AM

চার দশকেরও বেশি সময় ধরে শতাধিক চলচ্চিত্রে বস্তিবাসী, রিকশাওয়ালা, বাড়ির চাকর, কুলি, ডাকপিয়ন, ভিক্ষুকের চরিত্রে অভিনয় করেছেন আলাউদ্দিন।

গুরুত্ব না থাকলেও প্রায় চলচ্চিত্রে এমন অভিনয়শিল্পীর প্রয়োজন হয়। এই ধরনের অভিনয়শিল্পীরা এফডিসিতে এক সময় ‘এক্সট্রা’ হিসেবে পরিচিতি ছিল। পরে তাদের ‘জুনিয়র আর্টিস্ট’ নাম দেওয়া হয়।

চলচ্চিত্রে অভিনয়ের স্বপ্ন নিয়ে ১০ বছর বয়সে ঝালকাঠি থেকে ‘স্বপ্নের’ এফডিসিতে আসেন আলাউদ্দিন; এফডিসির পুরানো গেইটের সামনে চা বিক্রি করতে করতে এক সময় অভিনয়ের সুযোগ পেযে যান।

সেই থেকে চলচ্চিত্রের প্রতি মায়ার টানে এফডিসিতেই ‘ঘর-সংসার’ পেতেছেন তিনি।

মাঝে চলচ্চিত্রে কাজ কমতে থাকায় বছর তিনেক আগে এফডিসির পাশেই একটি প্রতিষ্ঠানে নৈশ প্রহরীর চাকরি নিয়েছিলেন তিনি।

চলচ্চিত্রের অভিনয়শিল্পী মোহাম্মদ আলাউদ্দিন।

৫৫ বছর বয়সী আলাউদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আর্থিক সহযোগিতা পেলে অভিনয়কে একেবারে বিদায় জানিয়ে ঝালকাঠিতে ফিরে ছোট্ট একটি দোকান দিয়ে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিতে চান তিনি।

হাজারও স্মৃতি জড়িয়ে থাকা এফডিসি ছেড়ে যেতে পারবেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “কী করব? আর তো কুলাতে পারছি না। একদিন তো ফিরে যেতেই হবে।”

১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ চলচ্চিত্রের নাম ভূমিকায় অভিনয় করা রাইসুল ইসলাম আসাদের সঙ্গে জেলের ভূমিকায় অভিনয় করেন আলাউদ্দিন। কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে ছবিটি নির্মাণ করেন গৌতম ঘোষ।

পরিচালক দেলোয়ার জাহান ঝন্টু নির্মিত বেশির ভাগ চলচ্চিত্রেই দেখা গেছে আলাউদ্দিনকে; কাজ করেছেন একাধিক উর্দু চলচ্চিত্রেও। সহশিল্পী হিসেবে রাইসুল ইসলাম আসাদ, এটিএম শামসুজ্জামানের মতো প্রতিষ্ঠিত অভিনয়শিল্পীকে পেয়েছেন তিনি।

তবে আলাউদ্দিন কখনও চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্রে কাজের সুযোগ পাননি; বিষয়টি নিয়ে তার মনে কোনো খেদও নেই বলে জানালেন তিনি।

আরও অনেকের মতো আলাউদ্দিনও চলচ্চিত্র শিল্পীদের স্বার্থ সংরক্ষণে গঠিত বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সদস্যপদ পাননি। ফলে কাগজে-কলমে অভিনয়শিল্পী হিসেবে স্বীকৃতিও মেলেনি তার।

বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান বলেন, সমিতির সদস্য হতে হলে কমপক্ষে পাঁচটি চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করতে হবে।

“সমিতির গঠনতন্ত্রের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।”

আলাউদ্দিন জানান, ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অকৃতদার; এই শহরে কোনো সংসার পাতেননি তিনি। মাথা গোজার ঠাঁই নেই তার।

তার জীবনের একমাত্র আশ্রয় বলতে সেই এফডিসিই; রাতে পাহারার কাজ শেষে সকাল থেকে এফডিসির কড়াইতলা-আমতলায় বসে ‘রিল লাইফের’ চরিত্র পাওয়ার আশায় বসে থাকেন। ক্লান্তিতে শরীর নুয়ে এলে গাছতলায় বিশ্রাম নেন।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নামলে হাতে লাঠি আর মুখে বাঁশি নিয়ে ‘রিয়েল লাইফে’ রাতের পাহারাদারের চরিত্রে ঢুকে পড়েন।  

মহামারীর মধ্যে গত ১০ মাস ধরে এই আসা-যাওয়ার মাঝে চলচ্চিত্রের কোনো কাজ জোটেনি আলাউদ্দিনের।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের প্রাণকেন্দ্র এফডিসি।

সবশেষ গত বৃহস্পতিবার ‘লিডার: আমিই বাংলাদেশ’ নামে একটি চলচ্চিত্রের কাজের ডাক পেয়েছেন তিনি। দিনচুক্তি হিসেবে দিনপ্রতি শুটিংয়ের বিনিময়ে পাঁচশ টাকা পাবেন।

আলাউদ্দিন বলেন, “চেয়ে-চিন্তে চলতেছি। করোনার ভিতর পরিচালক সমিতি, প্রযোজক সমিতি ও শিল্পী সমিতি কিছু ত্রাণ দিয়েছিল। এখন খুবই কষ্টের মধ্যে আছি। কাজও তো হয় না।

“বহু বছর ধরে এই লাইনে থাকলেও আমি অবহেলিত মানুষ। কাজ পাচ্ছি না। ছবিও নাই। পুরানা পরিচালকরা বসা (কাজ নেই)। এখনকার মিডিয়া লাইনের পরিচালক, প্রযোজকরা তো আর আমাগোরে চিনে না। আমাগোরে খোঁজ নেয় না, কাজও করতে পারি না। এখন সিনেমা তো একেবারে নাই বললেই চলে। যাই আছে খুব অসহায় অবস্থার মধ্যে আছে।”

শুধু আলাউদ্দিন নয়, মহামারীর ধাক্কায় চলচ্চিত্রের অধিকাংশ জুনিয়র শিল্পী ও টেকনিশিয়ানরাই এখন আর্থিক সঙ্কটে দিন কাটাচ্ছেন।

শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান বলেন, “জুনিয়র আর্টিস্টরা আমাদের সমিতির সদস্য না হলেও তাদেরও আমরা ত্রাণ দিয়েছি। আগামীতেও তাদের পাশে থাকবে শিল্পী সমিতি।”

জীবন সায়াহ্নে এসে আলাউদ্দিন বললেন, চলচ্চিত্রের সেই ‘সোনালী সময়েও’ পরিচালকদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত পারিশ্রমিক পাননি তিনি।

“ওই সময় সবারই ভালোবাসার পাত্র ছিলাম। ওই ভালোবাসা পেয়েই ভুলে ছিলাম। টাকা পয়সা চাই নাই, উনারা (পরিচালক) সেরকম কিছু দেয়ও নাই। তখন ভাবতাম, সবাই ফিল্মের আপন। পরে যখন মনে হল, এখন পয়সাপাতি দরকার। তখন সেই পরিচালকরা আর নাই। কাজও নাই, টাকাও নাই। এখন আর কী করব?”