বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের কাছে অভিনয়ের যে পাঠ পেয়েছিলেন চম্পা

প্রয়াত চলচ্চিত্র নির্মাতা বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের পরিচালনায় নব্বইয়ের দশকে ‘লাল দরজা’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন অভিনেত্রী গুলশান আরা আক্তার চম্পা; তখন অভিনয়কলার যে পাঠ পেয়েছিলেন, তাকে শিল্পী জীবনের ‘পাথেয়’ হিসেবেই দেখেন বাংলাদেশের এক সময়ের জনপ্রিয় এই নায়িকা।

সাইমুম সাদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 June 2021, 09:40 AM
Updated : 10 June 2021, 09:40 AM

ঘুমের মধ্যে বৃহস্পতিবার ভোরে চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে পড়েন পশ্চিমবঙ্গের ৭৭ বছর বয়সী নির্মাতা বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত।

১৯৯৭ সালে চম্পা, রাইসুল ইসলাম আসাদ, শুভেন্দু চ্যাটার্জি, ইন্দ্রাণী হালদারকে নিয়ে নির্মিত ‘লাল দরজা’ সিনেমার জন্য ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন এ নির্মাতা।

বৃহস্পতিবার সকালে তার মৃত্যু খবর পেয়ে বিমর্ষ কণ্ঠে চম্পা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দুই দিন আগেও বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন তিনি, তা আর হল না।

বুদ্ধদেবের কিডনি জটিলতার কথা চম্পা জানতেন; তবে এভাবে তিনি চলে যাবেন-তা ‘কল্পনাও করতে পারেননি’।

“উনি আমাকে ‘দিদি’ ডাকতেন। ছোট বোনের মত আদর করতেন, ভালোবাসতেন। ‘লাল দরজা’ করতে গিয়ে তার পরিবারের সঙ্গে আমাদের পরিবারের ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল।”

‘লাল দরজা’ সিনেমায় কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন চম্পা; এরপর তাকে নিয়ে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত আরও একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের ইচ্ছার কথা জানালেও তা অপূর্ণই রয়ে গেল।

১৯৯৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মাতা গৌতম ঘোষের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ ও ১৯৯৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের গল্পে তার ছেলে সন্দীপ রায়ের হিন্দি সিনেমা ‘টার্গেট’ এ চম্পার অভিনয় দেখেছিলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত।

চম্পা বলেন, “ছবি দুটি দেখে বুদ্ধ দা’র মনে হয়েছিল ‘লাল দরজা’র মূল চরিত্রটা হয়ত আমি ফুটিয়ে তুলতে পারব। উনি আমার টেলিফোন নম্বর জোগাড় করে ফোনে বলেছিলেন, ‘এই ছবির প্রধান চরিত্রে আপনাকে নিয়ে কাজ করতে চাই। আপনি সম্মতি দিলে ঘোষণা দেব’। আমি ফোনেই ‘হ্যাঁ’ বলেছিলাম।

“তখন অডিশন ছাড়া সিনেমায় কাজের সুযোগ মিলত না। কিন্তু তিনি দুটি ছবি দেখে আমাকে নিয়ে যাচাই বাছাইয়ের প্রয়োজন মনে করেননি।”

দৃশ্যধারণ শুরু হওয়ার কয়েকদিন আগেই কলকাতায় গিয়েছিলেন চম্পা। নিজের মেকআপ, গেটআপ ও চরিত্র বুঝিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি সহশিল্পীদের সঙ্গে রিহার্সেলও করেছেন তিনি।

“বুদ্ধ দা’র সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে শিখেছিলাম, কয়েকটা বিষয় রপ্ত করতে পারলে চরিত্রের সঙ্গে মিশে যাওয়া যায়। যেমন, যখন আমার সিরিয়াস কোনও শট থাকত তখন কারও সঙ্গে কথা বলতে দিতেন না। চুপচাপ থাকতে বলতেন, মেকআপ রুমে দরজা বন্ধ বসে থাকতে বলতেন; ফোনেও কথা বলতে বারণ ছিল। অন্যদের সঙ্গে কথা বললে মনোযোগের ঘাটতি হয়। তাতে চরিত্রও দু্র্বল হয়ে যায়।

“আর ডাবিংয়ের সময় নির্বাচনের ক্ষেত্রে সকাল বেলা নির্বাচন করতেন সবসময়। কারণ সকালের দিকে গলার গভীরতা পাওয়া যেত। ডাবিংয়ের সেরাটা দেওয়ার জন্য ঘুম থেকে উঠে কারও সঙ্গে কথা বলতে নিষেধ করতেন আমাকে।

“এই জিনিসগুলো উনার কাছ থেকে আমি শিখেছি। বড় পরিচালকদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখে জীবনের ঝুলিটা সমৃদ্ধ করেছি। শিল্পী হিসেবে এগুলোকে অভিনয় জীবনের পাথেয় হিসেবে নিয়েছি।”

সিনেমা মুক্তির পরও বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল চম্পার; যতবার কলকাতায় গেছেন ততবারই তার সঙ্গে দেখা করেছেন। করোনাভাইরাস মহামারীর আগে কলকাতায় তাদের দেখা হয়েছিল।

তারপর আর কোনো সিনেমায় অভিনয়ের কথা হয়েছিল? চম্পা বললেন, “একদিন দাদাকে বলেছিলাম, আপনার সঙ্গে পরে আর কোনো ছবিতে কাজ করা হয়নি। উনি বলেছিলেন, ‘দিদি, এর মধ্যে যা কাজ করেছি তার মধ্যে তোমাকে দেওয়ার মতো চরিত্র ছিল না। আমার জন্য প্রার্থনা কর, যদি সুস্থ থাকি সামনে তোমাকে নিয়ে অবশ্যই একটা কাজ করব’।”

সবশেষ দুই মাস আগেও বুদ্ধদেবের সঙ্গে কথা হয়েছিল বলে জানালেন চম্পা।

“আমাদের সাবধানে থাকতে বলেছিলেন। কুশলাদি জিজ্ঞাসা করলে বলেছিলেন, ‘কিডনির ডায়ালাইসিসের জন্য মাঝে মাঝে ক্লিনিকে যেতে হয়। তারপরও সাবধানতা অবলম্বন করছি। তোমরা আমার জন্য দোয়া করো।’

“উনি একদম স্বাভাবিক স্বরে কথা বলেছিলেন। মানসিকভাবেও যথেষ্ট শক্ত মনে হয়েছিল। আমরা পুরানো দিনের আলাপ করেছিলাম। ছবির শুটিং, ডাবিংয়ের ছোট ছোট গল্প, ঘটনাগুলোর স্মৃতিচারণ করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘কতদিন ধরে তোমাকে দেখি না। করোনাভাইরাস পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এসো’।”

১৯৬৮ সালে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে পরিচালনায় যাত্রা শুরু করেন বুদ্ধদেব। ‘দূরত্ব’, ‘নিম অন্নপূর্ণা’, ‘গৃহযুদ্ধ’, ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’, ‘স্বপ্নের দিন’, ‘উড়োজাহাজ’-এর মতো সিনেমা করে দর্শকদের কাছে প্রশংসিত হন।

‘লাল দরজা’ ছাড়াও ‘বাঘ বাহাদুর’, ‘চরাচর’, ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’, ‘কালপুরুষ’ চলচ্চিত্রের জন্য ভারতের জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।

নির্মাণের পাশাপাশি সাহিত্য জগতেও পদচারণা ছিল বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের। তার কয়েকটি কবিতার বইও প্রকাশিত হয়েছে।