কোন খেয়ালে খেয়াল এ কবীর সুমন

বাংলা আধুনিক গানে নতুন একটি দিশা দিয়েছেন কবীর সুমন। এখন তিনি মনোনিবেশ করেছেন খেয়ালে; যদিও ছেলেবেলাতে খেয়াল দিয়েই তার সঙ্গীত সাধনার শুরুটা হয়েছিল। আধুনিক গান থেকে এখন কেন তিনি বাংলা খেয়ালের পথ তৈরিতে মনোযোগ দিলেন, তা তুলে ধরেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাজিদুল হক।

>>বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 June 2021, 05:42 PM
Updated : 28 June 2021, 03:23 AM

***

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: আপনি খেয়াল শিল্পী হিসেবে অল্প বয়স থেকে প্রশিক্ষিত। কিন্তু যৌবনে সেদিকে না গিয়ে আধুনিক গান নিয়ে রইলেন। বাংলা আধুনিক গানকে একটা দিশা দিলেন। এখন বাংলা খেয়াল নিয়ে কাজ করছেন। এই বাঁক বদলের কারণ কী?

কবীর সুমন: ১৯৪৯ সালে আমার জন্ম। শৈশব-কৈশোরের সন্ধিক্ষণে হিন্দুস্তানি খেয়াল শিখতে শুরু করি। আমার পিতৃদেব সুধীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় আমাকে গান শেখাতে অসামান্য গুরু কালিপদ দাশকে নিয়ে আসেন। তার জন্ম অধুনা বাংলাদেশে। আমার ধারণা দেশভাগের আগেই তিনি ভারতে চলে এসেছিলেন। আমার মাস্টার মশাই চিন্ময় লাহিড়িও ছিলেন অধুনা বাংলাদেশের লোক।

বাল্যকালে আমার খেলার বয়সে বাবা বললেন, ‘খেয়াল শেখো’। গত শতকের ছয়ের দশক কিংবা সাতের দশকেও গুরু, পিতৃদেব বলতেন, ‘চল্লিশ বছর বয়সের আগে খেয়ালের আসরে বসা যাবে না। আরও শেখো।’ বাবা বার বার বলতেন, ‘তোকে এত শেখাচ্ছি কিংবা শেখানোর চেষ্টা করছি কারণ তুই শিল্পী হবি বলে নয়, তুই ভালো শ্রোতা হবি বলে’। আধুনিক গান বা গানের জগতটা কিন্তু খুব বড়। গানের চর্চার ক্ষেত্রে আমার বাড়ি খুব উদার জায়গা ছিল। বাবা-মা কখনো আমাকে ‘না’ বলেননি। খুব উদারভাবে সব শেখার সুযোগ করে দিয়েছেন।

বাবা ও মা উমা চট্টোপাধ্যায় গানের জগতে যুক্ত ছিলেন। ১৯৩০ সালের বাবা গ্রামোফোনে রেকর্ডিং করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে। সংগীত ভবনের দায়িত্ব দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু মাইনে কুলোয়নি বলে বাবা করেননি। বাবা চেয়েছিলেন, আশি টাকা। রবীন্দ্রনাথ দিতে চেয়েছিলেন সাতাশ টাকা। বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে পুরো পরিবার নিয়ে এই টাকায় কুলাবে না বলে বাবা আর চাকরিটা করেননি।

পরে আকাশবাণীতে কাজী নজরুল ইসলাম বাবাবে চাকরিতে ঢুকিয়ে দিলেন।

একদিকে খেয়ালে আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ যেমন পেয়েছি অন্যদিকে আপন মনেও গান শিখেছি। বাবা আমার প্রথম সংগীতগুরু। ছয় বছর বয়স থেকে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের গান শেখানো শুরু করলেন তিনি। তখন এর ওর কাছে গান শিখে আসতাম।

নিহারবিন্দু সেন, কনক বিশ্বাস, নিখিলচন্দ্র সেন, সুধীর লাল চক্রবর্তীর কাছে গান শিখতাম। রেডিওতে শিশু মহলে গানের আসরে গান গাওয়া শুরু। আঠার বছর বয়সে আকাশবাণী কলকাতার একজন ‘তথাকথিত’ বেতার শিল্পী হলাম। তখন বেতার শিল্পী হওয়ার খুব দাম ছিল। পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হতে হত। সেই বয়সেই সুর দেওয়া শুরু করেছিলাম। তখন খেয়াল শিল্পী হব সেটা ভাবতে পারতাম না। আর প্লেবাক করার কথাও কল্পনা করা যেত না। তখন প্লেব্যাক করেন, হেমন্ত, শ্যামল, মানব বাবু, সন্ধ্যার মতো একেকটা বাঘ। আজকাল লোকে কথায় কথায় প্লেব্যাক করছে। যেন কী আনন্দ! আমরা ভাবতেও পারতাম না। ১৯৭২ সালে আমার গ্রামোফোন রেকর্ড করেছিলাম। নিয়মিত গান হচ্ছিল। পাড়ায় ঘরোয়া আসরে গাইতাম। বেতারের শিল্পী বলে সম্মান দিত।

তখন উস্তাদ আমির খান সাহেবের কাছে তালিম পাওয়ার খুব শখ ছিল আমার। তখন খেয়ালে অডিশন দেওয়ার চিন্তাও করিনি। অডিশন দিলে আমি ফেইল করতাম। এখন সবাই সবকিছু পারছে। গুরু আমির খান মারা গেলেন। আমি অকোজো হয়ে গেলাম। গলা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বছরে তার দুটো অনুষ্ঠান শুনব বলে বেঁচে থাকতাম।

মাঝে একটা ব্যাপারে জড়িয়ে গেলাম, দেশ ছেড়ে জার্মানিতে পালাতে হল। শেকড় থেকে উৎপাটিত হলাম, খেয়াল গাইব কোথায়। কিন্তু খেয়াল আমার পিছু ছাড়েনি। আমেরিকায় সাংবাদিকতার ফাঁকে নিজের কথায় খেয়াল শুরু করেছিলাম। খেয়াল আমাকে ধরে আছেন। আমাকে ধরে আছেন রবীন্দ্রনাথ, ধরে আছেন আধুনিক গান। আমি দুটো আলাদা করে দেখি না।

একটা সময় মনে হল, আধুনিক গান একটা জায়গায় থেকে গেছে। আমি একটি জায়গা অব্দি যেতে পেরেছি এরপর যতটুকুই যাব সেটা পুনরাবৃত্তিই হবে। ফলে এই সময় থেকে খেয়ালে পুরোপুরি নিয়োগ করলাম।

১৯৯৩ সালে আমার পিতৃদেব মারা যাওয়ার সময় বলেন, ‘আমি চললাম, তুইও মরবি। মরার আগে তোর দুটো কাজ। তোকে আমরা রবীন্দ্রনাথের গান যেভাবে শিখিয়েছি সেভাবে কিছু গান গেয়ে যাবি। আর তোর আধুনিক বাংলা ভাষায় বাংলা খেয়াল রচনা করবি ও গাইবি-এটা তোর কাজ। এই দায়িত্বটা তুই নে’।

তখন থেকেই ব্যাপারটা পাকাচ্ছিল ভেতরে ভেতরে। এই ভাবে খেয়ালের জগতে শেষমেষ এসেছি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে আপনি বলেছিলেন, বাংলা আধুনিক গানের একটা শেষ আছে। মানে, সুরগত দিক থেকে। খেয়ালে এই শেষটা দেখা যাচ্ছে না, খেয়াল বহমান। তার মানে আধুনিক গানের কী আর সম্ভাবনা নেই। না কি অন্য কিছু?

কবীর সুমন: আধুনিক গান শেষ এই অর্থে, কোনো জিনিসই শেষ হয় না। গান শুধু একটা সুর নয়, একটা কাঠামো। আবার বলছি, এখন মাপকাঠি বলে কিছু নেই। রবীন্দ্রলাল রায় তার ‘রাগ-নির্ণয়’ বইয়ে লিখেছিলেন, এখন ডেমোক্রেসির যুগ। সবাই সবকিছু পারে। যে পারছে গান লিখছে, সুর করছে। যা ইচ্ছে তাই করছে, যেন প্রলাপ। গানটা কোথায়। 

তখন রেডিও ছিল সংগীতের ফিল্টার। যদিও রাষ্ট্র বিরোধী কোনো কথা বলা যেত না। তারপরও পুরো উপমহাদেশে এত শিল্পী এসেছে শুধু রেডিওটা ছিল বলে। সেখানে একটা বিচার হত, একটা জাল ছিল। সেই জালে অনুপযুক্তরা ধরা পড়ত।

আজকে চারদিকে অদ্ভুত অবস্থা। আধুনিক গান তার ‘আধুনিক’ কথাটাকে হারিয়েছে। আধুনিক গানে যা ইচ্ছে তাই করব। আমি গান করে বলব, ‘আমি কিছু জানি না কিন্তু আমি করছি। এটা আমার বক্তব্য।’ মানে? তুমি এভাবে কথা বলতে পারবে? সবকিছুরই একটা রীতি আছে, এটা রক্ষণশীলতা না।

আধুনিক গান একটা জায়গায় এসে একটা অন্ধ গলিতে গোপ্তা মারছে। ‍বেশিরভাগ আধুনিক গান দেখো, একই রকম। একটা অদ্ভূত স্পিচ, গুজগুজ করে গাওয়া, স্পষ্টভাবে কোনো কথাও নেই, তেমন কোনো উক্তিও নেই।

ধরো, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। বাংলা গানে তার প্রতিফলন কোথায় হল? যুদ্ধকালে। পশ্চিমবঙ্গে বাংলা আধুনিক গানে আংশুমান রায়ের একটি গান। আর শচীনদেব বর্মণ, সলিল চৌধুরীর একটি গানে বাংলাকে পাওয়া গেল। এই কথাগুলো কেউ বলেও না জানেও না। লেখাও হয় না। গানগুলো সময়ের সঙ্গে হারিয়ে গেছে। যেটা বলতে চাইছি, বাংলাদেশ নিয়ে আস্ত নতুন গান তৈরি করা গেল না? আমার এটা নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে।

ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসি দেওয়া হল বেআইনিভাবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলামের কাছে কোনো গান পেয়েছিল বাঙালি? যাদের আমরা স্তম্ভ বানিয়ে রেখেছি, যাদের আমরা নায্য কারণে পূজো করি, যাদের অবলম্বন করে আমি অন্তত বেঁচে আছি তাদের কিন্তু একটা লাইনও নেই। ক্ষুদিরামের ‘ক্ষু’ কথাটা কোথাও নেই।

সূর্য সেন মারা গেলেন, একটা গানও নেই। আমি এটাই বলছি, আধুনিক গানে সময়ের প্রতিফলন ঘটার কথা। আমরা যারা গান বাজনা করি, তাদের ধর্মগ্রন্থ হওয়া উচিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সংগীত চিন্তা’ বইটা।

সেখানে তিনি বলছেন, বিলেত যাওয়ার আগে কলকাতার বেথুন সোসাইটির হলে একটা ভাষণ দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, আমাদের দেশে গীত ও কলার একটা অভ্যুদয় হয়েছে। এ নিয়ে মতামতের ঘাত-প্রতিঘাত, দ্বদ্ব-প্রতিদ্বন্দ্ব দেখা দেয়নি। এটা যতক্ষণ না হবে ততক্ষণ এ ক্ষেত্রে কোনো উন্নতি হবে না। আজ পযন্ত সেটা হয়নি।

আমরা সংগীতকে আলোচনার উপযুক্ত বিষয়ই মনে করি না। যদি আলোচনা হয় সেখানে ঝগড়াঝাটি হয়। বাঙালি জাতি সংগীত সাহিত্য তৈরি করতে পারিনি। আলোচনার ভাষাই তৈরি করতে পারিনি। সেটা অন্যান্য ভাষায় আছে, ভারতে নেই। ফলে আধুনিক গান যে লিখে চলে গেছেন এটা শুধুমাত্র অর্থকড়ি জায়গাতেই আছে। করতে হবে তাই করা।

বিষয়কে ধরে গান হয়নি। ধরা যাক, বেগম সুফিয়া কামালকে নিয়ে গান করেছি আমি।

আমার গানকে কেউ জীবনমুখী বললে আমি ভীষণ ক্ষুব্ধ হব। প্লিজ, আমার গান জীবনমুখী, মরণমুখী, চন্দ্রমুখী, বাঘমুখী নয়। আধুনিক বাংলা গান। আমার কোনো অ্যালবামে এই কথাগুলো লেখা হয়নি। আধুনিক গান অনেক কিছুকে নিয়ে নেবে। নিয়েছেও। তারপর কিন্তু আর চলছে না।

আধুনিকতা বিষয়টা আমাদের মধ্যে আর সুনির্দিষ্ট না, তার কোনো শরীর নেই। আমরা আঙ্গিকটা নিয়ে আছি কিন্তু বিষয়বস্তুটা আঙ্গিক হয়ে উঠছে না। প্রয়াত আজাদ রহমান সাহেবের ‘জন্ম আমার ধন্য হল’ গানের মূল আবেদন কিন্তু নির্মাণে। যেটা গাইতে গেলে ক্ষমতা লাগে। এই জায়গাটাই হারিয়ে ফেলেছি। এই জায়গা থেকেই বলতে চেয়েছিলাম, আধুনিক গান শেষ।

খেয়ালে একটা রাগে দুটো তিনটে বন্দিশ হতে পারে। আজাদ রহমানকে নিয়ে যে গান করেছি সেটা খেয়ালের বন্দিশ আবার গান হিসেবেও গাইতে পারি। কিন্তু আধুনিক গানের বাজারটা আটকে আছে। আধুনিক গান একটা কাঠামোর মধ্যে গাওয়া হচ্ছে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: খেয়াল যিনি গাইছেন বা বন্দিশটি রচনা করছেন তিনি গাওয়ার মধ্যে দিয়ে শৈলীর ভেতরে অনেকটা দূর যেতে পারছেন। আলাপ করতে পারছেন। বিষয়টি নিয়ে একটি আলোচনায়ও বলেছেন। এই সুরগত জায়গাটাও কী আধুনিক গানের ক্ষেত্রে কম?

কবীর সুমন: কিছুটা তো বটেই। কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর সংগীত নিয়ে যুক্তিগ্রাহ্য কোনো আলোচনাই হয়নি। মুক্তি মেলে নতুন পথে। নতুন পথে রক্তপাত হবে, কাঁটা ফুটবে। হিন্দি বন্দিশগুলো ধীরে ধীরে পাল্টাচ্ছে। কিন্তু বাঙালিরা কোথাও নড়তে চাইছে না। আমার স্বপ্ন হল-আমাদের তো কোনো হ্যান্ডবুক নেই। রবিশঙ্কর ও নিখিল সেতারে কর্ড বাজিয়েছেন। কত কী পাল্টাচ্ছে। এই আধুনিক গান কিন্তু মিলবে বাংলা খেয়ালের সঙ্গে। আমি যে বাংলা খেয়াল তৈরি করছি তার তত্ত্বই হল- বাংলা খেয়াল রাগকে নিজের জোরে একটা স্বাধীন গান হয়ে উঠতে হবে। রবীন্দ্রনাথ একাধিক খেয়াল বন্দিশ গান হয়ে উঠেছে। বাংলা খেয়ালের যে গান সেটা আধুনিক গান? আমার এটাই হল বক্তব্য। কারণ আধুনিক গান আর ব্রাত্য নয়, তেমনি বাংলা খেয়ালের বন্দিশ বা গান সেও কিন্তু আলাদা কোনো বিষয় নয়।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম:
একসময় বাংলা আধুনিক গানের শ্রোতা কমে যাচ্ছিলো। ৯০ এর দশকে আপনি নতুন একটা দিক উন্মোচিত করলেন। অনেক তরুণ আপনার পথে চলতে শুরু করেছিলো। এখন খেয়াল নিয়ে কাজ করছেন। আপনার তরুণ বন্ধুদের সাড়া কেমন পাচ্ছেন?

কবীর সুমন: আমায় আধুনিক গানে লোকে পছন্দ করেননি, এখনও করেন না। আমায় খুব কম লোক পছন্দ করেন। আমায় যে লোকে পছন্দ করেন এটা প্রথম প্রতিভাত হয় বাংলাদেশে গিয়ে ১৯৯৬ সালে। এতগুলো লোক গান শোনে আমার। রাস্তায় বের হয়ে আমাকে দেখে ছুটে এসেছিল। আমি এখানে যথেষ্ট ভালোবাসা পেয়েছি। নিন্দিত যেমন হয়েছি পলিটিক্যাল কারণে তেমনি ভালোবাসাও পেয়েছি।

কিন্তু খেয়াল শুরুর পর লোকে বলছে, কী শুরু করল! অনেকে বলছে, বাংলায় খেয়াল হয়? হিন্দুস্তানী, মৈথলি, মারাঠি, পশতুসহ এতগুলো ভাষায় খেয়াল হয় তাহলে বাংলায় নয় কেন? হয়নি কেন? করনি বলে। তরুণরা অনেকদিন হল খেয়াল ত্যাগ করেছে। শুনছে না। কেন শুনবে? খেয়ালটা হয়ে গেছে দৌড়ঝাপের বিষয়।সবকিছু খুব দ্রুত হচ্ছে। অদ্ভূত ব্যাপার।

কোনো স্বাভাবিক লোকের খেয়াল শোনার কথা না। আমাকে দেখে লোকে বলছে, বুড়ো বয়সে কবীর সুমনের ভিমরতি ধরেছে। কেন করছে? আধুনিক গানের বাজার নেই। আর করোনার যুগে বাজার জিনিসটাই চলে গেছে। আমি নিজে খেয়ালের একটা শো করেছি, হাউসফুল। সেখানে এমন মানুষও দেখেছিলাম, তারা বলেছিল, কোনো খেয়ালের অনুষ্ঠানে আসিনি। আপনার অনুষ্ঠান বলে এসেছি। চমৎকার জিনিস। সেখানে তরুণের সঙ্গে প্রবীণও ছিলেন। কাজেই শুধু তরুণ প্রজন্ম শুনছেন তা বলা যাবে না।

ইউটিউবে ‘কবীর সুমন বাংলা খেয়াল’র সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা বাড়ছে। তাদের বেশিরভাগই তরুণ। অর্থাৎ ধীরে ধীরে মানুষ খেয়াল শুনছেন। প্রবীণরা হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন, ওদের ফিরে পেতে সময় লাগবে।

একদিন বাংলাদেশেও দেখবে, কলেজ ফেস্টিভালে বাংলা খেয়াল হবে। কবে? কখন? আমরা আধুনিক গান গাইছি জিন্স পরে, কিন্তু খেয়াল গাইতে গেলেই শেরওয়ানী পরে কায়দা করে গাইতে হয়। অনেকে আবার তিলক কাটেন। উস্তাদ আমির খান সাহেবকে প্যান্ট শার্ট পরে গাইতে শুনেছি। উস্তাদ গোলাম মোস্তফা সাহেব প্যান্ট শার্ট পরেই গাইতেন। নিখিল বাবুকে ট্রাউজার পরে সেতার বাজাতে দেখেছি।

আমরা ক্রমশ পেছনের দিকে যাচ্ছি। যেদিন ছেলে-মেয়েরা তাদের স্বাভাবিক জামাকাপড় পরবেন এবং শুধু একজন নয়, অনেকে মিলে খেয়াল গাইবেন। আর দয়া করে একশ ঘণ্টা ধরে না। খেয়ারের আয়োজন ছোট করে করতে হবে। বেশিরভাগ খেয়াল শিল্পী একই জিনিস করছেন। তাল পাল্টে নাও। লোকের এমনি ভালো লাগবে।

আমি করে দেখেছি। গান সঙ্গে নাচটাও রাখলে আবেদন থাকবে। আমি বুড়ো মানুষ হয়েও এই বয়সে উদ্দীপ্ত হচ্ছি। আধুনিক গানে কিন্তু এরকম করতে পারবে না। পনের মিনিটের খেয়ালের স্লটে একজন নাচছে। কোনো কিছু বাধা ধরা নয়। এই ভাবে বাংলা খেয়ালের বিষয়গুলো সমসাময়িক হতে হবে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম:
বাংলাদেশে আজাদ রহমান বাংলা খেয়াল নিয়ে কাজ করেছেন। কিছুদিন আগে তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী চলে গেল। তার স্মৃতিতে আপনি একটি রাগ তৈরি করেছেন। বাংলাদেশে বাংলা খেয়াল চর্চা নিয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।

কবীর সুমন: আমি খুব কম জানি। আমি একটু খোঁজ নিয়ে দেখেছি, খুব একটা সক্রিয়তা নেই। আজাদ রহমান পথিকৃতের ভূমিকা নিয়েছিলেন বাংলাদেশে। আমি শুনেছি, উনি যে সময়টাকে গ্রামোফোন রেকর্ডও করেছিলেন বাংলা খেয়ালের। ওই রকম একজনকে যদি পশ্চিমবঙ্গে পেতাম, তাহলে খুব উপকার হত। আমরা পাইনি।

আমরা পেয়েছি সংগীত আচার্য সত্যকিংকর বন্দোপাধ্যায়কে। তিনি বাংলা খেয়ালের জন্য প্রাণপাত করেছেন, মার খেয়েছেন। অপমানিত হয়েছেন, লড়াই করেছেন। এখানেও ভালো শিক্ষক পাওয়া যাবে না।

অদ্ভুত হতাশার জায়গা হল-এখন বাংলা খেয়ালে তেমন কেউ নেই। কালক্রমে আগ্রহ নিয়ে অনেকে না আসায় এই ক্ষেত্রটা ডেভলপ হয়নি বাংলাদেশে। আজাদ রহমানের কথা শুনেছি। কিন্তু আর কেউ নেই। বাংলাদেশে এই ক্ষেত্রে দুর্বলতা আছে, পশ্চিমবঙ্গেও আছে। প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের কাছে আবেদন করেছিলাম। মাতৃভাষায় আমাদের খেয়ালের অধিকার রয়েছে। আমি একটু কাজে লাগতে চায়। আমাকে দিয়ে বাংলা খেয়ালের ওয়ার্কশপ করিয়েছিলেন তিনি। পরেরবার বাংলা খেয়ালের স্বীকৃতি দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার।

এখন রাজ্য সংগীত একাডেমিতে বাংলা খেয়ালের উপর দীর্ঘমেয়াদি একটি শিক্ষাক্রম চলছে। ২২ জনের মতো শিক্ষার্থী আছেন। সেখানে আমি শিক্ষা দিচ্ছি। সেই সূত্রে আমি অনেক কিছু জানতেও পারছি। উৎসাহ পাচ্ছি।

আমাদের সময় একটা ব্রত ছিল। সেটা কিন্তু সেইভাবে আর নেই। খেয়াল দুই বাংলাতেই মানুষের মন স্পর্শ করতে পারছে না। আমি আধুনিক গানে দু’চার জনের মন স্পর্শ করতে পেরেছি কিন্তু খেয়ালে সেটা হয়নি। লোকে তো খেয়াল শুনছে না টিকিট কেটে। একটা আধুনিক গানের যদি আমি কিংবা আরও দুয়েকজন করে তাহলে টিকিট কিনবেন কিন্তু খেয়ালে কেউ শুনছে না।